Site icon আলাপী মন

গল্প- শঙ্খধ্বনি সেদিন দিও

শঙ্খধ্বনি সেদিন দিও
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

কাল সারাদিন অসহ্য প্রসব যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি হতে হতে প্রায় রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। ডাক্তার জানালেন সিজার করার দরকার নেই নরম্যাল ডেলিভারি সম্ভব। মিতাকে প্রসূতি কক্ষে নিয়ে যাওয়ার পর অতনু একটা ফোন করলো বাড়িতে। রমা দেবীও চিন্তায় অস্থির। ফোন পাওয়া মাত্র তিনি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করেন,’কী রে কী হলো?’
অতনু বললো, ‘মা, ডাক্তার বাবু বলেছেন এখনও দেরী আছে। তুমি চিন্তা করো না আমি ঠিক সময় মতো তোমাকে ফোন করবো। অলি এসে গেছে?’
রমা দেবী জানালেন ‘হ্যাঁ রে এই মাত্র দীপক নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। তোর ছোট মেয়ে তো অলির ছেলের সঙ্গে খেলতে ব্যস্ত। ঠিক আছে বাবা, তুই রাখ এখন।’
রমা দেবী ফোনটা রেখে হাতজোড় করে মা দূর্গার ফটোর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন, ‘মা গো এবার মুখ তুলে তাকিও। দুই মেয়ের কোলে এবার যেন ছেলে হয় বৌমার। আমি ছেলে হলে নবমীতে জোড়া পাঁঠা বলি দেবো মা।’
রমা দেবী খেয়াল করেন নি কখন তার পিছনে অলি এসে দাঁড়িয়েছে। পিছন ফিরতেই তাকিয়ে দেখে অলি গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘চল এবার দু’টো রুটি খেয়ে নিবি চল। এসে থেকে তো কিছুই মুখে তুলিস নি। দাদুভাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’
অলি বলে, ‘হ্যাঁ, আমি ওদের তিনজনকে বিছানা করে দিয়ে এলাম। তোমার বড় নাতনি এখনও পড়ছে আর বাকি দুজন মনে হয় এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। মা তোমাকে একটা কথা বলছি প্লিজ কিছু মনে করো না। তুমি মা দূর্গার কাছে দাদার ছেলে প্রার্থনা না করে মেয়ে প্রার্থনা করতে পারতে।দেখছো তো আজকাল ছেলেদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কত খানি বেড়ে গেছে। আগে মারপিট গুন্ডা বদমাইশি করে বেড়াতো কিন্তু এখন মেয়েদের সঙ্গে অমানবিক কাজ করতেও দ্বিধা বোধ করে না ছেলেরা। যদিও সেই ধরনের ছেলেদের সংখ্যা আজও কম । তবু ভয় হয় আমার বাড়ির ছেলেটা যদি এই রকম কু-সঙ্গে পড়ে যায়। মা গো মেয়েকে যেমন বড়ো হলে আমরা শাসন করি, তার সামনে ভালো মন্দ দিকগুলো তুলে ধরি ঠিক ছেলেদেরকেও সমান ভাবে সেই শিক্ষা দিতে হবে আমাদের। যৌনতা সম্পর্কে আমাদের অপ্রয়োজনীয় গোপনীয়তাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সামনে সংকট হয়ে উঠেছে। যেকোনো বিষয়ে অজ্ঞানতাই অন্ধকার নিয়ে আসে।’
রমা দেবী এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। তিনি বিরক্তির সাথে বলেন, ‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুই তোর ছেলের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক নিয়ে কথা বলবি? দেখ অলি আমাদের সমাজে এইসব বিষয় গোপন করেই রাখা হয়। এইগুলো প্রকাশ্যে এলে সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে।’
অলি এবার গলার স্বরকে আরো নিচু করে বলে, ‘কোন সমাজের কথা বলছো মা? যে সমাজ তোমার আমার বাড়ির মেয়ে বউদের সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগায়? একা একটু রাত হলেই বের হতে ভয় লাগে। বাড়ির কোনো পুরুষ মানুষ সঙ্গে না থাকলে বের হতেও পারি না। মা আমরা তো বন জঙ্গলে বাস করি না। আমরা সভ্য সুসজ্জিত আলোয় ঝলমলে শহরে বাস করি। যত না চোর ডাকাতের ভয় পাই তার চেয়ে বেশী ভয় পাই ধর্ষকদের কথা ভেবে। কোথায় কীভাবে ঘাপটি মেরে বসে আছে যার টের পাওয়া মুশকিল। এই ধর্ষকরা তো কারোর না কারোর বাড়ির পুরুষ।’
এতগুলো কথা বলতে বলতে অলির গলা ভারি হয়ে উঠেছে তার চোখের কোণে তীব্র যন্ত্রণার চিহ্ন স্বরূপ জলও এসে পড়েছে। তবু সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘তোমাদেরকে এসব কথা বলার কোনো মানেই হয় না। চল, চল সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়বে চলো। রাত অনেক হয়েছে। সকালের মধ্যে বৌদির একটা খবর এসে পড়বে।’
রমা দেবী একবাটি শুকনো মুড়ি দুধে ভিজিয়ে খেয়ে নিজের ঘরে শুতে চলে গেলেন চুপচাপ। অলি কিচেনটা পরিষ্কার করে এঁটো বাসনগুলো একটা গামলায় জল দিয়ে ভিজিয়ে রেখে দিল।

সকালে ঠিকে কাজের মাসি এসেই জিজ্ঞাসা করে ‘ কী গো বৌদি মনির এবার ছেলে হলো তো?’
রমা দেবী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ‘তুই তোর কাজ কর। ছেলে মেয়ে যা হবে ঠিক খবর পেয়ে যাবি।’
দোতলা থেকে অলির গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কার সাথে যেন কথা বলছে। রমা দেবী চুপচাপ মালা জপে যাচ্ছেন। একটু পরেই অলি নিচে নেমে এসে জানায় ‘মা দাদার একটা সুস্থ বাচ্চা হয়েছে। বৌদির ছেলে হয়েছে মা।’
ঠিকে কাজের মাসি তো একগাল হেসে বলে ‘শাঁখ বাজাও গো শাঁখ।’
অলি ঠাকুর ঘরের দিকে রওনা দিলে রমা দেবী বলেন, ‘ আজ থাক। যেদিন এই ছেলে একটি বিপদগ্ৰস্ত মেয়ের সম্মান রক্ষা করতে পারবে সেদিন শঙ্খধ্বনি করিস। আজ নয়।’
অলি ছুটে এসে রমা দেবীকে জড়িয়ে বলে, ‘মা তুমি যে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তৈরী ভুলে ভরা সংস্কার থেকে  নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছো তা ভেবে আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে কী বলবো। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তোমার মতো জ্ঞান চক্ষুর উন্মোচন সকলের হোক।’

Exit mobile version