Site icon আলাপী মন

গল্প- পোষ্ট মাষ্টার

পোষ্ট মাষ্টার
– রাখী চক্রবর্তী

 

 

ও মাস্টার আপনি নতুন এসেছেন। আগের মাস্টারকে দেখছি না। এখনও আসেনি বুঝি?
ফুল বাগান পোস্ট অফিসের নতুন পোস্ট মাস্টার চায়ের ভাঁড়ে চমুক দিয়ে বললেন, না মাসিমা উনি ট্রান্সফার হয়ে গেছেন।
-ও, আমি গত মাসে এসেছিলাম কথা হল মাস্টারের সাথে। কৈ কিছু বলল না তো।

-মাসিমা দশ দিন হল উনি গেছেন। হঠাৎই হল।আচ্ছা আপনার কি দরকার বলুন?

-এই হল আমার পাস বই। পাঁচশো টাকা তুলবো। আমাকে টাকা দিন।

-মাসিমা আপনি পুরনো পাস বই নিয়ে এসেছেন।এতে এক টাকাও নেই।
-আপনি ভুল বলছেন। আমার বইতে টাকা আছে।
এর মধ্যে পোস্ট অফিসের ফোন বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং..নতুন পোস্ট মাস্টার ফোন ধরলেন, হ্যালো কে বলছেন?

-আমি ফুলবাগান পোস্ট অফিসের সাব পোস্ট মাস্টারের সাথে কথা বলতে চাই।

-আমি বলছি। বলুন কি সাহায্য করতে পারি?
-আমি সুভাষবাবু বলছি। পোস্ট মাস্টার সুভাষ দে।

-ও স্যার বলুন..

-কাউন্টারে সুবলা দেবী দাঁড়িয়ে আছেন তো !

-হ্যাঁ স্যার, বইতে একটা টাকাও নেই অথচ..

-পাঁচশো টাকা দিয়ে দিন। আর বলুন পরের মাসেও যেন মাসিমা আসেন। আমি মিনিট দশের মধ্যে আসছি। আপনাকে পাঁচশো টাকা দিতে।

-আচ্ছা স্যার। অত তাড়াহুড়ো করবেন না। ধীরে সুস্থে আসুন।
ফোনটা রেখে ফুলবাগান পোস্ট অফিসের সাব পোস্ট মাস্টার আকাশ দত্ত বললেন, মাসিমা এই নিন আপনার পাঁচশো টাকা।
-তাহলে আমাকে যে বললে টাকা নেই!
-বড় ভুল হয়ে গেছে। আপনি বাড়ি চলে যান। পরের মাসে আসবেন।
-একটা কথা বলবো, তুমি খুব ভালো ওই আগের মাস্টারের মতো। আশীর্বাদ করি বাবা সুখে থাকো বলে সুবলা দেবী চলে গেলেন।
ঠিক দশ মিনিট পরে সুভাষবাবু এলেন, নতুন পোস্ট মাস্টারের হাতে পাঁচশো টাকা দিতেই আকাশ বাবু বললেন কি ব্যাপার স্যার কিছুই তো বুঝতে পারলাম না। সুবলাদেবীর পাসবই তো ফাঁকা তাহলে পাঁচশো টাকা কিভাবে?
পোস্ট মাস্টার সুভাষবাবু বললেন, তাহলে শুনুন দুবছর আগের ঘটনা- সুখুর মা নামেই পরিচিত সুবলা দেবী। দশ বছর বয়সে সুখু কলেরাতে মারা যায়। এখন বেঁচে থাকলে সুখু পঁচিশ বছরের যুবক হত। সুবলা দেবী বড় মার মন্দিরের প্রসাদ খেয়ে জীবনধারণ করেন। পরনের কাপড় শীতকালে কম্বল, চাদর সব মন্দিরের কমিটি দেয়। শুধু সুবলা দেবী কেন জনা তিরিশ অসহায় বৃদ্ধা এই সাহায্য পেয়ে থাকেন। অসহায়ের সম্বল বড় মা কালী।
সুবলা দেবী দু’বছর আগে একটা পুরানো পাস বই নিয়ে এই ফুল বাগান পোস্ট অফিসে এসে আমাকে বললেন, আমার বইতে কত টাকা আছে মাস্টার?
আমি সেই সময় পোস্ট মাস্টার ছিলাম। সুবলাদেবীর পাস বুক দেখে বললাম, এ তো পুরানো পাস বই। আর টাকাও নেই।
সুবলা দেবী বিড়বিড় করে বললেন, কত আশা নিয়ে এসেছিলাম।
-মাসিমা কোনও সমস্যা? বলতে পারেন।
সুবলাদেবী বললেন, আমি ডাক্তারবাবুকে কথা দিয়েছি আমার পাস বুক থেকে পাঁচশো টাকা দেব।তাই দিয়ে গরিব বাচ্চাগুলোর জন্য ওষুধ তৈরি করবে ডাক্তার বাবু। ডাক্তার বাবু তার সাধ্য মতো সাহায্য করেন গরীব বাচ্চাগুলোকে। এখন আমি কি করব? কিন্তু আমার বইতে টাকা নেই কেন?
আমার স্বামী মারা যাওয়ার সময় অনেক টাকা ছিল এই বইতে।
আমি কিছু না ভেবেই বললাম, আপনি এই বইটি রেখে যান। কাল একবার আসুন।
আসলে সুবলাদেবীর স্বামী মিথ্যে কথা বলেছেন ।ওনার পাস বই পুরো ফাঁকা। যাই হোক পরের দিন সকাল দশটার সময় সুবলাদেবী পোস্ট অফিসে এলেন। পাঁচশো টাকা দিয়ে বললাম, মাসিমা আপনি প্রতি মাসে এসে আপনার পাঁচশো টাকা নিয়ে যাবেন। সুবলা দেবী টাকা নিয়ে চলে গেলেন। আমার খুব গর্ব হল ওনার জন্য নিজে গরীব হয়েও গরিব বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে ডাক্তার বাবুকে সাহায্য করার জন্য চিন্তায় পড়ে গেছেন।
সেই থেকে প্রতি মাসে এক তারিখে আমি পাঁচশো টাকা দিই মাসিমাকে। আর মাসিমা সেই টাকা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার রামলাল দত্তকে দিয়ে দেন।সেই টাকা দিয়ে ওষুধ তৈরির জিনিস কিনে পুরিয়া তৈরি করে রামলাল ডাক্তার বস্তির বাচ্চাগুলোকে দেয় জ্বর, সর্দি, কাশি, পেটে ব্যাথা। আসলে রামলাল ডাক্তারের নিজের রোজগার বলতে কিছু নেই। একটু আদটু যা হয় তা দিয়ে আর সুবলা দেবীর পাঁচশো টাকা দিয়ে পুরিয়া তৈরি করেন।প্রায় সব গরীবই ওনার পেশেন্ট। তাই নিজের রোজগার খুব কম। রামলাল ডাক্তার সুবলা দেবী ওনাদের খুব ভক্তি করি আমি।
আমি আপনাকে ফোন করতাম না। নিজে এসেই সবটাই বলতাম। কিন্তু ট্রেনের গণ্ডগোলের জন্য আমি অটো সট্যান্ডে এসে আপনাকে ফোন করলাম। যতদিন মাসিমা বেঁচে আছেন আমিও বেঁচে থাকবো ততদিন দিয়ে যাব যৎসামান্য টাকা।জানি এ টাকা দিয়ে আর কতটুকুই বা হবে।
নতুন পোস্ট মাস্টার সুভাষবাবুর চরণ স্পর্শ করে বললেন, আমি নাস্তিক। ভগবানের ওপর খুব রাগ আমার। বিশ্বাস তো পরের কথা। ভগবানের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করি না আমি। কিন্তু আজ দর্শন করলাম জীবন্ত ভগবানের। আশীর্বাদ করুন স্যার আমিও যেন আপনার মতো দরিদ্র অসহায় মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি।
এক সপ্তাহ পর রামলাল ডাক্তার সরকারি সাহায্য পেলেন। সরকার সমস্ত খরচা বহন করবে। পুরিয়া তৈরি হবে অনেক অনেক। বিনা চিকিৎসায় কেউ মরবে না। নতুন পোস্ট মাস্টার সব ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন। ফুলবাগানে শত শত ফুল ফুটবে।অকালে কোনও ফুল ঝড়ে যাবে না। যতই ঝড় আসুক যতই বন্যা হোক সব ফুল হাসবে খিলখিল করে।

Exit mobile version