গল্প

গল্প- মনোবল

মনোবল
– পায়েল সাহু

 

 

সময়ের সাথে সাথে অভিজ্ঞতা বাড়ে। সম্পর্কের সমীকরণগুলো পালটে যায়, চেনা মানুষ হয় অচেনা, অচেনা হয়ে ওঠে পরম আত্মীয়।
ভরসা করার মতো একটা হাত প্রয়োজন হয়।বিশ্বাস করার মতো মন প্রয়োজন হয়। দুঃখের দিনে কাঁদার জন্য একটা কাঁধ প্রয়োজন হয়। সুখের দিনে আনন্দ করার জন্য সঙ্গী প্রয়োজন হয়।
ছোট থেকে পরিবারের সঙ্গে সমস্ত অনুভূতি ভাগ করে অভ্যস্ত প্রাণগুলো দিশাহারা হয়ে আঁকড়ে ধরে social media তে আলাপ হওয়া মানুষগুলোকে। মনের প্রাণের একই রকম অনুভূতিগুলো তাদের কাছাকাছি এনে জন্ম দেয় নতুন সম্পর্কের।

আর ঠিক এমনই অবস্থা তিন্নির। মা বাবা দাদাকে নিয়ে তিন্নির সুখী পরিবার, দাদা এখন চাকরি সূত্রে মুম্বাইতে থাকার দরুণ বাড়িতে তারা মাত্র তিনজন । তবে বন্ধুবান্ধবী আর পড়াশোনা নিয়েই সময় কেটে যেত হুল্লোড়বাজ তিন্নির। কিন্তু এই করোনা আবহে সমস্ত কিছু যেন তছনছ হতে বসেছে। লকডাউনের শুরুর দিকে বেশ মন দিয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করছিলো, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে সেটা থেকেও মন উঠে যাচ্ছে যেন। বন্ধু পাগল তিন্নির মন কাঁদে বন্ধুদের জন্যে, কিন্তু শুরুতে যেভাবে সকলের সঙ্গে ফোনে কথা, ভিডিও কল হতো, এখন আর কারোরই যেন তেমন উৎসাহ নেই, কথা বলার ইচ্ছেটাই নেই কারো | ভীষণ মনমরা সকলেই সারাক্ষণ। অগত্যা উপায় একমাত্র ফেসবুক। সারাক্ষণ প্রচুর মানুষ নানা রকম পোস্ট করে চলেছেন, বেশ ভালোই লাগে তিন্নির। অনেক রকম গ্রূপেও যুক্ত হয়েছে সে, কোনটা লেখালেখির তো কোনোটা রান্নার আবার কোনোটা মজার |
এই সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়েও এতো লোককে নিজের মতো ব্যস্ত থাকতে দেখেও তিন্নি যেন আরো অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কি করবে বুঝতে পারে না, লেখালেখির গ্ৰুপগুলোতে সবাইকে লিখতে দেখে ভাবে সেও কবিতা লিখবে। কিন্তু মৃত্যু, অবসাদ, নিকোটিন, একাকিত্ব এই শব্দগুলো ছাড়া কিছুই যেন লিখে উঠতে পারে না, নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হয়ে ওঠে|
Social mediaতে আলাপ হওয়া নতুন মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলতে যায়, কিন্তু সকলেই যেন তারই মতো হতাশায় ভরা জীবন কাটাচ্ছেন|
একটা একটা করে দিন কেটে যায়, প্রতিটা দিনের শেষে সে ভাবে আরো একটা দিন কেটে গেলো তার বোবা অনুভূতিগুলো নিয়ে। এমন ভাবেই একদিন ফেসবুকের একটি লেখালেখির গ্রূপে তিন্নির হঠাৎ চোখে পড়ে একটি অঙ্কন প্রতিযোগিতার নির্দেশকায়, যেখানে লেখা ছিলো সেরা তিনজনকে নিয়ে একটি অনলাইন কর্মশালা তৈরি হবে, বাড়িতে বসেই সেখানে যোগদান করবেন বেশ কিছু বিভিন্ন বয়সের মানুষ, শুধু তাই নয় ঐ কর্মশালা থেকে উপার্জন করা অর্থই হবে প্রতিযোগিতায় বিজেতাদের পুরস্কার |
তিন্নি ভুলেই গেছিলো যে সে ভীষণ ভালো আঁকতে পারে, তার আঁকা ক্যানভাসে অনেক পরিচিতর বাড়ি সুসজ্জিত। তিন্নি যেন নতুন করে শ্বাস নেয়।নিজেকে প্রস্তুত করে প্রতিযোগিতার জন্যে। সে বুঝতে পারে জীবনের যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে বের হতে গেলে নিজেকেই সবার আগে নিজের পাশে দাঁড়াতে হয়।
দু সপ্তাহ পর….
তিন্নি নিজের আঁকা ক্যানভাসগুলোর ছবি বিক্রির মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে ফেসবুককে। বিপুল সাড়া পাওয়ায় উৎসাহিত হয়ে সে নিজেই একটি পনেরো দিন ব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করে ফেলেছে সামান্য প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে এবং সেখানেও বেশ ভালোই সাড়াও পেয়েছে, প্রথম প্রয়াস সফল হলে সে দ্বিতীয় পদক্ষেপ নেবে এমনটাই ঠিক করে রেখেছে |

আজকাল তিন্নি আবার হাসিখুশি থাকে আর ভীষণ ব্যস্তও বটে প্রতিযোগিতায় বিজয়িনী হিসেবে যৌথ অঙ্কন কর্মশালা এবং তার নিজের কর্মশালা নিয়ে।

নিজের সমস্ত মানসিক অসুস্থতা দূর করে সে ফিরে এসেছে আবার জীবনের মূল স্রোতে যেখানে তার সঙ্গী সাথীদের থেকেও তার বেশি প্রয়োজন তার নিজের অভিজ্ঞতা আর অর্জিত সাইকোলজির বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে অবসাদ গ্রস্ত হয়ে পড়া বিভিন্ন পরিচিত, অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের মনোবল বাড়ানো, তাঁদের মুখে নতুন করে হাসি ফিরিয়ে দেওয়া |

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page