পাগলামি
– শচীদুলাল পাল
অল্পবিস্তর প্রতিটি মানুষই পাগল বা মানসিক রোগগ্রস্ত।
কেউ কম কেউ বেশি। পৃথিবীতে কোনো স্বাভাবিক মানুষ থাকতে পারেনা। প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করা যায়।
মন অমূর্ত। মনের কোনো অবয়ব নেই। সবচেয়ে দ্রুতগামী। এই মন যখন অত্যধিক চিন্তাগ্রস্ত হয় তখন মানুষ মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
আজ বিশ্বে মনোরোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
একদিন মহামারীর আকার ধারণ করবে।
আমাদের পুঞ্জীভূত ইচ্ছা কামনা বাসনা যখন চরিতার্থতার পথে বাধা পায় তখন অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। নির্জ্ঞান স্তরে জট পাকায়।এক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে।
মনোরোগ সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা প্রথম ভারতেই শুরু হয়েছিল। এর উল্লেখ আমরা পাই অথর্ববেদে।পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটেছিল আয়ূর্বেদে।
আয়ূর্বেদ মতে সত্ত্ব রজঃ তম এই তিন গুনের ভারসাম্যের অভাবের জন্যই মনো বিকলন ঘটে।
মনোবিজ্ঞানী মতে সাইক্লোজি। সাইকো অর্থাৎ আত্মা, লজি মানে বিজ্ঞান। আত্মা বিজ্ঞান।
ফ্রয়েড মতে মানুষের মন তিনটি উপাদানে তৈরি। ইদ( অদস) ইগো ও সুপার ইগো বিশষত যখন ইদ ও ইগোর মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সমঝোতা সঙ্গতির অভাব ঘটলে মনোরোগ সৃষ্টি হয়।
মনোবিজ্ঞানের প্রবাদ পুরুষ স্যার সিগমু ফ্রয়েড যাবতীয় মনোরোগ সৃষ্টির মুলে সেক্সকেই দায়ী করেছেন ফ্রয়েডিয় সর্মকামবাদ বা প্যানসেক্সুলিজম এরই প্রতিচ্ছবি।
শরীরের ভিতর বিভিন্ন অন্তঃস্রাবি গ্রন্থি রস ( হোরমোন) ক্ষরণের বিশৃঙ্খলা ও মস্তিষ্কের ভিতর নানা ধরনের স্নায়ু প্রেরক রসের ভারসাম্যের অভাবেও মনোরোগ সৃষ্টি করে।
এছাড়া আর্থসামাজিক বিপর্যয়, র্নৈরাশ্য, অশিক্ষা, ভুল শিক্ষা, রাত জেগে পড়া, নানান সামাজিক চাপ, মানসিক চাপ, অন্তঃব্যক্তিত্ত্ব সংঘাত, যৌন বিকার, যৌন সংঘাত, যৌন সন্ত্রাস, অপসংস্কৃতি, হীনমন্যতা রেষারেষি, অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের নেশা, অতি উচ্চাকাঙখা, দিবাস্বপ্ন, অত্যধিক লোভ, লালসা, বিবাহিত জীবনে ছন্দ হীনতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বঞ্চনা, শোষণ, আকস্মিক কর্মহীনতা, বিবাহিতাদের অরগ্যাজম সুখ থেকে বঞ্চিতা ইত্যাদি মনোরোগ সৃষ্টির কারণ।
মনোরোগ দুপ্রকার। নিউরোসিস বা বায়ুরোগ,( হালকা ধরনের) সাইকোসিস বা উন্মাদ রোগ।( ভারী ধরনের)।
বিষন্নতা, হিস্টেরিয়া অত্যধিক টেনশন, শুচিবাইগ্রস্ত প্রভৃতি নিউরোসিস গ্রুপেই পড়ে।
উন্মাদ, স্কিজোফ্রেনিয়া, সাইকোটিক ডিপ্রেশন, ভ্রমবিকার, ম্যানিয়া, এপিলেপ্সি, ড্রাগ এডিকশন, জড়বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ত্বজনিত বিশৃঙখলা, যৌনবিকৃতি ইত্যাদি সাইকোসিস শ্রেণী ভুক্ত।
পাগলামি অনেক প্রকার। তার মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ —-
টেনশন
————
টেনশন অল্পবিস্তর সব মানুষের মধ্যেই আসতে পারে।তবে যারা উদ্বেগপ্রবণ ব্যাক্তি তাদের মধ্যে এই টেনশন বেশি।
টেনশন অল্পস্বল্প থাকা দরকার আবার বেশি হলে মুশকিল।
যেমন সেতারের তার। টেনশান না দিলে তো স্বর আসবে না। আবার টেনশন বেশি দিলে তার ছিঁড়ে যাবে।
রাগ ঈর্ষা কাম লোভ লজ্জা ঘৃণা ভয় সেই সাথে অস্থিরতা বিরক্তি উদ্বেগ ইত্যাদির এক মিশ্র অনুভূতির নাম টেনশন।
কিন্তু টেনশন থেকে নানান উপসর্গ সৃষ্টি করে।
ছটফটে ভাব, মনঃসংযোগের অভাব, বিষন্নতা, মানুষজন এড়িয়ে চলা, অনিদ্রা, মেয়েদের ঋতুস্রাবে গন্ডগোল, ঘন ঘন তৃষ্ণা, মলত্যাগ, ঘাড়ে মাথায় যন্ত্রণা, উচ্চ রক্তচাপ, মাথাঘোরা, ভার্টিগো, শ্বাসকষ্ট, যৌনবিষয়ে অনীহা, হাঁপানি, বদ হজম, পেপ্টিক আলসারএর মতো রোগ সৃষ্টি করে।
দীর্ঘকালীন টেনশনে স্বামী স্ত্রী বা প্রেমিক প্রেমিকার যৌন অনীহার সৃষ্টি হয়।
প্রতিকার
————
অনিদ্রা হলে হাল্কা ডোজের ঘুমের অষুধ খাওয়া যেতে পারে। যা ঘটে গেছে তা নিয়ে বিলাপ বা অনুশোচনা করা উচিৎ নয়। হা হুতাশ করাও উচিৎ নয়।
উপনিষদ বলছে — আনন্দ থেকেই এই জগতের সৃষ্টি। আনন্দেই স্থিতি আনন্দেই লয়।
সুতরাং সর্বদা আনন্দেই থাকুন।
উদ্বেগ
———-
উৎকন্ঠা বা উদ্বেগ হলো অন্তর্মানস দ্বন্দের বহিঃপ্রকাশ । মানুষের নির্জ্ঞান মনস্তরের সঞ্চিত কামনা বাসনা ভীতি যখন অবদমনের বাধা ভেঙ্গে সজ্ঞান মনে চলে আসে তখনই মানসিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়।
উদ্বেগ সৃষ্টির কারন হলো বিবেকের চাপে অন্যায় বা পাপবোধ, দেহ সংক্রান্ত নানা ক্ষয়ক্ষতির আশংকা, প্রিয়জনের অমঙ্গল বা বিয়োগ আশংকা।আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা।
বিষন্নতা
———-
এই রোগ সাধারণত হয় সাধারণত
প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথা, বিফলতা, অক্ষমতা, হীনমন্যতা, অপমানিত হওয়া, আশাভঙ্গ ইত্যাদি কারনে। কিছু ক্ষেত্রে এক শুন্যতা সৃষ্টি করে। যাকে ডিলিউশন বলে। রোগী মনে করে সব কিছু শুন্য।বিশ্ব ব্রহ্মান্ড শেষ হয়ে যাচ্ছে। কানের মধ্যে এক ধ্বংসের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে।
বিষন্নতা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে।
প্রতিকার – রোগীকে আনন্দময় পরিবেশে রাখা।
স্কিজোফ্রেনিয়া
————-
এই রোগ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। সাধারণত বয়ঃসন্ধির রোগ।
আমি ঈশ্বরকে দেখেছি। উনি আমার সাথে কথা বলেন। আমি এক অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন মহাপুরুষ। বাস্তব জ্ঞান থাকেনা। অবাস্তব জগতে বিচরণ করতে থাকে।
কিছু অলীক লক্ষণ দেখা যায়। যেমন অলীক শ্রবণ। মনে হয় তার সাথে কেউ কথা বলছে। ধারে পাশে কেউ নেই তবুও সে কারো কথা শুনছে। তাকেই অডিটারি হেলুসিনেসান বলে।
কতক ক্ষেত্রে ভিসুয়াল হেলুসিনেসান হয়।অর্থাৎ সে অবাস্তব কিছু দেখতে পায়। আবার কেউ অবাস্তব কিছু ঘ্রাণ অনুভব করে।
কোনো যুক্তি দিয়েই এইসব ভ্রান্ত ধারণাকে খন্ডন করা যায়না।
স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীদের নিদ্রাহীনতা থাকে। ভীষণ এগ্রেসিভ হয়। আক্রমাত্মক হয়। ক্ষেত্র বিশেষে হত্যা পর্যন্ত করতে পারে। রোগী আপন মনে হাসতে থাকে বা বিড় বিড় করে বলতে থাকে।
এছাড়া মানুষের পাগলামির কারণ অনেক। সাধারণ থেকে বদ্ধ উন্মাদ হবার কারণ পরিবেশ।
ঠিক সময়ে ঠিকমতো চিকিৎসা না করার ফলে মানুষ বদ্ধ পাগল হয়ে যায়। তাদের পাগলা গারদেই দেওয়া উচিৎ।
কারণ অত্যধিক রাগবশতঃ আপনজনেরই ক্ষতি করে বসে।
যেকোনো ধরনের পাগলামির লক্ষ্মণ দেখা দিলেই সাইক্রাটিস্ট দেখানো উচিৎ।
আবার কোনো মানুষকে সাইক্রাটিস্টের কথা বললেই সাধারণত বলে আমি পাগল নই তোমরা পাগল। তোমরা ডাক্তার দেখাও।
প্রতিকার- ঠিকমতো ঘুম। আনন্দময় পরিবেশে থাকা, আর ধ্যান ষৎচক্র ভেদ করে আজ্ঞা চক্রে ধ্যান না করে অনাহত চক্র পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই যথেষ্ট। এ বিষয়ে প্রকৃত গুরুর প্রয়োজন।
রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে পাগল ঠাকুর বললে তিনি বলতেন তোরা পাগল।