গুপ্তধন
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
বাবা রে ছোট বোনকে নিয়ে তো দাদাদের অহংকারের শেষ নেই। তাদের বিদ্যাধরি, বড়লোক বোন তারও বাবার সম্পত্তির ভাগ চাই!
এই কৃতজ্ঞতা বোধ! দুই ভাই মিলে কী আদিখ্যেতা করতো মহারানীকে নিয়ে। বড় বৌ নীলিমাকে পূর্ণ মাত্রায় সমর্থন করে ছোট বউ রঞ্জিমা।
বুঝলে বড়দি যতই লেখাপড়া শেখো শরীরের লোভ লালসা ত্যাগ করা এত সহজ নয়। শুধু বড় বড় বুলি কপচালেই হবে, কাজের বেলায় লবডঙ্কা।
দ্যাখ ছোট, বুড়িকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দাদারা যে কত কষ্ট করে ওকে ইজ্ঞিনিয়ারিং পড়িয়েছে তা ওকে কেউ কোনদিন বুঝতে দিয়েছে। বছরে একবার বোন বাপের বাড়ি আসবে তার জন্য জেনারেটর ভাড়া করা চাই। কি না লোডশেডিং হলে বোনের কষ্ট হবে। যতসব, বেশি বেশি।
আরে বাবা সে ও তো সবার আগে এবাড়ির মেয়ে। তারপর তো কোনো কোম্পানির এ্যাডভাইজার।
কী বলবো বড়দি, আমাদের না হয় বিদ্যা বুদ্ধি কম। তা বলে বাবা দাদার অবস্থা বুঝবো না এমন অবুঝ আমরা নই।
দুই জা মিলে তাদের একমাত্র ননদের নামে ভালোই গুন কীর্তন শুরু করেছে সকাল বেলায়। আসলে এটাই সঠিক সময়। কমল ও অমলের সামনে তো কোনো কথা বলা যাবে না তাদের বোনের নামে। আর শাশুড়ি মাতা উত্তমার সামনে তো ভুলেও না।
উত্তমা দেবী স্বামী বিয়োগের পর থেকেই গুরু বাড়িতে মাসের বেশিরভাগ দিন কাটিয়ে আসেন। সংসারের মায়া ত্যাগ করতে চান তাই এই ব্যবস্থা। তবে গতকাল উনি ফোন করে জানালেন বুড়ি আসছে আমেরিকা থেকে। তাই তিনিও পরশু দিন ফিরছেন। প্রায় তিন বছর পর এবার বুড়ি আসছে। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও আসতে পারে নি সে।
উত্তমা দেবী সম্পত্তির হিসাব নিকাশ এবার পাকাপোক্ত করে নিতে চান। কারণ তাঁরও বয়স হয়েছে। আজ আছে কাল নেই। এখন ভাই ভাই ভাব আছে কালকে যে অশান্তি হবে না তার কী গ্যারেন্টি। উত্তমা দেবীর স্বামী হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাই সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করে যেতে পারেন নি। এবার সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে উত্তমা দেবীকে।
বুধবার সকাল দশটার মধ্যে কমল উত্তমা দেবীকে নিয়ে চলে আসেন গুরুদেবের আশ্রম থেকে। বাড়িতে পা রেখে থেকেই তো উত্তমা দেবীর খুঁতখুঁত করা শুরু হয়েছে। নীলিমা ও রঞ্জিমা তো রাগে ফোঁস ফাঁস করলেও একটি কথা বলার সাহস নেই। শ্বশুর মশাই-এর সব সম্পত্তির মালিক কিন্তু উত্তমা দেবীই। তাই তাকে চটানের সাহস কারোর নেই।
দুপুরে খেতে বসে উত্তমা দেবী সকলকে জানালেন, ‘শুক্রবার যখন বুড়ি আসছে তখন ভাইদেরই উচিত এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠানো’।কমল ও অমল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেই নীলিমা ও রঞ্জিমা মুখ বেঁকিয়ে বলে ‘আবার পাঁচ হাজার টাকার চুনা।’ উত্তমা দেবী বৌদের দিকে কটমট করে তাকাতেই তারা মুখ নিচু করে।
যথারীতি শুক্রবার বুড়ি (মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী)
তার একমাত্র ছেলে মেঘদূতকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলো তার বাপের বাড়ি বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে। কলকাতা থেকে এতটা রাস্তা আসতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মেঘদূত। গাড়ির আওয়াজ পাওয়া মাত্রই ছুটে আসে দুই বউ। নীলিমা মেঘদূতকে কোলে তোলার চেষ্টা করলে সে বলে ‘ডোন্ট, আমি কোলে চড়ি না’।
মেঘদূতের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলেও বুড়ি ধমকের সুরে বলে ‘বড় মামীমনি হয়। এইরকম বলে না। ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে হয়।’
রঞ্জিমা তাড়াতাড়ি করে বুড়ির হাত থেকে একটা ছোট ব্যাগ নেওয়ার চেষ্টা করে। বুড়ি হেসে বলে ‘তুমি এই হালকাটা নাও ছোট বৌদি। কেমন আছো সব তোমরা। বাড়ির ছেলে মেয়েরা কোথায় গেল?’
রঞ্জিমা বলে ‘সব টিউশনি গেছে চলে আসবে একটু পরেই।’
ইতিমধ্যে উত্তমা দেবীও পা টেনে টেনে সদর দরজায় হাজির হয়ে গেছে।
মুহুর্তের মধ্যে পুরো পরিবারটাতে কেমন একটা খুশির বাতাবরণ তৈরি হয়ে গেল। কে বলবে গতকাল পর্যন্ত বুড়ির দুই বৌদি বুড়িকে তুলোধোনা করছিল। উত্তমা দেবী বলে জামাই বাবাজীবন সঙ্গে এলে কত ভালো হতো।
বুড়ি বলে, ‘সোম আসবে মাস তিনেক পরে। আমাকে নিতে।’
এইকথা শোনা মাত্রই রঞ্জিমা বলে ওঠে, ‘সেকি গো তুমি তিনমাস থাকবে?’
বুড়ি খানিক হেসে বলে, ‘আমার বাড়ি, আমি যতদিন খুশি থাকবো। তবে তোমরা ভয় পেও না তোমাদের কোনো অসুবিধা আমি করবো না।’
নীলিমা রঞ্জিমার কথাটাকে আড়াল করে তাড়াতাড়ি বলে ‘বুড়ি তুই কিন্তু তোর ছোট বৌদির কথার অন্য মানে করিস না। জানিস তো ওর মুখ পাতলা। এবার বলতো কী টিফিন খাবি? আমি কিন্তু আজকাল নুডুলস, স্প্যাগেটি, পিৎজা সব বানাতে শিখে গেছি।’
বুড়ি বলে, ‘ আমায় আলুভাজা দিয়ে মুড়ি দাও। সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা। দাদাদেরও তো কিছু খাওয়া হয় নি। সবাই একসাথে বসে খাবো।’
আজ আর ডাইনিং টেবিলে জলখাবারের ব্যবস্থা হলো না। মেঝেতে আসন বিছিয়ে সকলে বসলো। হঠাৎ করে অমল খেয়াল করে মেঘদূত গেল কোথায়? বড় মামুর গলার আওয়াজ শুনে ছোট্ট মেঘদূত চিৎকার করে বলে ‘আমি এইখানে।’
সবাই তাকিয়ে দেখে মেঘদূত পুরানো ঢেঁকিতে চড়ে বসে আছে পরম সুখে।
টিফিন খেতে খেতে বুড়ি বলে, ‘দাদা আমি দেশের বাড়িতে একবার যেতে চাই। তার একটা ব্যবস্থা করো।’
কমল বলে, ‘খুব ভালো হবে বোন। অনেক বছর আমরা ও যায় নি। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে যাতায়াত একদম বন্ধ হয়ে গেছে। কবে যাবি ভাবছিস?’
বুড়ি বলে, ‘একটা রবিবার দেখে প্রোগ্রাম করো। ভাইপো ভাইঝি বৌদিরা সকলে মিলে যাবো।’
অমল বলে, ‘তাহলে সামনের শনিবার চল। পুরোদিন থেকে রবিবার বিকালের দিকে ফিরে আসবো।’
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর উত্তমার ঘরে বাড়ির সব সদস্যদের ডেকে পাঠায় বুড়ি। আমেরিকা থেকে সে দুই ট্রলি ব্যাগ ভর্তি জিনিস এনেছে। কত রকমের কসমেটিকস! দুই বৌ তো হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বড় বৌয়ের মেয়ে রুমি তো মা কাকীমাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘অদ্ভুত আচরণ।পিসিমনি সবার জন্যই যখন গিফট এনেছে তখন হুড়োহুড়ি করার কোনো মানে হয়।’
বড় বৌ নীলিমা মেয়ের ধমক খেয়ে চুপচাপ পাশে বসে রইলো।
বুড়ি প্রথমে বাড়ির ছোট থেকে শুরু করে জিনিস দিতে। কী যত্ন সহকারে প্যাকিং করে এনেছে। প্যাকেটগুলো হাতে দিতে দিতে বলে কেউ কিন্তু এখানে খুলবে না। রঞ্জিমা তো তার প্যাকেটখানি হাতে পেয়ে এক মিনিট সময় নষ্ট না করে নিজের ঘরে এসে তাড়াতাড়ি কাঁচি বের করে প্যাকেটটা কেটে গিফট-টা টেনে বের করে আনে। ‘ও মা! কত লিপস্টিক,কী দারুণ শেডগুলো!’
সবাই যে যার মনের মতন গিফট্ পেয়ে খুব খুশি। আসলে বুড়ি হচ্ছে এমন একটি মানুষ যে সকলের দিকে খেয়াল রাখতে পারে। শনিবার সকালে দুই খানি টাটা সুমো ভাড়া করা হয় গ্ৰামের বাড়ি যাবে বলে।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে তারা পৌঁছেও গেল।গাছ গাছালি ভরা মাটির দুতলা বাড়িটা অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে আছে ভিটে জুড়ে। টেপা কলটাতে চাপ দিতেই বেশ গদগদ করে জল পড়লো। টিব ওয়ালটা দেখে মেঘদূতের খুব মজা লাগে। সে শুধু ঘুরতে ফিরতে এসে চাপ দিয়ে জল বের করছে।
বুড়ি ধীরে ধীরে মাটির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। মাকড়সার জালগুলো একটা ছাড়ু দিয়ে সরাতে সরাতে পৌঁছায় তার ঠাকুমার ঘরটিতে। কাঠের দরজায় প্রথমে হাত বুলায়। তারপর শিকলটা খুলে ভিতরে পা রাখতেই একটা ইঁদুর ছুটে বেরিয়ে গেল। বড্ড ধুলোয় ভরা ঘরটা। বুড়ি ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুলে দিতেই একটা হাওয়া এসে বুড়ির শরীরকে স্পর্শ করে গেল।
এদিকে দুই বৌ এদিক সেদিক ঘুরে বুড়িকে খুঁজতে খুঁজতে মাটির দোতলায় উঠে আসে। কোনের দিকের ঠাকুমা শাশুড়ির ঘরটা খোলা দেখে তারা সেদিকেই পা বাড়ায়। হঠাৎ একটা ভারী কিছু পড়বার আওয়াজ শুনে প্রথমে তারা থমকে দাঁড়ায় তারপর পা টিপে টিপে এসে উঁকি মারে ঘরটার দিকে।
দেখে, মুখে ওড়নাটাকে টাইট করে বেঁধে ঠাকুমার চৌকির নিচে থেকে বেশ কসরত করে একটা লোহার বাক্স বের করে আনছে বুড়ি। সঙ্গে সঙ্গে দুই জা চোখাচোখি বার্তালাপ খানি সেরে ফেলে। এবার তারা দুজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বাক্স খানির ভিতর থেকে কী বের হয় তা দেখার জন্য।
বুড়ি হাঁটু গেঁড়ে বসে বেশ কিছুটা ঝুঁকে কি সব ঘাঁটতে থাকে। অবশেষে কিছু একটা জিনিষ পেয়ে খুব খুশি হয়ে ওঠে। মুখ থেকে তার আওয়াজ বের হয়’ ইয়াহু’। বেশ কিছু পুরাতন কাগজ পত্র একটা কাপড়ের পলিথিন ব্যাগের মধ্যে রাখা আছে খুব সযত্নে। বুড়ি পলিথিনের ব্যাগটাকে বের করে লোহার বক্সটাকে আবার যথা স্থানে ঠিলে রাখে। উঠে দক্ষিণ দিকের জানালাটা বন্ধ করে দেয়। ততক্ষণে বুড়ির দুই বৌদি পা টিপে টিপে দোতলা থেকে নেমে আসে।
তারা দুজনেই অপেক্ষা করতে থাকে কখন বুড়ি তাদেরকে এই পলিথিন ব্যাগের সম্বন্ধে বলবে। কিন্তু বুড়ি নিচে নেমে এসে পলিথিনের ব্যাগখানির কথা কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ তার ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে।
তারপর যথারীতি হই হুল্লোড় করে গ্ৰামের বাড়ি থেকে রবিবার সকলে মিলে সন্ধ্যায় বেলিয়াতোড়ে ফিরে আসে। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে নীলিমা ও রঞ্জিমা দুজনেই অমল ও কমলকে জানায় পলিথিন ব্যাগের কথাটা। যদিও দু’ভাই বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না।
এরপর মাস খানেক পর দলিল সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য উকিল বাবুকে ডেকে পাঠানো হয়। গ্ৰামের ভিটে মাটি, চাষ জমি, দুই খানা পুকুরের চোদ্দ আনা ভাগ, গোটা ত্রিশেক তালগাছ, চারটা আম গাছ, দুটো শেগুন ও মেহগনি আর বেলিয়াতোড়ে দুতলা দালান, দু’টো হার্ডওয়্যারের দোকান । আরো আছে উত্তমা দেবীর ভরি চল্লিশের সোনার গহনা। এইসব কিছু সমান তিন ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উত্তমা দেবী। দুই বৌ একটু অসন্তুষ্ট হলেও বুড়ির দুই দাদার কোনো আপত্তি নেই।
কিন্তু সকলকে চমকে দিয়ে বুড়ি বলে, ‘আমার এইসব প্রপার্টি কিছু লাগবে না। সব কিছু দাদাদেরই থাক। তবে সব কিছু মায়ের নামে জীবন সত্ত করে দেওয়া হোক। মায়ের অবর্তমানে দাদারা তার হকদার।’
বুড়ির কথা শেষ হতে না হতেই ছোট বউ রঞ্জিমা বলে ‘তুমি গ্ৰামের বাড়ি গিয়েছিলে তো গুপ্তধনের সন্ধানে তাই না। সেটা তো ঠাকুমার লোহার বাক্স থেকে পেয়েও গেছো। তাই তোমার আর এইসব অল্প মূল্যের জিনিস আর লাগবে না।’
রঞ্জিমার হঠাৎ আক্রমণে বুড়ি কিছুটা ধরাশায়ী হলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলে, ‘বাঃ, গোয়েন্দা গিরি তো ভালোই করতে পারো বৌদি।তা আমি কি জিনিষ ঠাকুমার লোহার বাক্স থেকে পেয়েছি সেটাও নিশ্চয়ই দেখেছো।’
রঞ্জিমা এবার কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘দেখেছি একটা পলিথিনের ব্যাগ তুমি বের করেছো এবং উত্তোজিত হয়ে “ইয়াহু” বলেও উঠেছিলে। আর ব্যাগখানা চুপিচুপি এনে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিলে। ঠিক বলছি তো আমি। আজ পর্যন্ত সেই ব্যাগের কথা কাউকে তুমি বলো নি।’
উপস্থিত সকলের মুখ মুহূর্তের মধ্যে বিবর্ণ হয়ে যায়। অমল, কমল চরম অস্বস্তি র মধ্যে পড়ে। উত্তমা দেবীও ভাবতে থাকেন কী জিনিস এমন যা বুড়ি নিয়ে এলো যে তাঁকেও কিছু বললো না। এইরকম অশান্তির মধ্যে উকিল বাবু আর বসে থাকতে চাইলেন না। তিনি বিদায় নিলেন।
উকিল বাবু চলে যাওয়ার পর উত্তমা দেবী বলেন, ‘বুড়ি আমাকেও কী কিছু বলা যায় না।’
বুড়ি বলে ‘সকলকেই বলা যায়। তবে আমি ঠিক সবার সামনে বিষয়টা আনতে চাই নি। তবে তোমাদের মনে যখন এতো সন্দেহ তখন তার নিরসন হওয়া দরকার। একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি।’
কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই গুপ্তধনের ব্যাগটা নিয়ে বুড়ি আসে। সবার সামনে উপুর করে ঢেলে ফেলে। বেশ কিছু কাগজ, চকলেটের প্যাকেট, ভাঙা স্কেলের টুকরো, কিছু কাঁচের চুড়ি আর একটা ফটো। উত্তমা দেবী চমকে উঠলেন ভাঙা স্কেলটা দেখে। এই স্কেল তো তিনিই ভেঙে ছিলেন বুড়ির পিঠে। কাঁচের চুড়িগুলো দেখে কমল বলে ওঠে ‘এটা তো আমি চড়কের মেলা থেকে কিনে ছিলাম। তবে তোর জন্য নয়। বড় জেঠুর মেয়ে শীলা দিদির জন্য। তুই পেলি কি করে?’
বুড়ি বলে ‘চুরি করে। এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম ও শেষ চুরি। আমি তখন ক্লাস টুয়ে পড়ি। দাদা আমার থেকে তখন শীলা দিদিকে বেশি ভালোবাসতো। সারাক্ষণ শীলা আর শীলা। শীলা দিদি কাঁচের চুড়িগুলো খুলে পুকুরে স্নান করতে গিয়েছিল আর আমি তখন এক ডজন চুড়ির মধ্যে এই চারটে চুড়ি লুকিয়ে নিয়ে নিয়েছিলাম।’
নীলিমা বলে ‘তা বলে খাওয়া চকলেটের প্যাকেটটা কেন রেখে দিয়েছিলে? ‘
‘এই ক্যাডবেরির প্যাকেটটা আমার কাছে ভীষণ ভীষণ দামী। বাবা শুধুমাত্র আমার জন্য কিনে এনেছিলেন। সেদিন প্রথম আমি উপলব্ধি করি বাবা আমাকে সবার থেকে বেশি ভালোবাসে।’
এতসব কথার মাঝে কখন মেঘদূত এসে পুরানো ফটোটা নিয়ে দেখতে বসে পড়েছে। শুধু মেঘদূত নয় বাড়ির অন্যান্য ছেলে মেয়েরাও। বড় বৌয়ের মেয়ে রুমি তো কাউকে চিনতে পারছে না। সে বলে ওঠে, ‘ও পিসিমনি, এরা কারা?’
বুড়ি ফটোটা হাতে নিয়ে বাঁ দিক থেকে শুরু করে, ‘আমার বড়মা, দিদা, মা, বড় পিসি মনি, মেজ পিসিমনি, বড় জেঠিমা, ছোট কাকিমা,শীলা দিদি, মিঠু দিদি আর আমি।
এই ফটোটা তুলে ছিল বড়ো জেঠু। স্টুডিও থেকে ফটোগ্ৰাফার এনে। আমার তো জায়গা হচ্ছিল না কিছুতেই। তখন ঠাকুমা বললো যে সে ফটো তুলবে না। তার চেয়ে বুড়িকে নেওয়া হোক। আজ হয়তো আমি মুহু মুহু ফটো তুলে বেড়াই। তবে সেদিনের সেই অনুভূতিগুলো আমার কাছে অমূল্য, জীবন্ত। আমি আমার সমস্ত নিজস্ব ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ছোট থেকেই ঠাকুমার লোহার বাক্সে রাখতাম। আর এই কারণেই আমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ও আবেগগুলো কারোর সাথে শেয়ার করতে চাই নি।
ছোট বৌদি বোঝা গেল তো আমার গুপ্তধনের রহস্য। এবার নিঃশ্চয় তোমার মনের দ্বন্দ দ্বিধা দূর হলো। আশাকরি আমার প্রাপ্ত গুপ্তধনের তোমার কোনো দরকার নেই। এগুলো আমি নিঃশ্চয় আমেরিকার নিয়ে যেতে পারবো।’