নীলচে সুখ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
পর্ব- ৯
সিকিমের পাহাড়গুলো বড়োই ভঙ্গুর। যখন তখন, যেখানে সেখানে ধ্বস নামে। মানগাং তাদের অন্যতম। সম্ভবত সেই কারণেই এখানে জনবসতি কম। জনবসতি কম বলেই, এখানকার সৌন্দর্যে ভাটা পড়েনি। প্রকৃতি এখানে নিষ্কলুষ। মন এখানে প্রজাপতি হতে চায়। সৌন্দর্যের মধু নিতে চায় উড়ে উড়ে, আরও আরও আরও দাও প্রাণ।
গতকাল যেখানে ধ্বস নেমেছিল সেই জায়গা এখনো পরিস্কার করার কাজ চলছে। বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মীরাও অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন।
এখানের ধ্বসে, পাথরের ছোট বড়ো টুকরোর সাথে প্রচুর মাটিও ওপর থেকে নেমে আসে।
বড়ো বড়ো পাথরের চাঁইগুলোকে সরিয়ে দেওয়া গেছে, কিন্তু ছোট ছোট টুকরোগুলো, বৃষ্টি ভেজা মাটির সঙ্গে লেপটে আছে। কাদা প্রায় হাঁটুর সমান। তারই নিচে ডুবে থাকা পাথরগুলো দেখা যায় না। অন্তত পঞ্চাশ মিটার এলাকা এইরকম ভয়ঙ্কর ভাবে রয়েছে।
দপ্তরের কর্মীরা পুলিশের সহায়তায়, একটি একটি করে গাড়ি অতি সাবধানে এই রাস্তাটুকু পার করিয়ে দিচ্ছেন।
দইগোলার মতো কাদার ওপর দিয়ে কোনও রকমে একটি একটি করে গাড়ি ঐ ভয়ঙ্কর রাস্তাটুকু পার হয়ে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচচ্ছে।
বাঁ দিকে গভীর খাদ। সেখানে গিয়ে পড়লে, সোজা কল্পিত স্বর্গলাভ নিশ্চিত।
কয়েকটি গাড়ি মোটামুটি নির্বিঘ্নেই চলে গেল। কিন্তু বিপদ হলো ওদের গাড়ির বেলাতেই।
কাদার নিচে ডুবে থাকা একটা পাথরে ধাক্কা লেগে গাড়ির চাকা গেল ঘুরে। তখনই সকলকে হতবিহ্বল করে গাড়ি চলে এলো একেবারে গভীর খাদের কিনারায়।
গাড়ির সামনের দিকের অংশ খাদের দিকে ঝুলে গেল। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলতে হবে। অথবা আয়ুর জোর । পিছনের দিকের একটা চাকা, বেশ বড়ো একটা পাথরে আটকে গেল। তাই গাড়িটা যাত্রী সমেত খাদে গড়িয়ে যেতে গিয়েও, শেষ অবধি থমকে থেমে গেল।
গাড়ির মধ্যে নয়টি প্রাণী আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে কাঠের পুতুলের মতো নিথর হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর প্রতিক্ষা করছে।
কিছু পরেই তারা অনুমান করলো, এ যাত্রা তারা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, কিন্তু বিপদ কাটেনি। সামান্য নড়াচড়া তাদের বিপদে ফেলতে পারে। নীল মৃদু স্বরে বললো, ‘কেউ নড়াচড়া করবে না। যে যেখানে যেমন আছো, তেমনই থাকো।’
ড্রাইভার, নীলের কথায় সমর্থন জানিয়ে, ভাঙা বাংলায় বললো, ‘রাইট স্যার। একদম হিলবেন না। গাড়ি হিলিয়ে গেলে, নিচে চলে যাবে। জান কা খতড়া আছে বাবু।’
ততক্ষণে বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের কর্মীরা এসে গেছে। গাড়ির পিছনে ক্রেনের হুক লাগিয়ে টেনে তুলছে গাড়ি। খুবই সন্তর্পণে, ধীরে ধীরে গাড়ি আবার সেই রাস্তায় ফিরে এলো।
বিপদ কেটে গেছে। মানালি মায়ের কোলে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। মিসেস রায় প্রফেসরকে প্রবল বিক্রমে জাপটে ধরে আছেন। প্রফেসরের চোখ বন্ধ, কিন্তু
ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে, নাকি
মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করছেন, তা তিনিই বলতে পারবেন।
গাড়ি রাস্তায় উঠে আসার পরেই, আবার চলতে শুরু করেছে। প্রফেসর এবার চোখ মেলে তাকালেন। ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে অত্যন্ত বিনয়ী কন্ঠে ধীরে ধীরে বললেন,
‘সামাল কে ভাইয়া, জান কা মামলা হ্যায়।’
ড্রাইভার হেসে বললো, ‘পাহাড় মেঁ এয়সা হোতি হ্যায় সাব। ঘাবড়াইয়ে নেহি । সামনে অর ভি খতরনাক জায়গা মিলেগি। ভরোসা রাখিয়ে। কুছ নেহি হোগা। ম্যয় হুঁ না।’
আপাতত বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু মিসেস রায়ের মনে ভীষণ ভয় ঢুকে গেছে। ওই যে ড্রাইভার বললো, সামনে নাকি আরও বিপদ আছে? ড্রাইভারের ওই, ম্যায় হুঁ না, কথায় কারো বিশ্বাস নেই। এইমাত্র যে কান্ড ঘটিয়েছো, তারপরে তোমাকে ভরসা করার কোনও মানেই হয় না। অথচ অনন্যোপায়, তাকেই নির্ভর করতে হবে, আগামী বেশ কয়েকদিন।
এর চাইতে অসহায় অবস্থা আর কি-ই বা হতে পারে?
মানালি মায়ের কোল থেকে মুখ তুলে হালকা স্বরে বললো, ‘গাড়িটা একটু দাঁড় করাও না, একটু নেমে জল খাবো।’
সম্ভবত জল খাওয়া উদ্দেশ্য নয়। সে তো গাড়িতে বসেই খাওয়া যায়।
আসলে মাটির মানুষ। মাটিতেই ভরসা, নির্ভরতা। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে এত সামনে থেকে দেখে, সেই মাটির প্রতি টান গভীর হয়ে উঠেছে। একবার এখনই তাকে না স্পর্শ করলেই নয়।
মাটি। মানুষের জীবন ধারণের এক প্রধান উপাদান। মাটি, তুমি ছাড়া হ’লেই হৃদয় কম্পমান। মাটি, তোমাকে শতকোটি প্রণাম।
কথাটা বোধহয় সকলের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো, শুধু মুখ ফুটে বলছিলো না।
নীল তৎক্ষনাৎ হুকুমের সুরে বললো, ‘এই ড্রাইভার, গাড়ি থামাও। আমরা একটু নামবো।’
ড্রাইভার আরও মিনিট কয়েক পরে একজায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলো।
পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। প্রকৃতি এখানে আরও উদার। চারপাশ, যেদিকে চোখ যায়, পাহাড় পাহাড় আর পাহাড়। একটি ঝর্ণা, এলোচুল চঞ্চলা কিশোরীর মতন হেলেদুলে নাচতে নাচতে ওই দূরের পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসছে। তার ঝরঝর শব্দ, সরোদের ঝংকার তুলে ধ্যানমৌন পাহাড়ের ঘুম ভাঙাতে নিরলস চেষ্টায় নিমগ্ন।
পাইন কাঠের ছোট্ট বেঞ্চি। প্রফেসর আর মিসেস রায়, তাতে বসে পড়লেন। বুক ভরে নিলেন বিশুদ্ধ বাতাস। এখনো কেউই স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেননি। জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেলো সবাই। দারুণ ঠান্ডা জল। আবারও মেঘ ঘনিয়ে আসছে। কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছে।
চা দোকানী- একটি পাহাড়ি স্ত্রী লোক, তার পিঠে কাপড় দিয়ে বাঁধা একটি বাচ্চা।
চলমান জীবন যুদ্ধের জলজ্যান্ত ছবি। এভাবেও বাঁচে জীবন। বুকে লড়াই আর স্নেহ মমতাকে পিঠে বেঁধে, সুখ অসুখের সীমানা পেরিয়ে, মৌন গম্ভীর ধূসর জীবনযাপন।
আরও পথ। সামনে আরও পথ। অজানা অচেনা। আস্থাহীন সারথি’র হাত ধরে, সুখের খোঁজে পথ চলা। কেবলই পথ চলা।
পর্ব-১০
পাহাড়ি পথে গাড়ি চাপলেই সমতলের মানুষ কিঞ্চিৎ ভীতু হয়ে যান। পাকদণ্ডী পথে পাক খেতে খেতে গাড়ি যতই ওপর দিকে উঠতে থাকে। নিচের দিকে তাকালে, বুক কেঁপে ওঠে।
মৃত্যু ভয়, প্রতি মুহূর্তে জানান দেয়, জীবন কত মধুর, কত সুন্দর।
একে হারাতে চাই না। থাকো, থাকো, ওগো প্রাণ। শরীরের খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকো দীর্ঘ সময়। আনন্দময় সুখী হয়ে।
যান্ত্রিক বিপর্যয়ের ভয় তো আছেই। বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা দুরন্ত গাড়িগুলো, যতক্ষণ না পাশ দিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছে, আতঙ্ক কাটে না। বিশেষ করে গাড়ি যদি, খাদের দিকে থাকে।
আর, স্টিয়ারিং হাতে লোকটির প্রতি আস্থা যদি তলানিতে গিয়ে থাকে। তবে আতঙ্কের মাত্রা কোথায় পৌঁছাতে পারে, তা ভুক্তভোগী মাত্রই নির্ঘাত ভাবে উপলব্ধি করতে পারেন।
এদের ক্ষেত্রেও সেই একই অনুভূতি। তাই, পথে যেতে যেতে প্রকৃতির আশ্চর্য সুন্দর রূপ-সুধা তেমন করে আকন্ঠ মুগ্ধতায় পান করা হয়ে উঠলো না। একটা ভয়ার্ত, দমবন্ধ ভাবনা থেকে কিছুতেই নিস্তার পাওয়া গেল না।
ড্রাইভার হঠাৎ হিন্দিতে বললো। যার বাংলা তর্জমা করলে যা হবে, ‘ডান দিকের জানালার কাঁচগুলো বন্ধ করে দিন। নইলে, ঝর্ণার জলে ভিজে যাবেন। এখনই আমরা ঝর্ণার ভেতর দিয়ে যাবো। ভীষণ ঠান্ডা জল। বরফের মতো। এই ঠান্ডায় ভিজে গেলে, খুবই কষ্ট পাবেন।’
এর পরের কথাটি সত্যিই আতঙ্কিত হবার মতো।
‘ঝর্ণার জলে ওখানকার রাস্তায় হাল খুবই খারাপ। গাড়ি দুলবে। ভয় পাবেন না। সবাই শক্ত করে ধরে চুপচাপ বসে থাকবেন। নড়াচড়া করবেন না। কারণ রাস্তা শুধু ভাঙাই নয়, পিচ্ছিলও বটে।’
সকলেই বাক্যহারা। সকলেই সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিলো।
কিছুক্ষণ আগেই ঘটে যাওয়া সেই ভয়ানক ঘটনা এখনো মনের মধ্যে দগদগে হয়ে আছে। এরপর আবারও যদি…
মিসেস রায় মনে মনে এই অনাবশ্যক ঝুঁকি পূর্ণ ভ্রমণে আসার জন্য আক্ষেপ করছেন। আনমনে হাত ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট রুমাল বের করে আনলেন। পুঁটুলির মতো করে বাঁধা।
সেটি চোখ বুঁজিয়ে কপালে ছোঁয়ালেন। ওটা মানালির দেওয়া সেই প্রসাদী ফুল।
দুর্গামাঈ কী জয়। বিপদ আপদে তার কথাই বড্ড বেশি মনে পড়ে।
প্রফেসর বিস্ফোরিত চোখে বললেন, ‘একেবারে ঝর্ণার মাঝখান দিয়ে?’
ড্রাইভার বললো, ‘ইয়েস স্যার। বো ঝোরা পাহাড়কে উপর সে সিধা রাস্তে পে গিড়তা।তেজ জাদা নেহি, লেকিন পানি কে কারণ দিক্কত হোতি হ্যায়। ডড় নেহি।’
আর একটু এগিয়েই ড্রাইভার বললো,
‘ওয়ো দেখিয়ে দূর সে বহৎ আচ্ছি লাগতি। ম্যায় ইঁহা গাড়ি রোক দেতা হুঁ। ফোটো খিঁচ লিজিয়ে।’
নীল বসে ছিল সেই জানালার ধারেই। দরজা খুলে সেই প্রথম নেমে গেল। অস্ফুটস্বরে বললো, ‘রিয়েলি ওয়ান্ডারফুল। নাইস।’
একে একে সবাই নেমে এলো গাড়ি থেকে। সেই আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্যের মনোহরণ রূপে, মোহিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এমন সৌন্দর্য উপভোগ করতে সহস্রবার জীবনের ঝুঁকি নেওয়া যায়। এ-ই তো জীবন। এখানেই তো জীবন আর মরণের তফাৎ।
দূর থেকে যে নৃত্যরতা কিশোরী ঝর্ণটি দেখা যাচ্ছিলো এতক্ষণ। এ-ই সেই স্বর্গীয় নর্তকী। পাহাড়ের কোল থেকে নেমে এলোমেলো অশান্ত দুরন্ত পায়ে সে ছুটে যেতে যায় কোন অজানার দেশে। অজস্র অজস্র জলকণা ধোঁয়ার মতো ছেয়ে ফেলেছে চারদিক। সাদা ফ্যানার স্রোত হু হু করে নেমে যাচ্ছে পাশের খাদে জলতরঙ্গ বাজাতে বাজাতে।
মুভি মুডে ছবি ধরা রইলো সকলের ক্যামেরায়। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। কিন্তু ছবি তো শুধুই ছবি। প্রাণসঞ্চার হলো কী তাতে? না। তাকে ধরা যায় না। সে থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মনের অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার পেয়েছে যে, তাকে বন্দী করবে, এমন সাধ্য কার?
গাড়ি এগিয়ে চললো। চিরকিশোরী রৌপ্যবর্ণা মাধুরিকে প্রেম চুম্বন দিয়ে, দূরে, আরও অনেকটা পথ বাকি। পৌঁছাতে হবে সন্ধ্যার আঁধার নামার আগেই। এই পথে পাহাড়ি ভাল্লুকের উপদ্রব আছে।
এখন পাহাড় যেন চারপাশ থেকে জাপটে ধরতে আসছে। কালচে পাহাড়গুলো এক-একটা বিশালাকার দৈত্যের মতন খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।
এতো রূপ এরা পেলো কোথায়। কোন সে রূপকার, কেমন করে এমন হৃদয় হরণ সাজে সাজালো এদের?
হে প্রকৃতি। হে প্রকৃত দেবতা, তুমি তোমার অনির্বচনীয় সুখানুভূতি রংতুলির প্রলেপ বুলিয়ে দাও প্রতিটি মানুষের অন্তরে। ঘুচে যাক অমানিশার করাল ছায়া। প্রতিষ্ঠিত হোক প্রেমময় আলোকবর্তিকা। হয়ে উঠুক বিশাল আর সুন্দর।
গাড়ি আরও কিছুদূর গিয়ে আচমকাই তার গতি কমিয়ে দিলো। ওরা সবাই গাড়ির সামনের কাঁচ দিয়ে দেখতে পেল, একটা পাহাড়ি ভাল্লুক দুলকি চালে রাস্তার একপাশ দিয়ে চলছে।
ড্রাইভার বললো, ‘দেখিয়ে, ভালু আ গিয়া।’
তন্ময় অস্থির হয়ে বললো,’আরে ভাই, পাশ কাটিয়ে চলো না, ভাল্লুক আবার দেখার কী হলো?’
ব্রজেশ বললো, ‘এই শোন, তুই কখনো দেখেছিস, রাস্তা দিয়ে ভাল্লুক দুলকি চালে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে?’
তন্ময় চুপসে গেল। তবুও বললো, ‘না মানে, দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাই..’
প্রফেসর বললেন, ‘আরে, যদি পাশ কাটিয়ে যাওয়া উচিৎ হতো, তাহলে ড্রাইভার তাই করতো।’
-‘রাইট স্যার। বো কভী ভি এট্যাক কর সকতা হ্যায়। বো আবভী জঙ্গল কা রাস্তা পরড় লেগা। সামনে যানা খতরনাক হো সকতী হ্যায়। ইয়ে বহৎ ডেঞ্জারাস জানবার সাব।’
সত্যিই তাই। ভাল্লুকটা বাঁদিকের পাহাড়ের বাঁকে জঙ্গলে ঢুকে গেল। এই সময়ের অপেক্ষাতেই ছিল ড্রাইভার। জোরে গাড়ি চালিয়ে দিলো।
এখন আর কোথাও কালক্ষয় নয়। গাড়ি ছুটে চললো লাচেনের উদ্দেশ্যে ।
পর্ব-১১
জীবন থেমে থাকে না, পরিবর্তন আনে। কালের নিয়মে। ফেলে আসা সময়, পিছুটান রেখে যায় স্মৃতির এলবাম।
কর্মময় ব্যস্ত জীবনে মায়ার বাঁধন। সঙ্গে আছে দায়দায়িত্ব, কর্তব্য আর অধিকার অনধিকারের বিচিত্র টানাপোড়েন।
তারই মাঝে খুঁজে ফেরে, হাতড়ে বেড়ায় মন, একটুকরো সুখের অঙ্গন। কে জানে সেই সুখের কী রঙ।
চার বন্ধুর ইদানীং বিশেষ দেখাসাক্ষাৎ হয় না। জীবন জীবিকার তাগিদে সবাই ব্যস্ত।
ফোন আসে কখনো সখনো। কথা হয়।
কথা হয় ঠিকই, তবে সেই কথায় আগের মাত্রাহীন উচ্ছ্বলার উত্তাপ নেই। মাপকষা গতানুগতিক বাঁধাছকের নিয়মমাফিক কথপোকথন ।
তারুণ্য বড়ো ক্ষণস্থায়ী।
যতক্ষণ থাকে, তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না।
হারিয়ে যাবার পর যা থাকে, তা শুধুই গল্প।
মানালি আর নীলের মাঝে একটা অন্য রকম সম্পর্ক হয়তো এসেছিল। তবে তা ভালোলাগা।
তার বেশি কিছু নয়। হয়তো।
ভালোবাসা পরিনতি খোঁজে। পরিনতি চেয়ে থাকে ভবিষ্যতের দিকে।
জীবন তো গানিতিক নিয়মের দাসত্ব করে না। সে চলে তার নিজস্বতায়। তাইতো সব জীবন একই রকম নয়।
মানালি এখন কানাডায়। ওর স্বামী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। চাকরির সূত্রে আপাতত সেখানেই সেটেল্ড। কাজেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
ব্রজেশ গায়ক হতে চেয়েছিল। হয়নি। বাবা হঠাৎই মারা যাবার পর, পারিবারিক ব্যবসা সামলাতে ব্যস্ত। একমাত্র সন্তান কি না।
তন্ময় শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখতো। এখন নিজেই কোচিং সেন্টার খুলে, সেই স্বপ্ন পুরণের চেষ্টা চালাচ্ছে।
দীপেন হারিয়ে গেল। মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল। কেউ বলে প্রেমের আঘাত, কেউ বলে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা। হতাশা।
প্রত্যাশা কিংবা নিজস্ব যোগ্যতার প্রতি প্রবল বিশ্বাস, সে-ও তো প্রেম।
নীল টিভি সিরিয়ালে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করে। আশায় বুক বেঁধে আছে, একদিন নায়ক হবে। হয়তো হবে।
সুখের স্বপ্ন উড়ান, আর সুখের ঘরে বাস কিছুতেই এককথা নয়।
রাত তখন কত জানা নেই। নীলের জানবার ইচ্ছেও নেই। নীলচে সুখ রিসর্ট ঘুমিয়ে পরেছে। কেবল বারান্দার কয়েকটি আলো, জ্বালা আছে।
জ্বালা আছে ‘নীলচে সুখ’ লেখা গ্লো-সাইনবোর্ড। বাকি সব অন্ধকার।
লনের চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল নীল।রুমার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।
-‘একি, এখানেই এইভাবে সারারাত বসে থাকবে না কি! চলো, ঘরে চলো। উঠে এসো। চলো।’
রুমা, নীলের হাত ধরে টেন , তাকে তোলবার চেষ্টা করলো। পারলো না।
নীল, রুমার হাতটা চেপে ধরলো, অনুনয়ের সুরে বললো, ‘একটু বসবে, আমার কাছে। একটু সময়.. প্লিজ.. বসবে?’
রুমা হাই তুলে হালকা গলায় বললো, ‘ছেলেটা ঘরে একা ঘুমিয়ে রয়েছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে কাউকে দেখতে না পেলে কান্নাকাটি করবে, ভয় পাবে। প্লিজ, ঘরে চলো। তোমার সব কথা শুনবো, কাল সকালে। এখন শোবে চলো।’
নীল, রুমার চোখের দিকে তাকিয়ে, ওর মন বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর সামান্য আওয়াজ করে হাসলো।
রুমা, নীলের মুখের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে সামনের চেয়ারে ধপাস করে বসেই বললো, ‘হাসলে যে, কী বোঝাতে চাইছো তুমি, আমি তোমায় এভয়েড করছি?’
– ‘তাই, বললাম কী?’
-‘ সব কথা উচ্চারণ করতে হয় না। অন্যভাবেও বুঝিয়ে দেওয়া যায়। যাক গে, কী বলবে বলো।’
নীল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘নাহ্ থাক,..’ -‘কেন! থাকবে কেন? বলোই না শুনি, নতুন করে প্রেম নিবেদন করবে নাকি? দেখো বাবা। কেন যে শুধু শুধু এইসব মাল ফাল খেতে গেলে, জানি না।’
নীল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ঘরে চলো। ছেলেটা একা আছে।’
কখনো কখনও মেনে নেওয়া কিংবা মানিয়ে নেওয়াও সুখ। এডজাস্টমেন্ট।
স্বপ্ন আর বাস্তব কিছুতেই মেলে না।
দুস্তর দূরত্ব এই দুয়ের মাঝে। দুরত্বের মাঝেই যন্ত্রণার ঘর। দিগন্তের স্পর্শ পাওয়া অবাস্তব। সে কেবলই দুরত্বের নির্মম মায়াজাল।
মানালিকে নিয়ে ও যে কল্পনার আল্পনা আঁকেনি, এমন বললে নিতান্তই তঞ্চকতা করা হবে।
মানালির মনের কথা ওর জানা নেই। তবে আন্দাজ করতে পারে। হয়তো সেও, মনে মনে, নির্জন বৃষ্টি ভেজা মায়াবী চাঁদনী রাতের পাহাড়ি পথে, তার হাতের ছোঁয়া সুখস্মৃতি, এখনো যে অমলিন।
স্মৃতি পিছুটান। তার হাত থেকে বোধকরি কারোরই রেহাই পাবার যো নেই।
মুশকিল সেখানেই, যখন অতীত, বর্তমানের ঘরে উঁকি দেয়, কিন্তু ধরা দেয় না। তার পালিয়ে বেড়াতেই সুখ। ধরা ছোঁয়ার অনেক বাইরে। আলতো পায়ে তার কেবলই নিঃশব্দ যাওয়া আসা। মনের আঙ্গিনায় আলোছায়ায় লুকোচুরি।
বাতাসে ফিসফিস করে কে যেন বলে,
‘আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো..’
মনের অতলান্ত গভীরে, নিভৃত একান্তে।
বড়ো জানতে ইচ্ছে করে।
ওগো সুখ, তোমার কী রঙ?
শেষ নাহি রে, শেষ কথা কে বলবে?
।। সমাপ্ত।।
খুবই ভালো লাগল
জানি আমার লেখা পড়বার পাঠক খুবই কম ।তবুও ভালো লেখার ইচ্ছে অদম্য ।
সব্বাই ভালো থাকুন সপরিবারে সর্বক্ষণ ।