গল্প

গল্প- ভিক্ষা নয় ভালোবাসা

ভিক্ষা নয় ভালোবাসা
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

বিয়ের পর এই প্রথম বার মামাবাড়িতে বিজয়া প্রণাম করতে এলো রিমি। একসময় দিনের পর দিন এই মামাবাড়িতে পরে থাকতো সে। আসলে তখন মামাবাড়িটা তার যৌথ পরিবার ছিল। মা বাবার একমাত্র সন্তান হলেও লোকজন রিমির খুব পছন্দ। কাজিনদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া, ঘুমানো, পুকুরে স্নান করতে যাওয়া, বিকাল হলেই ধান ক্ষেতে বসে আড্ডা এই সব ছেড়ে কিছুতেই কলকাতা ফিরে আসতে মন চায় না রিমির। তবে বিয়ের দশ বছরেও এর আগে বিজয়া দশমী করতে সময় পায় নি রিমি।
আজ মহা সপ্তমী। করোনার আতঙ্কে দিন কাটলেও দেবীর আরাধনা বন্ধ হয় নি। তাই আর মনখারাপ নয়। একটু আনন্দ হয়ে যাক এবার তাই রনজয়কে নিয়ে দশমীর দিন সকালেই রিমি এসে হাজির আরামবাগের তিরোল গ্ৰামে। আগের দিন মেজ মামাকে ফোন করে জানিয়ে ছিল সে। আসলে পাঁচ মামা-ই আলাদা। আগের মতো এতো বড় হাঁড়ি নেই যে যখন খুশি বাড়তি লোক আসুক কোনো অসুবিধা নেই। এই দশ বছরে গ্ৰামটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ধান জমিতে গড়ে উঠেছে বড় বড় পাকা বাড়ি। রিমির মনে হলো গ্ৰামগুলো যেন কোথাও তার লালিত্য হারাচ্ছে। হঠাৎ সে চিৎকার করে ওঠে ‘গাড়ি থামাও,গাড়ি থামাও।’

রনজয় গাড়ি থামাতেই প্রায় লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ছুটতে শুরু করে আল রাস্তা ধরে রিমি। রনজয় তো অবাক! রিমি ছুটে গিয়ে একটা বৃদ্ধ মহিলাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মহিলা ভুরু কুঁচকে বলে ‘সেজ পিসিমার মেয়ে রিমি দিদিমনি না। কত বছর পর তোমাকে দেখলুম। কার সঙ্গে এইচো দিদিমনি?’
রিমি বলে, ‘আমার বরের সঙ্গে। চলো তুমি গাড়িতে ওঠো। এখন কোথায় যাবে?’
বৃদ্ধ মহিলাটি বললো, ‘তোমার মেজ মামার ঘরই যাবো। এখন শুধু ওদের বাড়িতেই কাজ করি।’

বৃদ্ধ মহিলাটির নাম চাঁপা। সবাই তাকে চাঁপাদি বলেই ডাকে। বহু বছর ধরে রিমির মামাবাড়িতে কাজ করে সে। রিমি যখন আগে মামাবাড়ি আসতো রিমির জামা কাপড় ধুয়ে দিতে। রিমি পুকুরে স্নান করতে নামলে সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো। রিমির চপ্পলে কাদা লাগলে পরিষ্কার করে দিতো। আরো কত কি।
বিনিময়ে রিমির মায়ের কাছ থেকে পুরানো শাড়ি, পুরানো জুতো, পুরানো ব্যাগ এইসব আবদার করতো।

গাড়িতে যেতে যেতে চাঁপাদি জিজ্ঞাসা করে রিমি কদিন থাকবে। রিমি বলে আগামীকাল সকালেই চলে যাবে। চাঁপাদি বলে, ‘জানো এখন অনেক টাকার ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু প্রতিমাসে টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারি না। তুমি আমায় যাওয়ার সময় কিছু টাকা দিয়ে যেও।’
রিমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।

পরেরদিন রিমিরা বের হবে ঠিক সেই সময় এসে হাজির চাঁপাদি। মেজ মামি আগেই বলে দিয়েছে, ‘রিমি কুড়ি টাকার বেশি একদম দিবি না। ওদের ভীষণ চাওয়া বাতিক।’
‌রিমি ওর পার্স থেকে প্রথমে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে দিতে যাবে হঠাৎ তার মনে হলো সে কি ভিক্ষা দিচ্ছে চাঁপাদিকে। না একদমই না। সে তো চাঁপাদিকে যথেষ্ট ভালোবাসে। তাহলে করুণা নয় ভালোবাসা দেওয়া উচিত। রিমি একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে চাঁপাদির হাতে দিয়ে বলে, ‘চাঁপাদি এইটা রাখো। ওষুধের পাশাপাশি একটা হরলিক্স কিনে খেও।’

চাঁপাদি হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। রিমির হাত দু’টো ধরে চুমু খেতে শুরু করে। আর বলে ‘আবার কবে আসবে তুমি রিমি দিদি। ততদিনে আমি হয়তো মরেই যাবো।’
রিমিরও চোখের কোণে জল এসে যায়। জলটুকু লুকিয়ে বলে, ‘এবার আসি আমরা। আবার দেখা হবে।’

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page