বিজয়া
-মানিক দাক্ষিত
দশমীর পূজো সেরে বামুনঠাকুর ঘট নাড়াতেই ঠাকুর-তলায় মায়ের বিসর্জনের বাজনা বেজে ওঠে। বাঙালীর ঘরে ঘরে বিষাদের ছায়া নামলেও আজ বসু পরিবারে নেমেছে কান্নার রোল। হারিয়ে যাওয়ার এক মহা-আশঙ্কা। পরিবারের সকলের চোখে মুখে এক আতঙ্কের ছায়া। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন- সকল চেষ্টা কি শেষ পর্যন্ত বিফলে যাবে! কান পাতলে শোনা যাচ্ছে পরিবারের প্রতিটি ঘরের কোণায় কোণায় একটা চাপা ফোঁপানি কান্না।
দাদু, ঠাকুমা, বাবা, মা আর একমাত্র মেয়ে বিজয়াকে নিয়ে এই বসু পরিবার। পরিবারটি একসময় ছিল অত্যন্ত সুখী পরিবার। কিন্তু যেদিন জানলো মেয়ের কঠিন অসুখ-মেয়ে আক্রান্ত এক মারণ রোগে, সেদিন থেকে চলে গেল তাদের হাসি খুশী আর আনন্দ। মনের মধ্যে বাসা বাঁধলো চরম উত্কন্ঠা আর হারিয়ে যাবার তীব্র ভয়। গত পাঁচটি বছর চলছে মেয়েকে আপ্রাণ বাঁচিয়ে রাখার, সুস্থ করে তোলার এক কঠিন সংগ্রাম।
একুশ বছরের সুন্দরী যুবতী বিজয়া। কি অপরূপ রূপই না ছিল তার! একেবারে পটে আঁকা লক্ষ্মী।
এখন ক্রমশ: তার শরীর জৌলুস হারাচ্ছে, চুলের গোড়া আলগা হচ্ছে, নামছে মন্থরগতিতে যৌবনে
খরা।
বিজয়া লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া। সোজা কথায় ব্লাড ক্যানসার। চিকিৎসকদের অভিমত- শ্বেত রক্তকণিকাগুলি যেভাবে বিকৃত এবং অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে রোগীর পরমায়ু বড়জোর পাঁচটি বছর। আজই হচ্ছে পাঁচ বছরের সেই অন্তিম দিন।
কেশববাবু মেয়ের চিকিত্সার কোনো ত্রুটি রাখেননি। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কেমোথেরাপী, সাথে
সাথে রেডিয়েশন থেরাপিও চলছে নিয়মিত। ভবিষ্যতের জন্য জমানো টাকা সম্পূর্ণ নি:শেষ। শেষ পর্যন্ত বসত বাড়ীটি ব্যাঙ্কের কাছে বন্ধক রেখে হাউস ফিজিশিয়ান ডক্টর সান্যালের পরামর্শে গত মাসে বিজয়ার হয়েছে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জারি। আজই আসবে শেষ দফার শারিরীক সব রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাথে যাবতীয় রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট।
এতক্ষণ বাড়ীর কর্তা সমরেশবাবু স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূর সাথে নিজের ঘরে নাতনী বিজয়ার বিষয়ে কথা বলছিলেন। কি যেন মনে হওয়ায় তিনি হঠাত্ শান্ত মৃদু স্বরে বলে ওঠেন, “চলো, সকলে মিলে একসাথে দিদিভাইয়ের সাথে একটু সময় কাটাই। ওরও ভালো লাগবে।”
চোখে-মুখে বিষন্নতা আর উদ্বিগ্নতার ছায়া নিয়ে সকলে মিলে ঘরে ঢুকতেই দেখে- বিজয়া কি যেন
একটা আঁকতে ব্যস্ত। বিজয়া সকলকে একসাথে দেখে রং-তুলি সরিয়ে খুশীতে ডগমগ হয়ে বলে,
“তোমাদের একসাথে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। বসো। দাদুভাই, তুমি আমার একবারে সামনে বসো।” আঁকা ছবিটা দাদুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “কাল রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিলো না।
কি করবো! বসে বসে মা দুর্গার কৈলাসযাত্রার ছবিটা এঁকেছিলাম। সম্পূর্ণ হয়নি। এইমাত্র শেষ করলাম। দেখে বলোতো কেমন হয়েছে!”
ছবিটা দেখে সকলে অবাক হয়ে যায়। দাদু বিস্ফারিত নেত্রে আনন্দে চীত্কার করে ওঠেন –“কেমন করে আঁকলি দিদিভাই, মায়ের এমন মনোমুগ্ধকর সুন্দর ছবি! মায়ের চোখে-মুখে নাই এতটুকু বিচ্ছেদ আর বিষাদের ছায়া। নাই চোখের কোণায় এতটুকু অশ্রু। এ-যে দেখি মায়ের মুখে বিজয়িনীর হাসি! “
বিজয়া একগাল হেসে বলে, “ঠিক ধরেছো তুমি দাদুভাই। মায়ের চোখে-মুখে রয়েছে তৃপ্ত, দৃপ্ত, গর্বিত হাসি। যুদ্ধ জয়ের হাসি। গতবছর বিজয়া দশমীর দিন তুমি না বলেছিলে–বিজয়া দশমী মন খারাপের দিন নয়, বিশেষ আবেগ আর গভীর অনুভূতিকে স্পর্শ করার দিন। ন’দিন ন’রাত্রি মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এই দশমীর দিনে তাকে পরাস্ত করে মা যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন।”
-“একদম ঠিক বলেছিস দিদিভাই। তাইতো মা দুর্গার আর এক নাম বিজয়া। আমাদের স্থির বিশ্বাস–তুইও তোর ‘বিজয়া’ নামকে সার্থক করে তুলবি। তোর কাছে মারণরোগের অসুর ধ্বংস হবেই হবে। দেখবি তুই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবি।”
দাদুর কথাগুলো শোনামাত্রই বিজয়া অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হতচকিত হয়ে সকলে ভয়ে চমকে ওঠে। গত পাঁচ বছরে তার দমফাটা এমনি হাসি কারোর তো নজরে পড়েনি। মা কমলা মনে মনে প্রমাদ গোণে। এটা কি তবে ফুরিয়ে যাওয়ার অশুভ সংকেত! না, মোমবাতি নিভে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত! বাঁধ মানে না, ডুকরে কেঁদে ওঠে কমলা।
সমরেশবাবু উদ্বিগ্নচিত্তে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বন্ধু ডক্টর সান্যালকে ব্যাপারটা বিস্তারিত ফোনে জানিয়ে জিগ্যেস করেন, “তুমি কখন আসছো?”
–“রিপোর্ট সব পেয়ে গেছি। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আসছি।”
সমরেশবাবু রিপোর্টের ব্যাপারে কিছু জিগ্যেস করতে যাবে অমনি ফোনটা কেটে যায়। দোটানায় পুনরায় ফোনটা করার আর সাহস পান না। ফোনটা রেখে দেন।
তারা বসে থাকে ডক্টর সান্যালের আগমনের প্রতীক্ষায়।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ত্রস্তপদে ডক্টর সান্যাল ঘরে ঢোকেন। ঘরের পরিবেশ একেবারে থমথমে। টানটান উত্তেজনা। জানা নাই তারা ডক্টর সান্যালের কাছে কি শুনবে–হতাশা, না আশার বাণী!
ডক্টর সান্যাল ভীষণ উদ্বেগে বিজয়ার সামনে এসে দাঁড়ান। মিষ্টি মধুর মৃদুস্বরে জিগ্যেস করেন, “কেমন আছো দিদিমণি?”
বিজয়া বিন্দুমাত্র দেরী না করে স্মার্টলি উত্তর দেয়, “খুব ভালো আছি ডাক্তারদাদু। আজ নিজেকে খুব ফ্রী লাগছে।”
-“এরমধ্যে গায়ে জ্বর এসেছিলো নাকি?”
-“না।”
-“শরীরে কোনো কাঁপুনি?”
-“না।”
হাত-পা গুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন চামড়ার নীচে রক্তজমা ছোপগুলো অদৃশ্য। জিজ্ঞেস করেন,
“দাঁতের মাড়িতে কোনো ব্যথা আছে?”
-“না।”
-“এরমধ্যে কোনো তোমার শ্বাসকষ্ট হয়েছিলো?”
বিজয়া মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “একেবারেই না।”
ঘরে উপস্থিত সকলেই সমস্বরে জানায় তারাও বিজয়ার শ্বাসকষ্টের ব্যাপারটা টের পায়নি।
ডক্টর সান্যালের চোখে মুখে খুশীর ঝলক–“গুড, এবার হাত-পা ছড়িয়ে একটু শুয়ে পড়ো তো মা।”
বিজয়া বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লে ডক্টর সান্যাল পেটটা পরীক্ষা করে দেখলেন ঢাউস
পেটটা অনেকটা ছোটো হয়ে গেছে। লিভার, স্পলীনের অবস্থানও স্বাভাবিক। চোখের কাছে
মুখ নিয়ে গিয়ে বলেন, “একটু বড় করে তাকাও।”
দেখলেন, চোখের ভেতরে সাদা অংশে জমে থাকা ছোটো ছোটো রক্তের স্পটগুলোও উধাও। খুশীতে
ডক্টর সান্যালের চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে। মনের আনন্দে ক্ষণেক বিরতিতে জোরে জোরে তিনবার হাততালি দেন। বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে বিজয়ার হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে প্রবল আবেগে বলেন, “কনগ্রাচুলেশান বিজয়া, ইউ হ্যাভ ওন এ ডিফিকাল্ট ব্যাটল। ইউ আর দ্য উইনার্। ইউ হ্যাভ রিসিভড পারমিশন ফ্রম গড টু স্টে ইন দিস বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড ফর এ লং টাইম।’
কারোর মুখে কোনো কথা নাই। পরমপ্রাপ্তির এক অনির্বচনীয় আনন্দে সকলের চোখে এখন অবিরত বিগলিত অশ্রুধারা।
অনবদ্য লেখনী
আন্তরিক অশেষ ধন্যবাদ।