Site icon আলাপী মন

গল্প- সোয়েটার

সোয়েটার
– জয়তী মিত্র

 

 

আজ সকাল থেকে সুমনা দেবীর খুব মনটা খারাপ। মন খারাপের একমাত্র কারণ তার ছোট্ট ফুটফুটে নাতি। যে এখন কানাডায় থাকে। কোনোদিন তাকে দেখতে পাবে কিনা ভগবানই জানেন। কারণ তার একমাত্র ছেলে বিদেশে পাকাপাকি ভাবে থাকার বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। দেশে ফিরতে তার মন চায় না। বিদেশে বিলাস বহুল জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, নিজের দেশে কি আছে যে এইখানে পচে মরবে? তার এমন ব্রাইট ফিউচার এদেশে থেকে নষ্ট করবে নাকি। ছেলের বিয়ের ছবি, তাদের চার বছর পর সন্তান হবার ছবি দেখে আর ভিডিও কল করেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে সুমনা দেবীকে।
মাঝে মাঝে ছেলের জন্য খুব কাঁদেন সুমনা দেবী। ওনার স্বামী বিমল বাবু বলেন,”এখন আর কেঁদে কি হবে? খুব তো শখ ছিল ছেলে বিদেশে চাকরি করবে। তোমার শখ তো পূরণ হয়েছে, আর কি চাই। ছেলে বৌমা, আর নাতিকে ভিডিও কল করে দেখেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাও।

আজ নয় বছর হল রাজদীপ বিদেশে। এতগুলো বছরে একবারও নিজের বাড়ি আসার প্রয়োজন বোধ করেনি। বাবা, মাকেও একবার কি দেখতে ইচ্ছা করে না? এই প্রশ্নটা আজ এই কটা বছরে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে রাজদীপের বাবা-মায়ের মনে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি পেয়ে আজ বিদেশের মাটিতে নিজের স্থায়ী বাসস্থান গড়ে নিয়েছে রাজদীপ।
প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলা, পাড়ার ছোট্ট পুকুরটাতে সবাই মিলে সাঁতার কাটা, সরস্বতী পুজোতে হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে স্কুলের পূজোর তদারকি করা, প্রথম প্রেমে পড়া, কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রেমিকার সাথে সিনেমা দেখা সব এক লহমায় কি করে ভুলে গেল তার ছেলে কিছুতেই মাথাতে আসে না রাজদীপের মায়ের। বিদেশ যাবার আগেই তার ব্রেক আপ হয়ে গেছিলো ভাগ্যিস না হলে মেয়েটাও তার পথ চেয়ে বসে থাকতো। এইখানকার সব কিছুই নাকি ব্যাক ডেটেড।

বিয়েও করেছে এক বিদেশিনীকে। বৌমাকে চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য হয়নি সুমনা দেবীর। নাতি হবার আনন্দে আত্নহারা হয়ে গিয়ে ভেবেছিলেন এবার ছেলে ঠিক আসবে, তখন বৌমা আর নাতি দুই দেখা হবে। ওই যাকে বলে রথ দেখা, আর কলা বেচা। কিন্ত সে গুড়েও বালি। ছেলে এখন বিশাল প্রজেক্টের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, বৌমা আর নাতিকে দেখাতে আসা ছেলের পক্ষে সম্ভব নয়।
নাতি হবার আনন্দে দোকানে গিয়ে উল-কাঁটা কিনে একটা লাল সোয়েটার বুনতে শুরু করেছিলেন সুমনা দেবী। রাজদীপ যখন ছোট ছিল কত সোয়েটার বুনে ছেলেকে পড়াতেন। এতবছর বাদে আবার উল-কাঁটা নিয়ে বেশ কতগুলো সোয়েটার বুনে রাখেন সুমনা দেবী। লাল, নীল, গোলাপী কত রকমের রঙের সোয়েটার। নাতির নাম ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি। ঋজু, নামটা ওনার খুব পছন্দ। কিন্তু ছেলে রেখেছে জ্যাক। বিদেশে থাকে তাই বিদেশী নাম রেখেছে ছেলে। ঋজু নামটা ওই দেশে মানবে না বলে মাকে জানিয়ে ছিল। মা খুব কষ্ট পেয়ে ছিল।
তারপর আরো তিন বছর কেটে গেছে। ছেলের আর দেশে ফেরার সময় হয় নি। নাতির জন্য বানানো সোয়েটারগুলো বুকে জড়িয়ে শুধু চোখের জল ফেলেন সুমনা দেবী।

Exit mobile version