সঙ্গী
-রাখী চক্রবর্তী
“মন তোর ভ্রম গেল না,
ভবের খেলা সাঙ্গ হলে
পরপারে যাবি,
সুখ পাখিটা পাওয়ার আশায়
আর কত রাত জাগবি।
মন তোর ভ্রম গেল না।”
বল হরি হরি বল..বল হরি হরি বল..
ধ্বনি শুনতে পেয়ে সনাতন মাঝি গান থামিয়ে বললো, এই দিনটার অপেক্ষা তো আমাদের সবারই থাকে তবে আমার আমার করে লড়াই বিবাদ কেন?
-ও মাঝি দাদা এটা কি শেষ? নাকি আরও একবার চলবে নৌকা।
-না বাবুসাব আজ এই পর্যন্ত। শীতের রাতে মানুষজনের আনাগোনা খুব কম বাবু। জনা তিরিশ না হলে নৌকা চালিয়ে লাভ নেই। তা বাবুসাব আপনারে তো এই ঘাটে আগে কখনও দেখিনি। নতুন এয়েছেন বুঝি!
-না, নতুন না। বহু বছরের সম্পর্ক এই জায়গার সাথে। তবে বাইশ বছর পর এই ঘাটে এলাম। সব কেমন পাল্টে গেছে। ভব মাঝির খোঁজ পেলাম না। সিধু মাঝিকে দেখতে পেলাম না। বড় ভালো ছিল সিধু দাদা। গঙ্গার ওপারে নিয়ে যেত একটা পয়সা নিত না। অবশ্য যা বায়না করতাম।
-না বাবুসাব উধার রাখতে নেই। ঠিক শোধ দিতে হয় এ জন্মে না হয় পরের জন্মে। মা গঙ্গার বক্ষ পারাপার তো, এক পয়সা হলেও দিতে হয়। আর মাঝিদের জীবনতরী খুব কষ্টে ভাসে গো।
-আমার হাতে বেশি সময় নেই। আমার একটা উপকার করবে?
-হ্যাঁ হ্যাঁ সাধ্যে কুলালে নিশ্চই করবো।
-গঙ্গার ওপারে আমার সঙ্গী মুন্না থাকে। কাল ভোর হলেই তো তুমি নৌকা নিয়ে ওপারে যাবে।মুন্না বললেই সবাই চিনিয়ে দেবে। একমুঠো ছাই শুধু মুন্নার হাতে দিয়ে বলবে চন্দন পাঠিয়েছে। কপাল থেকে মাথার সিঁথি পর্যন্ত যেন টেনে নেয়।
-ও আপনার নাম তাহলে চন্দন। তা এ কেমন ধারা কথা বাবুসাব! ছাই আবার সিঁথিতে উঠবে! চন্দন বাবুসাব কোথায় গেলেন? ঝড় শুরু হয়ে গেল তো।চন্দন বাবুসাব…চন্দন বাবুসাব ।
সনাতন মাঝি চন্দন বাবুসাব বলতে বলতে শ্মশানের সামনে চলে এল। মরদেহের শরীর থেকে সাদা চাদরটা ঝড়ের দাপটে খুলে গেছে। শ্মশান যাত্রীরা শবদেহ রাখার ঘরের বারান্দায় চলে এসেছে। যা ঝড়ের দাপট। না এসে উপায় নেই।
সনাতন মাঝি মরদেহের ওপর নজর পড়তেই চমকে উঠল এ তো চন্দন বাবুসাব। তাহলে আমার সাথে কথা বলছিল কে? না না ভ্রম, আমার সব ভ্রম। যাই ওদের জিজ্ঞাসা করে আসি ওরা মৃতদেহ এনেছে নিশ্চয়ই সব জানবে।
সনাতন মাঝি ওদের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞাসা করলো, কার মৃতদেহ বাবু এটা?
-আপনি কি নাম বললে চিনবেন? এখানে আগে থাকতো। বাইশ বছর পর নিজের শহরে এল তাও আবার ডেডবডি হয়ে।
-কি হয়েছে বলুন বাবু?
-চন্দন সেন। সেন জুয়েলার্সের নাম শুনেছেন তো।সেন পরিবারের একমাত্র বংশধর চন্দন সেন। গতকাল রাতে দমদম বিমান বন্দর থেকে বাড়ি ফিরছিল নিজেদের গাড়িতেই। চন্দনের গাড়ির ড্রাইভার ব্রেক কষে এক মহিলাকে বাঁচাতে যায় তখনি চন্দনের গাড়ি উল্টে যায়। রাত তখন দুটো।খবর আসে আমাদের পাড়ায়। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সময় দেয়নি চন্দন। ড্রাইভার এখনও সঙ্কটজনক অবস্থায় আছে।
থানা, পুলিশ, কাটাছেঁড়ার পর আজ রাতে দাহ করাতে নিয়ে এলাম চন্দনের মৃতদেহ। সেই ছোটবেলার বন্ধু আমাদের। দশ বছর যখন ওর বয়স তখন ওর বাবা ওকে পুনেতে ওর পিসির বাড়ি নিয়ে গেল। ওখান থেকেই লেখা পড়া করবে।বাইশ বছর পর চন্দন কোলকাতায় আসছে।খবরটা আমরা পাইনি অবশ্য। চন্দন দূর্ঘটনায় মারা গেল তখনই সব জানলাম।
সনাতন মাঝি সব শুনে থ হয়ে গেল। মুন্নার কাছে যেতেই হবে। কি সম্পর্ক চন্দনের সঙ্গে মুন্নার?
সঙ্গী বলল তো।
জীবন সঙ্গী না জীবন মরনের সঙ্গী? ছাই মানে কি বলতে চেয়েছে চন্দন বাবুসাব। নিজের চিতার ছাই। হায় ভগবান! আমি অপেক্ষা করবো। চন্দন বাবুসাবের চিতার ছাই নিয়ে মুন্না দিদিমনির বাড়ি যাব ।সব জানবো, সওব,
দাউ দাউ করে জ্বলছে চিতার আগুন। সনাতন মাঝি মাথায় হাত দিয়ে ঘাটের এককোনে বসে আছে। ভোরের অপেক্ষা, চিতা নেভার অপেক্ষা, কথা রাখার অপেক্ষা।
সকাল হতেই সনাতন মাঝি নৌকা নিয়ে চললো মুন্না দিদিমনির বাড়ি। চন্দন বাবুসাব ঠিক বলেছিল এক ডাকে সবাই চেনে মুন্না দিদিমনিকে।
সনাতন মাঝি নিজের পরিচয় দিয়ে বললো, চন্দন বাবুসাব আমাকে আপনার কাছে..
মুন্না সনাতন মাঝির পুরো কথা না শুনে বললো, আপনাকে চন্দন পাঠিয়েছে?
– দিদিমনি এই কাগজের প্যাকেটে যা আছে কপাল থেকে সিঁথি পর্যন্ত টেনে নিন। চন্দন বাবুসাব আর..
মুন্না খুব রেগে বললো চন্দনের খুব শখ আমাকে সিঁদুর পড়ানোর, শেষ করে দেবো ওকে। জম্মের মতো শখ মিটে যাবে ওর।
সনাতন মাঝি কিছুই বুঝতে পারছে না। মনে মনে ভাবল একবার জিজ্ঞাসা করি মুন্না দিদিমনিকে চন্দন বাবুসাবের বিষয়ে। না থাক,
– দিদিমনি এইটা কি আগে তো দেখুন।
– কি আবার সিঁদুরই হবে। আমাকে ও খুব ভালবাসে। আমিও।
আমাদের বিয়ের দিনক্ষণ সব ঠিক হয়ে গেল। আমি মনে ঘর সংসারের ছবি আঁকতে শুরু করলাম। তারপর..
– তারপর কি? কি ভাবে পরিচয় হলো?
– চাকরি সুত্রে আমি পুনেতে থাকতাম। চন্দনের সাথে দু’বছর আগে আমার আলাপ হয়েছিল।বন্ধুত্ব তার পর প্রেম। খুব ভালো ছেলে চন্দন। সৌন্দর্যের পুজারী ও। যা কিছু সুন্দর সব ওর প্রিয়। কুৎসিত, কালো, আঁধার ওর জীবন তোলপাড় করে দেয়।
আমি সেই অর্থে সুন্দরী। তাই ও আমাকে পছন্দ করেছে। মেলামেশা শুরু হতে হতেই চন্দনের ভালোলাগা মন্দলাগার বিষয়ে জানতে পারি। আমি যদি কুৎসিত হতাম। গায়ের রঙ কালো হতো তাহলে চন্দন আমাকে ভালবাসা তো দুর ফিরেও চাইতো না আমার দিকে। যাক সে কথা। আপনি চন্দনের কে হন?
-কেউ হই না। গতকাল রাতে আলাপ হয়েছিল।
তাই সকালে দিতে চলে এলাম। তবুও বলবো আপনি চন্দন বাবুসাবকে বিয়ে না করে ভুল করেছেন।
মুন্না গায়ে জড়ানো চাদরটা খুলে বললো, এবার বলুন আমি ঠিক করেছি না ভুল।
সনাতন মাঝি চিৎকার করে বললো, দিদিমনি!
-হ্যাঁ এই রূপ আমার। মুখটা দু’ দিনের মধ্যে কালো ছোপে ভরে যাবে। হাত পা গলাতে কালো ছোপ।ফর্সা তো তাই কালো ছোপটা উজ্বল দেখাচ্ছে।
আমি পুনে থেকে চলে এসেছি। ও অবশ্য জানতো না। তবে জানতে আর দেরি হল না। ঠিক জেনে গেল যে আমি কোলকাতায় চলে এসেছি। আমাকে বিয়ে করবে বলে ও নিশ্চয়ই এখানে আসবে। তখন দুর দুর করে তাড়িয়ে দেব ওকে। তবে আমার কুৎসিত চেহারা ওকে দেখাবো না। ও আমাকে ঘেন্না করবে। ওর ঘেন্না নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। না না কিছুতেই না।
সনাতন মাঝি চুপ করে বসে রইলো। কি বলবে এবার।
মুন্না কাগজের প্যাকেটটা খুলতে যাবে তখন সনাতন মাঝি বললো, থাক মা ওটা খুলতে হবে না।আমাকে দিয়ে দাও। আমি চলে যাচ্ছি।
-না না আমি চন্দনের পাঠানোর সিঁদুর পড়বো।সবার অলক্ষ্যে, কেউ জানবে না। চন্দনও না।
মুন্না প্যাকেটটা খুলে বললো, ও গড.. এ তো ছাই।
ও আমার জন্য ছাই পাঠালো। চন্দন তাহলে খোঁজ নিয়ে আমার সম্পর্কে সব জেনে গেছে। আমি কুৎসিত হয়ে গেছি। আর সুন্দর নই আমি। ভালোই হলো। আর লুকিয়ে থাকতে হবে না আমাকে।
সনাতন মাঝি মাথা নিচু করে বললো, চন্দন বাবুসাবের চিতার ছাই। টেনে নাও মা কপাল থেকে সিঁথি পর্যন্ত।
মুন্না হতবাক হয়ে গেল সনাতন মাঝির কথা শুনে।
চন্দনের চিতা! মানে কি?
-কোলকাতায় আসছিল বাবুসাব। গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে গতপরশু রাতে। গতকাল রাতে শ্মশানে আমার সাথে কথা হলো চন্দন বাবুসাবের। বিশ্বাস করো মা। কাল রাতেই ওর সঙ্গে আমি কথা বললাম। ও কিন্তু মৃত তখন। ওর ইচ্ছেতেই আমি তোমার এখানে এসেছি।
মুন্না একদিন চন্দনকে বলেছিল, তুমি আমাকে ভালবাসা না ছাই। সেই ছাই সিঁথিতে তুলছে মুন্না কপাল থেকে সিঁথি পর্যন্ত টেনে। সনাতন মাঝি চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আজ আর মন নেই নৌকা চালানোর।
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হল তারপর রাত। নৌকা ঘাটে বাধাই আছে। সনাতন মাঝি নৌকাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তা নিজেই জানে না।
“মন তোর ভ্রম গেল না
ভবের খেলা সাঙ্গ হলে পরপারে যাবি”
এ তো আমার গান, কে গাইছে?” চোখ ডলতে ডলতে বলল সনাতন মাঝি।
সনাতন মাঝি চোখ খুলে দেখল চন্দন ও মুন্না একে অপরের হাত ধরে নৌকার ওপর বসলো। সারা শরীর কাঁপছে সনাতন মাঝির। বাবুসাব দিদিমনি আমার নৌকা থেকে নেমে পড়ুন। আমি নৌকা বাইতে পারবো না। ঠিক তখনই ঝুপ করে একটা শব্দ হল।
সনাতন মাঝি দেখল নৌকা থেকে লাফ দিয়ে গঙ্গার জলে দুজনে একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। প্রথমে হাঁটু জল, তারপর কোমর জল, তারপর বুক জল তারপর মাথা জল। গঙ্গার জল জোয়ারে উথালপাথাল। সনাতন মাঝি শুধু দেখছে। বলার মতো ভাষা তার নেই ।
সেই রাতের পর থেকে সনাতন মাঝি নৌকাতেই ঘুমায় নৌকাতেই খায়। কিন্তু গঙ্গায় নৌকা নিয়ে নামতে পারে না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলে ডুবে যাবে, ওরা ডুবে যাবে। তবেু খুব ভালো আছে সনাতন মাঝি। দুবেলার খাবারের ব্যাবস্থা হয়ে যায়। কে দেয় তা সবার অজানা। আমরা চার বন্ধু এখন গঙ্গার ঘাটে আছি। সন্ধ্যে ছটা বাজে।সনাতন মাঝি তার জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বললো, আমরা শুনলাম। সন্ধ্যা নেমে এল। পাখিরা ঘরে ফিরছে।
বিশ্বাস অবিশ্বাস যার যার মনের ব্যাপার। তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না মুন্না কি আত্মহত্যা করেছিল না কি চন্দনের আত্মা মুন্নাকে নিজের কাছে টেনে নিল? সঙ্গী তো ! টানতেই পারে। সে যে সঙ্গীই হোক- জীবন সঙ্গী হোক বা জীবন মরনের সঙ্গী।