রম্য- ভন্ড ভন্ডুল

ভন্ড ভন্ডুল
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

 

দেবতা বললেন, বৎস, তোমার সাধনায় আমি তৃপ্ত। বলো, কী বর চাও?
সাধক নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন …. প্রভূ , আমি ট্রাডিশন ভাঙতে চাই ।
দেবতা কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গিয়ে বললেন – মানে ?
সাধক স্মার্টলি বললেন , দেখুন প্রভূ , ওসব বর ফর অনেক পুরনো রদ্দি ব্যাপার । অনেকেই আপনার থেকে ঐসব নিয়েছে টিয়েছে , কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও বরই টেঁকেনি। শুধু তাই নয় , যাকে বর দিয়েছেন সেও গল্প হয়ে গেছে। দেখুন প্রভূ , মুখের ওপর বলছি , রাগ করবেন না প্লিজ , আমার অভিজ্ঞতা বলছে আপনারা বহুৎ ধড়িবাজ ।
বরের ভেতর কায়দা করে নানাভাবে নানান ফন্দিফিকির , ফাঁকফোকর ঢুকিয়ে রাখেন। গোড়ায় গোড়ায় কিচ্ছুটি বোঝা যায় না । বেশ ভালোই চলে । কিন্তু আল্টিমেটলি , নিটমুনাফা জিরো এবং নির্ঘাত অপঘাত মৃত্যু। তাই , আমি মনস্থির করেছি , কিচ্ছুটি নেবো না। উল্টে আপনাকে দেবো।
দেবতা কিঞ্চিৎ হাঁ হয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন, দেবে ? মানে আমাকে দেবে ? খুবই ভালো কথা।
কিন্তুু প্রশ্ন হচ্ছে , কী দেবে ? দেবার মতো কী আছে তোমার ? তুমি তো কপর্দকহীন অপদার্থ ভবঘুরে ,না চাল , না চুলো। দেহ আর ধুকপুকে প্রাণ টুকু ছাড়া তোমার আর আছে কী , দেবার মতো ? শোনো হে , তোমাকে আগেই জানিয়ে রাখছি । ঐদুটোর একটাও কিন্তু আমি নেব না। কেননা ওসবের দায়িত্ব যমরাজের। তুমি বসেবসে তাকেই ডাকো , আমি চললাম ।
সাধক পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললেন , তা বললে চলে প্রভূ। এতো সাধনা টাধনা করে , আপনার আসন টলিয়ে মর্ত্যে নিয়ে এলুম , সেকি শুধুমাত্র আপনার সুন্দরপনা মুখটা দেখেই ছেড়ে দেবার জন্যে?
দেবতা ত্রিশূল ঠুকে দাঁড়িয়ে গেলেন । আস্পর্ধা কম নয়। মুখে যা আসে বলে । এইসময় একটা মোক্ষম অভিসম্পাত ঝেড়ে দিলে কেমন হয়? নাহঃ থাক , আর একটু দেখা যাক , লোকটা কতদূর যেতে পারে , দেখা নিতান্তই প্রয়োজন।

আপনারা বড্ড ভোগী হয়ে উঠেছেন । অবিশ্যি , সেটা আপনাদের দোষ নয়। এই মর্ত্যবাসীরাই নানান দামী দামী উপঢৌকন দিয়ে দিয়ে আপনাদের স্বভাব খারাপ করে দিয়েছে। নইলে আগের কালে তো শুনেছি , একটু আধটু ভক্তি টক্তি পেলেই খুশী হয়ে যেতেন । কী, ঠিক কিনা?
যাইহোক শুনুন প্রভূ, আমি আমার যত পাপপুণ্য , ভালমন্দ , ন্যায় অন্যায় , সুখদুঃখ , সব সবকিছুই আপনাকে নিবেদন করলাম।
আপনি খুশী মনে আমার এই দান গ্রহণ করে আমাকে কৃতার্থ করুন প্রভূ ।
দেবতা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ , ভাবগতিক বোঝবার চেষ্টা করলেন  তারপর বললেন ,
এই প্ল্যান , আগে থেকেই ভেঁজে রেখেছ , সেটা বেশ বুঝতে পেরেছি । কিন্তু বাছাধন , এইসব উজবুক মার্কা পরিকল্পনা আমাদের কাছে নস্যি । যুগ যুগ ধরে তোমাদের দেখা না দিয়ে, মেলামেশা না করে , কোনও রকম পাবলিসিটি ছাড়াই তোমাদের বশে রেখেছি , সেকি মনেকরো এমনি এমনি ? যাক, সেসব তুমি বুঝবে না। অবিশ্যি যত না বুঝবে , ততই আমাদের পক্ষে মঙ্গল ।
যতই জানবে , ততই অমান্যি করবে । ঠিক আছে , তুমি যা দিতে চাইছো , সবই নেবো। ভক্তের মনোবাঞ্ছা অপূর্ণ রাখবো না। কিন্তু , ওগুলোর সঙ্গে আরও কিছু নেবো।
সাধক , আমতা আমতা করে ঢোঁক গিলে বললেন, আর কী? আরতো কিছুই নেই । আপনি অন্তর্যামী। আপনার কাছে তো কিছুই গোপন নেই প্রভূ।
প্রভূ হেসে বললেন , সেই জন্যেই তো বলছি! দে.. তোর সবটুকু দে. ..  ষোলো আনা জ্ঞান অজ্ঞান , বুদ্ধি দুর্বুদ্ধি , চাতুরী বোকামি , শঠতা সত্যতা , সর্বোপরি তোর মুখোশ , সবই দিয়ে দিতে হবে, পারবি?
সাধক ফ্যাকাসে মুখে বললেন – যাঃ চ্চলে! সবই যদি যায়, তাহলে থাকে কী? খাবো কীভাবে ?
দেবতা মুচকি হেসে বললেন , কেন , মুন্ডু দিয়ে খাবি। যেমন খাস। ওটা তো চাইনি । সেটা তো রইল যথাস্থানে।
সাধক , চোখ মুখ কুঁচকে হাঁ হাঁ করে উঠলো , না না প্রভূ, সে কথা নয়। বলি , খাওয়ার ব্যবস্থা হবে কীভাবে ?
দেবতা ত্রিশূল ঠুকে এক কদম এগিয়ে গিয়ে , চোখ নাচিয়ে বললেন, কী ব্যাপার বলতো? তোর আসল মতলব খানা কী?
প্রভূ, আপনার সঙ্গে জলের বোতল আছে ? বড্ড জল তেষ্টা পাচ্ছে ।
দেবতা , তার হাতে ধরা কমন্ডলু বাগিয়ে ধরে বললেন, নে,, পান কর। গলা তো শুকোবেই। পেটে পেটে বজ্জাতি বোঝাই।
স্বর্গের জল পান করে বেশ ঝরঝরে হয়ে সাধক হাত জোড় করে হাঁটু মুড়ে বসে কাঁদোকাঁদো গলায় গদগদ হয়ে বললেন , প্রভূ সবই তো বুঝতে পারছেন , কেন মিছিমিছি এই অধমের সঙ্গে লীলা করছেন প্রভূ।
দেবতা কিঞ্চিৎ নরম স্বরে বললেন , আচ্ছা বেশ , যা বলার আছে নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে বল। আমি কিচ্ছুটি মনে করবোনা।
সাধকের মুখে চওড়া হাসি। বললেন , এইতো , এইনা হলে দেবতা। আহা! কী উদার , কী মহান ,
কী প্রেম… 
হয়েছে হয়েছে , ভেজাল মাখন মাখানোর দরকার নেই । মতলব খানা খুলে বল দেখি।
তাহলে বলি, আপনি যেগুলো চাইলেন , তার মধ্যে কয়েকটি ছেড়ে দিন প্রভূ। কেননা ঐগুলা ভাঙিয়েই তো আমি ফুলেফেঁপে জয়ঢাক হয়ে উঠবো কিনা… 
কোন গুলো ?
আপনি সব নিয়ে যান। শুধু ঐ , দুর্বুদ্ধি , চাতুরী , শঠতা আর মুখোশ খানি আমার জন্যে ছেড়ে দিন প্রভূ।
আর ছোট্ট একটি প্রার্থনা আছে প্রভূ।
আবার কী ?
মানে , এইযে আমার সবকিছু , মানে ঐগুলা বাদ দিয়ে আরকি , আপনার পায়ে নিবেদন করলুম , এই ব্যাপারটা আপনি একটু কায়দা করে লোকসমাজে যদি প্রচার করে দ্যান প্রভূ , বড়ই কৃতার্থ হই প্রভূ । মানে ,আপনাকে ব্র‍্যান্ডএম্বাসাডর বানিয়ে এগিয়ে যেতে চাই প্রভূ।
দেবতা , ত্রিশূল দিয়ে বগল চুলকে , চোখ ছানাবড়া করে বললেন ,ব্র‍্যান্ড এম্বাসাডর , সেটা কী?
সাধক, মাছি তাড়ানো ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে বললেন, কিচ্ছু নয়। শুধু আমার যাবতীয় কাজে আপনার নাম আর ছবি ব্যবহার করবো। তাতে আপনারও প্রচার বাড়বে আর আমারও কেল্লাফতে হবে ।
জনমানসে আপনার নাম , কী বলবো প্রভূ , এখনো একেবারে ম্যাজিকের মতো কাজ করে । দিব্যি করে বলছি প্রভূ , আপনার নামের তোড়ে , যদি একবার মন্ত্রী হয়ে বসতে পারি , আপনার নামে , পেল্লাই মন্দির , রাস্তা ঘাট এমনকি রেলস্টেশন পর্যন্ত বানিয়ে দেবো।
ইস্কুল কলেজ হাসপাতালও বানানো যেতে পারতো। কিন্তু ওসব করা আখেরে ক্ষতিই হবে। ঐ-যে আপনি বললেন , সেইটাই মোক্ষম যুক্তির কথা । যত জানবে , ততই কম মানবে ।যদি মান্যতাই না পেলুম , মন্ত্রী হয়ে কী লাভ ? আপনিই বলুন প্রভূ….

দেবতা বললেন,  ওরে শয়তান , তাই বলি বেটা মতলব বাজ , হঠাৎ কোথাও কিছু নেই , সটান গুহায় ঢুকে ঝপ করে বসে ধ্যান শুরু হয়ে গেল ? সাধনা ? ব্যাটা ভন্ড।
আমার নাম ভাঙিয়ে , ঢং করে সঙ সেজে সাধাসিধে ভালো মানুষ গুলোকে বোকা বানিয়ে তাদের সর্বনাশ করবি ? নিজের আখের গুছোবার ধান্দা করবি ? তুই কী ভেবেছিস , আমি তোকে এই জঘন্যতম কাজে সহায়তা করবো ? মুর্খ । তোর মতো শয়তান গুলোর জন্যেই আমার সুন্দর পৃথিবীটা নোংরায় ভরে গেল।
তুই জাহান্নামে যা। আমি চললুম । শোন , মানুষের জন্যে ভালো কাজ কর। তাদের পাশে অন্ধের যষ্টির মতো দাঁড়া। তাহলেই দেখবি , তুই মনে মনে যা চাইছিস , তারচেয়ে বেশী পেয়ে গেছিস।
ভুলে যাস কেন , সেই অমোঘ বাণী …. 

প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে
যবে মিলি পরস্পরে ,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন
আমাদেরই কুঁড়েঘরে ।

 

Loading

One thought on “রম্য- ভন্ড ভন্ডুল

  1. বেশ সুন্দর, ভালো লাগলো।

Leave A Comment