গল্প- মুক্তি

মুক্তি
– জয়তী মিত্র

 

 

শোনো রণ আমি আর এক মুহূর্ত এই বাড়ীতে থাকতে পারছি না। তোমার মা, বাবা খুব ভালো মনের মানুষ ওনাদের নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই,কিন্তু ওই যে তোমার পিসি ঠাকুমা, তোমার ঠাকুমা, আর তোমার জেঠিমা এদের নিয়েই আমার সমস্যা। সারাক্ষণ আমার পিছনে পড়ে আছে। বলে কিনা, সারাদিন ঘোমটা দিয়ে থাকতে, তোমার সাথে রাত বারোটার আগে কথা বলা যাবে না, যখন তখন কোথাও যাওয়া যাবে না। নমাসে, ছয়মাসে বাপের বাড়ি যেতে পারবো এইসব নাকি এই বাড়ির নিয়ম। এইগুলো আমাকে মেনে চলতে হবে। এ কোন যুগে পড়ে আছে তোমার বাড়ির লোক। এই সব তো মধ্য যুগীয় বর্বরতার সমান। এই যুগে এইসব মানায় নাকি? এখন ভাবছি তোমাকে ভালোবেসে আমি ভুল করেছি। একগাদা শ্বশুর, শাশুড়ি নিয়ে আমার জাস্ট অসহ্য লাগছে এই বাড়ীতে। আমি চিরকাল স্বাধীন ভাবে বেঁচেছি আর আজও সেইভাবেই বাঁচতে চাই। এইসব অদ্ভুত নিয়মের বেড়াজালে আমাকে কোনোদিন বাঁধতে পারবে না তোমরা। তাতে যদি তোমার সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয় সেও ভালো। সবে তিন মাস হলো বিয়ে হয়েছে এর মধ্যেই আমি হাঁফিয়ে উঠেছি আর পারছি না। চলো মা-বাবাকে নিয়ে আমরা অন্য কোথাও গিয়ে থাকি। তোমার বাবা-মা আমাকে খুব ভালোবাসেন, ওনাদের আমি হারাতে চাই না।
রণ সুমিকে বললো, এটা কি করে সম্ভব? আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। দাদুর আমল থেকেই সকলে একসাথে থাকি। সেই পরম্পরা কি কখনো ভাঙ্গা যায়? আর বাবা-মা কোনোদিন এই বাড়ি এই পরিবার ছেড়ে কোথাও যাবে না। ঠাকুমা, জেঠিমার বয়স হয়েছে ওনারা আজ আছেন, কাল নেই একটু মানিয়ে চলো। আস্তে,আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আর আমি বাড়ির বড় ছেলে, সদ্য বিয়ে হয়েছে আমি কি তোমাকে নিয়ে আলাদা থাকতে পারি বলো। আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ।
জানো রণ সেদিন আমার এক বান্ধবীর সাথে কথা হচ্ছিল, আমি এম এ তে ভর্তি হব, তা তোমার জেঠিমা, আমাকে বললেন,’অনেক পড়াশুনা করেছ বৌমা আর করতে হবে না, এবার মন দিয়ে সংসার করো। কদিন বাদে ছেলেপুলের মা হবে তাদের মানুষ করতে হবে। লেখাপড়ার কথা মাথা থেকে হাটাও।’ যে যাই বলুক আমি এম এ পড়বই। মাস্টার্স আমি করবই তাতে যদি এই বাড়ি আমাকে ছাড়তে হয় তাও আছে। মগের মুল্লুক নাকি যে ওনাদের কথামত আমাকে চলতে হবে।
সুমির যে এই বাড়ির অনুশাসন মানতে খুব অসুবিধা হচ্ছে এটা সুমির শাশুড়ি মা খুব ভালো বুঝতে পারছে। সুমিকে ডেকে একদিন আড়ালে তিনি বললেন, ‘তুই কিছু চিন্তা করিস না মা, আমি সবসময় তোর সাথে আছি, তুই যাতে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে প্যারিস তার ব্যবস্থা আমি করে দেবো। কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। আমি সারাজীবন এই সংসারে শাশুড়ি মায়েদের নানান নিয়মের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়েছি, অসহ্য লাগলেও কেউ আমার দুঃখের কথা শোনে নি কোনোদিন। কিন্তু আজ আমি তোর শাশুড়ি কথা দিচ্ছি, যে কষ্ট আমি সারাজীবন ভোগ করেছি সেটা থেকে আমি তোকে মুক্তি দেবো মা। আমার ছেলেটাকে কিছু বলিস না। ও কি করবে বল, যা করার আমাকেই করতে হবে।’
রণকে ডেকে তার মা বললেন, ‘তুই সুমিকে নিয়ে তোর অফিসের কাছাকাছি ঘর ভাড়া করে থাক তাহলে তোরা প্রাণ ভরে নিজেদের মত করে বাঁচতে পারবি, আমি আর তোর বাবা গিয়ে তোদের মাঝে মধ্যে দেখে আসবো। একদম চিন্তা করবি না। যা চলে যা, এই বাড়ীতে থাকলে সুমি মার সাথে তোর নিত্যদিন অশান্তি লাগবে। তোর ঠাকুমা, জেঠিমার কথা ওর সহ্য হবে না, তোকে সব কথা নালিশ করবে, আর তোর অশান্তি হবে। সারাদিন অফিস কাজ করার পর নিত্যদিন ঝামেলা ভালো লাগবে না। আমার কথা শোন বাবা, বাড়ীতে বলবি- তোর প্রমোশন হয়েছে, অফিস থেকে ফ্ল্যাট দিচ্ছে, তুই বৌমাকে নিয়ে এইবার থেকে সেইখানে থাকবি। তাতে যে যা বলে বলুক, আমি সেটা বুঝে নেবো।’
মায়ের কথা মত ছেলে ঘর ঠিক করে বউকে নিয়ে যাবে সেই সময় পিসি ঠাকুমা বললেন, ‘নাতি যাচ্ছে যাক, নাত বউ এই বাড়িতেই থাক।’ সুমির শাশুড়ি মা বললেন, ‘না সেটা হয় না নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের। দুজনে একসাথে থাকবে।’
তারপর সুমির কাছে গিয়ে কানে কানে বললেন, ‘নে আর দেরি করিস না, আজই যা, আমি তোকে মুক্তি দিলাম। তোর সব স্বপ্ন পূরণ কর। ডানা মেলে দুটিতে উড়ে বেড়া।’ আমি আর তোর বাবা গিয়ে তোদের সংসার গুছিয়ে দিয়ে আসব। সুমি শাশুড়ি মা-কে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললো, ‘তোমার মত শাশুড়ি মা যেন সব মেয়ে পায়, তুমি শুধু আমার শাশুড়ি মা নও, তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী। আমার আরো একটা মা।

Loading

Leave A Comment