এক চিলতে ঘর
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
কন্যাকুমারীতে দক্ষিণ ভারতের শেষ প্রান্তে তিন সাগর বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর আর আরবসাগর মিলিত হয়েছে কিন্তু তাদের মিলনস্থলে তাদের জলের রঙের প্রভেদ বুঝিয়ে দেয় তারা একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র। সেইরকমই নীলিমা, মিনতি ও বিষ্ণুপ্রিয়া মিলিত হয়েছে মায়াপুর ইসকন মন্দিরে।
তারা তিনজনই তিনটি পৃথক জীবনযাত্রার মহিলা। কলেজে ও তারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা অনার্সের ছাত্রী ছিল। তবুও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল অটুট।
কিন্তু কলেজ ছাড়ার পরে যে যার কর্মজীবনে, সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করায় সেই বন্ধুত্বের ভাটা পড়ে গিয়েছিল। এবার দীপাবলিতে হঠাৎই সেই বন্ধুত্বের জোয়ার এনে দেয় ফেসবুক।
নীলিমা মিনতিকে বলে, কি রে ভেবেছিলি সংসার স্বামী, সন্তান, নাতি সব নিয়ে ব্যস্ত থাকবি আর আমাদেরকে ভুলে যাবি। কিন্তু দেখ ফেসবুকের হাত ধরে আবার আমরা কেমন এক হলাম।
মিনতিও বলে, সত্যিরে বিয়াল্লিশটা বছর পর আবার আমাদের তিন বন্ধুর দেখা। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। ভেবেছিলাম আমাদের বন্ধুত্ব স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে বোধহয়। সত্যি নীলিমা তোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
নীলিমা বলে ওঠে, দেখবি টেনে এক চড় কসাবো। কি মনে করেছিস বয়স হয়ে গেছে বলে আমি আর আগের মত মারকুটে নেই।
নীলিমার কথা শুনে মিনতি আর বিষ্ণুপ্রিয়া তো হো হো করে হেসে ওঠে। কলেজে পড়ার সময় নীলিমাকে কলেজের ছেলেরাও ভয় পেত। কথায় কথায় হাত চালানোটা ওর স্বভাব।
বিষ্ণুপ্রিয়া একটা রেকাবিতে তিন কাপ চা আর কিছু ড্রাইভ ফুডস নিয়ে হাজির হল। হাসিমুখে বলে দুপুরে কটার সময় লাঞ্চ করবি? নীলিমা ও মিনতি জানায় আমাদের কোনো তাড়া নেই যখন সবাই করবে তখন আমরা করবো।
বিষ্ণুপ্রিয়া ওদের সাথে বসে চা খেতে খেতে বলে, আমরা বুড়ি হয়ে গেলাম বল। কলেজে যখন পড়তাম তখন মিনতির কি চুল ছিল। একখানা লম্বা বেণী সবাইকে মুগ্ধ করত।
মিনতি বলে, সত্যি রে সেইসব দিনগুলো হারিয়ে গেছে আসলে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
নীলিমা কিছুটা ঝাঁজিয়ে বলে মিনতিকে, ম্যাডাম আপনি তো বিন্দাস আছেন। গার্লস স্কুলের কড়া দিদিমণি। অধ্যাপক স্বামী, ডাক্তার ছেলে ও বৌমা, মেয়ে -জামাই নাতি -নাতনি সব নিয়ে একদম পরিপূর্ণ পরিবার।
মিনতি বলে, ওরে সংসারকে পরিপূর্ণ করতে গিয়ে আমি যে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। সেই পঁচিশ বছর থেকে কর্মজীবন আর সংসার জীবন এর বাইরে আর কিছু জানলাম না। স্বামী সন্তান শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, জা নিয়ে একেবারে হুলুস্থুল কাণ্ড।
আমার হাতে সকালের ব্ল্যাক টি ছাড়া কর্তার পটি হবে না। চেম্বারে বেরোবার আগে ছেলে বৌমাকে টিফিন বক্সটা সাজিয়ে রোজ আমাকেই দিতে হবে। রাধুনী মাসি কি রান্না করবে রোজদিন আমাকেই বলতে হবে।
আর এতসব করার পরেও শুনতে হয় এখন তো অবসর সময় তুমি একটু গৃহকর্মের দিকে মন দাও। ভাবতে পারছিস যে মানুষটা যৌবন কাল থেকে সংসার করছে তাকে বার্ধক্যে এসে সংসারে মন দেওয়ার কথা বলছে সেইসব মানুষ যারা এক গ্লাস জল পর্যন্ত গড়িয়ে খেতে চায় না।
নীলিমা তুই কিন্তু অনেক ভালো আছিস। নিজে চাকরি করেছিস, পেনশন পাচ্ছিস এখন। কারোর কোনো দায়-দায়িত্ব মাথায় নেওয়ার দরকার নেই।পয়সা ফেলো তামাশা দেখো। ভাই ভাইয়ের বউরা মাথায় করে রেখেছে। তোর মত একটা সোনার ডিম পারা হাঁসকে তারা তো যত্নআত্তি করবেই।
নীলিমা তখন হেসে বলে, দূর থেকে সরষে খেত ঘনই লাগে। জানিস যখন ভাইয়ের বউয়ের বিরক্তিকর মুখটা দেখি তখন খুব কষ্ট হয়। এই যেমন ধর বাড়িসুদ্ধ লোক নেমন্তন্ন বাড়ি খেতে যাচ্ছে। আমার আবার ভোজবাড়ি খাবার সহ্য হয় না। সুতরাং আমার জন্য কিছু না কিছু রান্না করতেই হবে ভাইয়ের বউকে। আর তখনই তার মুখ হয়ে যায় ভার।
আর যদি আমি বলি আমি নিজে করে নেব তাহলে তার মনে হয় আমি তাকে পরে খোঁটা দেব। সুতরাং শত ব্যস্ততার মধ্যেও শত অনিচ্ছার মধ্যেও আমার জন্য রান্না তাকে করতে হয় আর সেই রান্না আমাকে খেয়ে হজম করতে হয়।
বিশ্বাস কর তখন মনে হয় এটা যদি আমার নিজের সংসার হতো তাহলে আমি স্বচ্ছন্দে রান্না ঘরে ঢুকতে পারতাম নিজের ইচ্ছামত কিছু একটা বানিয়ে নিতে পারতাম। এই বুড়ি বয়সে এসে বুঝি রে নিজের সংসারটা কত দরকার ছিল।
নীলিমা ও মিনতির কথোপকথন খুব মন দিয়ে শুনছিল বিষ্ণুপ্রিয়া যদিও তার তো কিছু বলার নেই। সে তো এই পার্থিব সংসারের বাইরে বিরাজ করে।
সে হাসিমুখে বলে তোরা তোদের সুখ দুঃখের গল্প কর আমি একটু মন্দির থেকে আসছি। প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেল বিষ্ণুপ্রিয়া ওদের দুজনকে ছেড়ে মন্দিরে এসেছে সেখানে ঠাকুরের বাসনগুলো যত্ন করে মেজে ধুয়ে তুলে রাখছে। ঠাকুর ঘরের আরো বাকি সব জিনিসপত্র সব গোছগাছ করে কৃষ্ণের পদতলে চুপচাপ বসে রইলো।
কিছু চাওয়ার নেই, কিছু পাওয়ার নেই শুধু আছে ভক্তি, প্রেম ও ভালোবাসা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি।
বারোটা বাজছে। খাবার সময় হয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়া নীলিমা ও মিনতিকে ডেকে আনে খাবার কক্ষে। অত্যন্ত সাধারণ নিরামিষ খাবার-দাবার পরম তৃপ্তি করে খেলো নীলিমা ও মিনতি দুজনই।
নীলিমা বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলে, বিষ্ণু আমাদের তো কত দুঃখ, কত অভিমান। তোর মনে কি এসব কিছুই নেই?
বিষ্ণুপ্রিয়া বলে, ওইগুলো বিসর্জন দিয়েছি বলেই তো আজ প্রভু চরণে ঠাঁই পেয়েছি রে। তোদের জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার গল্পগুলো শুনতে আমার বেশ ভালই লাগছিল। ভাবছিলাম তোদের দুজনের দু’টো জীবনের যে কোনো একটাকে বেছে নিতে পারতাম তাহলে হয়তো আমিও এই সব গল্পই তোদেরকে করতাম।
কিন্তু আমিও যে জীবন বেছে নিয়েছি সেখানে জাগতিক হিসাব-নিকাশ, দেনা-পাওনা কোনো কিছুই পরোয়া করে না। সেখানে শুধু আছে ভালোবাসা প্রেম।
আমার কথাগুলো তোরা ঠিক বুঝতে পারবি না রে কারণ ঈশ্বরের চরণে সমর্পণ করা এত সহজ ব্যাপার নয়। যাগ্গে, তোরা কদিন থাকছিস তো?
এমন সময় মিনতির ফোনটা বেজে উঠলো। রাঁধুনী মাসি ওপাশ থেকে বলে, দিদিমণি আমি কিন্তু রাতে আসতে পারবো না এই বিকেল বিকালে রুটি করে চলে যাব বলে দিও। আবার কিছুক্ষণ বাদে লন্ড্রীবালা ফোন করে, দিদিমণি আপনি কি বাড়িতে নেই কখন থেকে ডোর বেল বাজাচ্ছি কেউ খোলে না। আজকে কাপড় জামা দেওয়ার নেই?এরপর দুধবালা, ফুলবালা। একের পর এক ফোন।কী আশ্চর্য ব্যাপার। একটা দিন ঘরটাকে সামাল দেওয়ার লোক নেই। এই বলে বিরক্ত হয়ে ফোনটা সুইজ অফ করে দিল মিনতি।
সন্ধ্যা বেলায় মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি, ভজন এইসব শুনে মিনতি ও নীলিমার মন খানি প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। সকল ভক্তবৃন্দের সাথে তারাও কৃষ্ণ নামে মাতোয়ারা হয়ে যায়। প্রায় ঘন্টা চারেক ফোনটা সুইচ অফ ছিল। রুমে ফিরে এসে ফোনটা সুইচ অন করেই দেখে শ খানেক মিসড কল। মিনতির পতিদেবতা, ছেলে, বৌমা, মেয়ে,জামাই, নাতি সবাই নিজের নিজের ফোন থেকে ফোন করেছে।
মিনতি নীলিমাকে বলে, এদের কান্ড দেখ। দেখছিস যখন আমি ফোন তুলছি না তখন এতো বার ফোন করার কোন মানে হয়। নীলিমা বলে, ওরে তুই তো ভাগ্যবতী যে এই রকম একটা ভালোবাসার সংসার গড়তে পেরেছিস।
আর আমাকে দেখ, কখন এসেছি কেউ একটা ফোন করেছে? আসলে সবাই নিজের নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সেখানে আমিই বাইরের লোক।আগাছা।
বিষ্ণুপ্রিয়া রাতে শুতে এলে নীলিমা বলে, আমি কি তোদের আশ্রমে পাকাপাকি ভাবে থেকে যেতে পারি?
বিষ্ণুপ্রিয়া বলে, কিন্তু তোর পরিবার?
নীলিমা বলে, ওরাও বেঁচে যাবে। প্রতিমাসে আমি পেনশনের কিছু টাকা পাঠিয়ে দেবো। তাহলেই হবে।
আসলে আজকে আমার মনে হলো বেঁচে থাকতে গেলে নিজের হাতে তৈরী একটা পরিবার থাকা দরকার না হলে প্রভুর পরিবারে থাকা দরকার। সম্মান আর ভালোবাসা দুটোই যে বড় দরকার।