ভূত
-মানিক দাক্ষিত
১৯৭৩ সালের কথা। বেশ মনে পড়ে সেদিনটা ছিল শীতকালের অমাবস্যার রাত। সময় প্রায় রাত দশটা। হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। হাতে অগাধ সময়। আমরা ছয় বন্ধু মিলে ক্লাবঘরে খোসমেজাজে লণ্ঠনের আলোয় আড্ডা দিচ্ছি। প্রত্যন্ত অজ পাড়া গাঁ। তখন ইলেকট্রিসিটির কথা ভাবাই যায় না। উচ্চ মধ্যবিত্তদের হ্যরিকেন, গরীব মধ্যবিত্তদের লণ্ঠন আর খেটে খাওয়া গরীব মানুষদের ঘরে
লম্ফ বা কুপীই ছিল রাতের আলো। বিভিন্ন পূজো-পার্বন, উত্সব, অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলোর উত্স ছিল হ্যাজাক বা ডে-লাইট।
পাড়া গাঁয়ের দশটার রাত মানেই গভীর রাত।শুনশান। বাইরেটা যেন নিকষ কালো অন্ধকার চাদরে ঢাকা। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে রাতটাকে কেমন যেন এক অদ্ভূত রহস্যময়ী মায়াবী নি:স্তব্ধ আর একাকী করে তুলেছে। আড্ডা দিতে দিতে হঠাত্ তর্ক বেধে যায় কালুর সাথে বিশুর। তর্কটা বাধে ভূত নিয়ে। কালু বলে, ভূত বলে কোনো জিনিস আছে–আমি বিশ্বাসই করি না।
বিশু গলা ফাটিয়ে চীত্কার করে–আলবত্ ভূত আছে। আমি নিজের চোখে ভূত দেখেছি। আমাদের
দিকে তাকায়–কিরে তোরা ভূত বিশ্বাস করিস?
আমার আবার ভূতের ভীষণ ভয়। আমরা সবাই মিলে বিশুর মতকেই সমর্থন করি। কালুর
মুখে অবজ্ঞার হাসি—একমাত্র গাঁজাখোর আর যারা ভীতুর ডিম, তারাই বিশ্বাস করে ভূতকে।
বিশু তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে—জানিস, অমাবস্যার রাতে ব্রহ্মদত্যি,ভূত, পেত্নি, শাঁকচুন্নী- দের দেখা মেলে!
কালুর গলায় আত্মপ্রত্যয়ের সুর—“বেশ তো, আজ তো অমাবস্যা! দেখা না তোদের ভূত প্রেত
ব্রহ্মদত্যিকে। আমি তৈরী। বল কোথায় যেতে হবে। আমি যেতে রাজী।”
বিশু চীত্কারে গলা ফাটায়—“সোনাডাঙার মাঠে ঘোলগোড়ে কুকুরবাঁদি পুকুরের পাড়ে যে বুড়ো
বটগাছটা আছে, তার তলায় যেতে পারবি?”
কালু দৃঢতার সাথে উত্তর দেয়—পারবো।
আমরা প্রমাদ গুনি। বুকটা কেঁপে ওঠে। বলে কি কালু! এ-তল্লাটের সবাই জানে ঘোলগোড়ে
কুকুরবাঁদি কি ভয়ংকর জায়গা! নাম শুনলেই ভয়ে প্রাণ আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। সন্ধ্যের পর
ঐ পথ মাড়াতে কেউ সাহস পায় না। কত যে মানুষ ঐ বুড়ো বটগাছটায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, তার ইয়ত্ত্বা নাই। কয়েকমাস আগেও মেটে পাড়ার নিধিরাম দিনদুপুরে গলায় দড়ি দিয়ে মরলো। জনশ্রুতি আছে–একবার যদি কেউ মরার কথা উচ্চারণ করে, তার আর রক্ষে নাই! ঐ বুড়ো বটগাছ তাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে। শেষ পরিণতি–গলায় দড়ি দিয়ে তার মৃত্যু। বুকটা আমার কেঁপে ওঠে। বারণ করি কালুকে।
—অত সাহস ভাল নয় কালু। কোথা দিয়ে কি অঘটন ঘটে যাবে, বলা যায় না। সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করার কি দরকার!
কালু ঝেঁঝিয়ে ওঠে— থামতো! ভীতুর ডিম কোথাকার!
বিশু চোখ টিপে বিষয়টা চেপে যেতে বলে। আমি চুপ করে যাই।
কালু হাত বাড়ায়—বাজী রাখ, যদি যেতে পারি, কি দিবি?
বিশু সপাটে কালুর হাতে হাত লাগিয়ে বলে– একটা গোটা খাসি। আর যদি না পারিস? মরে
যাস?
—মরে গেলে তো কথাই নাই। গেলাম। যদি না পারি, হেরে যাই, তাহলে আমিও দেবো গোটা
খাসি।
তর্কটা জমে উঠল। বিশু বলে–তুই যে সত্যিই রাতের অন্ধকারে ওখানে যাবি, আমরা বুঝবো
কি করে?
—বিশ্বাস!
“বিশ্বাসে কাজ নাই ভাই” বলে বিশু ঘর থেকে বেরিয়ে একছুটে বাড়ী থেকে মস্ত বড় একটা
লোহার গজাল আর হাতুড়ী এনে কালুর হাতে ধরায়, -এই গজালটা তুই বটগাছের গোড়ায় পুঁতে
আসতে পারলেই জানবো তুই গেছিস।
–কুছ পরোয়া নেহি–বলে শীতের চাদরটাকে ভাল করে গায়ে জড়িয়ে কালু অন্ধকারে বেরিয়ে
যায়।
ভয়ে আমাদের হাত-পা পেটের ভেতর সেঁদিয়ে যাবার যোগাড়। মুখে কথা নাই। বিশুর দিকে
তাকাতেই দেখি বিশুর চোখে-মুখে দুষ্টামির হাসি। বলে–“বেচারী একা। সতর্ক থাকা দরকার।
জায়গাটা ভাল নয়। তোরা টর্চ নিয়ে পিছন পিছন আয়। আমি চললাম” —বলে এক নিমেষে
এই কনকনে শীতের রাতে শরীর থেকে জামা- প্যাণ্ট খুলে বগলে ভরে একেবারে উদোম গায়ে
দে ছুট।
দেরী না করে আমরা চারজন পাঁচ ব্যাটারির দুটো টর্চ নিয়ে রওনা দিলাম সোনাডাঙার দিকে।
আমরা চারজন, সাথে দুটো পাঁচ ব্যাটারির টর্চ– তবুও ভয়! কি হয় কি হয়! গা ছম ছম করছে।
বটগাছটার কাছাকাছি আসতেই কানে ভেসে এল একটা বিশ্রী গোঙানির শব্দ। টর্চ জ্বালতেই
আমরা হতভম্ব। ভয়ে শিয়রে উঠলাম। বিধ্বস্ত চেহারায় কালু বটগাছের তলায় পড়ে গোঙাচ্ছে।
সাড়া শব্দ নাই। দু-চোয়াল বেয়ে বইছে সমুদ্রের ফেণার মত গ্যাঁজলা। শীতের চাদরটা গায়ে নাই, বটগাছের গোড়ার কিছুটা উপরে আটকানো। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি বিশু হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির। পরনে শার্ট-প্যাণ্ট।
বললাম–কোথায় গিয়েছিলি আর এখন কোথা থেকে আসলি?
কোন কথার উত্তর না দিয়ে বিশু দৌড়ে গিয়ে কালুর শীতের চাদরটাকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে
নেয় গাছ থেকে। তারপর পুকুর থেকে দুহাতের আঁজলা করে জল এনে কালুর চোখে মুখে
ছেটায়। গোঙানি বন্ধ হয়। কালু চোখ মেলে তাকায়। চোখে মুখে তার বিশাল আতঙ্কের
ছায়া।
জিগ্যেস করি, কি হল?
আতঙ্কে আমায় চেপে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। বলে, আগে আমায় এখান
থেকে তোরা নিয়ে চল। বাড়ী গিয়ে সব বলবো।
বাড়ী এসে চোখে মুখে জল দিয়ে একটু ধাতস্থ হলে কালু বলতে আরম্ভ করলো–“তোদের কথা না
শুনে এঁড়েমি করে মস্ত বড় ভুল করেছি রে আমি। সত্যিই জায়গাটা বড় ভয়ংকর! ভূত, পেত্নী ব্রেহ্ম-
দত্যির এক্কেবারে আড়ত্। কেবল ওখানে ছোটাছুটি আর দাপাদাপির শব্দ। প্রাণ একেবারে শুকিয়ে যায়।
ভাগ্যিস তোরা আমার পিছু পিছু গিয়েছিলি, তাই এ-যাত্রায় বেঁচে গেলাম। নইলে মরে কাঠ হয়ে পড়ে
থাকতাম।”
বিশু আমাদের দিকে ঈষত্ বাঁকা চোখে তাকিয়ে কালুকে জিগ্যেস করে, “কি দেখলি, সেটা বল!”
কাঁপা কাঁপা গলায় কালু বলে, “বলতে পারবো না, ভয়ংকর দৃশ্য। ভাবলে এখনও গা কাঁটা দিয়ে ওঠে।
তোর দেয়া লম্বা গজালটা বুড়ো বটগাছটায় পুঁতেছি কি–দেখি ছোটো খাটো একটা তালগাছের মতো
একটা ন্যাংটা ভূত বটগাছের উপর থেকে আমার
সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আমি ভয়ে দৌড়ে পালাতে যাবো–দেখি কে যেন আমার চাদরটাকে
টেনে ধরেছে, কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না। ভিরমি খেয়ে ওখানেই পড়ে গেলাম। তারপর আর কিছু
আমার মনে নাই। সেটা তোরা বলতে পারবি।”
বিশু গম্ভীর কণ্ঠে জিগ্যেস করে, “এবার বল, ভূত আছে কি নাই ?”
নিজের দুই কান ধরে তড়িত্ গতিতে কালু উত্তর দেয়, রাম রাম রাম। সে আবার বলতে, ওনারা
আছেন। অবিশ্বাসের কোনো জায়গা নাই। নিজের চোখে আজ আমি ভূত দেখলাম।”
অপারেশন সাকসেসফুল! বিশুর চোখে-মুখে যুদ্ধ জয়ের এক পরিতৃপ্ত হাসি।
সেদিন ছোটোখাটো তালগাছের মতো যে একটা ন্যাংটা ভূত কালুর সামনে হুমড়ী খেয়ে পড়েছিল, আসলে সেটা ভূতও নয়, পেত্নীও নয়, সেটা ছিল ডানপিটে ডাকাবুকো দুষ্টু পাজী অদম্য সাহসী ঐ যুবক বিশু। শীতের রাতে উদোম গায়ে অকুস্থলে কালু পৌঁছানোর আগেই সে ঝড়ের
গতিতে ওখানে পৌঁছে বটগাছের উপরে বসেছিল। কালু গজাল পোঁতার সময় হনুমানের মতো ওর
সামনে লাফিয়ে পড়েছিলো। আর কালুর শীতের চাদর কেউ টেনে ধরেনি।
কালু নিজের অজান্তেই চাদরের একপ্রান্ত নিজেই গজালের সাথে পুঁতে ফেলেছিলো।