ভাঙা নয় গড়া
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
হালকা ঠান্ডা পড়তে না পড়তেই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যাচ্ছে মিনাক্ষীর আজকাল। শুধু ঠিক ঠান্ডা তা নয় এইবারের শীতকালটাও মিনাক্ষীর কাছে খুব স্পেশাল। খুব আদরের।
এতবছর ধরে শীত কিংবা গ্ৰীষ্ম সকাল ছয়টাতে স্নান সারতে হতোই তাকে। স্নান সেরে পূজা করতে না করতেই রান্নার মাসি এসে যেত সাতটার মধ্যে।কোন রকমে নাকে মুখে ভাত, ডাল গুঁজে সাড়ে আটটার মধ্যে বাসস্টপে হাজির হতেই হত। যেদিন কপাল গুনে বসার সিট পেত সেদিন ভাবতো, ইশ্ যদি গরুর মতো জাবর কাটার ক্ষমতা ভগবান তাকে দিতো কি ভালোই হতো। সিটে বসে গরম ভাতের সঙ্গে খাওয়া খাবারগুলোর স্বাদ উপভোগ করতে পারতো।
৩১শে অক্টোবর মিনাক্ষীর লাস্ট ওয়ার্কিং ডে ছিল। তারপর একদিন খুব ঘটা করে ফেয়ারওয়েল দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের সাথে মিনাক্ষীর যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল। তবে ফেয়ারওয়েলের দিনে আবেগে গদগদ হয়ে মিনাক্ষীর চোখে জলটল তেমন আসে নি।
আজ বেলা সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে উঠে গ্যাসের চুলায় চায়ের কেটলিতে দু’কাপ জল দিয়ে বসায়। আঁচটা সিমে করে দক্ষিণ দিকের বারান্দায় হালকা রোদটাতে এসে দাঁড়ায়। ছোট ছোট টবে বেশ কিছু সিজেন ফ্লাওয়ার লাগিয়েছে সে।
মিনাক্ষীর স্বামী অরুন বাবু ও দু’বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন। অবসরের আগে রোজই প্রাতঃভ্রমণ করতে বের হতেন। কিন্তু আজকাল আর রোজ বের হয় না। কারণ রিটারমেন্টের আগে রাস্তাঘাটে, বন্ধুবান্ধবের কাছে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার হিসাবে একটা সম্মান ছিল তার। কিন্তু অবসর গ্রহণের পর বন্ধু মহল আগের মতো আর তাকে অতখানি কদর করে না। তারা হাবে ভাবে বুঝিয়ে দেয় অবসরের পর মুড়ি মুড়কির এক দর। এখন তাই বেশিরভাগ দিন ছাদে গিয়ে হালকা একটু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে নেন তারপর নেমে এসে মিসেস এর হাতের পরম যত্নে তৈরি ব্ল্যাক টি খান।
মিনাক্ষী গাঁদা গাছগুলোতে হালকা একটু জল স্প্রে করে এসে চা-টা নামায়। একটা ট্রেতে দুখানা সুদৃশ্য কাঁচের কাপে চা ঢেলে বারান্দায় রাখা ছোট টেবিলটার উপর রাখে। চেয়ারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাবে এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। সকালে মোবাইল বাজলেই মিনাক্ষীর টেনশন হয় এই বুঝি কাজের মেয়েটা আসতে ‘পারব না’ বলে ফোন করছে।
মোবাইলের স্ক্রিনে নামটা দেখে সব ফালতু টেনশন ঝেড়ে ফেলে বেশ গদগদ সুরে বলে, বেবু আজ সকাল সকাল মা-কে মনে পড়লো? মিনাক্ষী তার মেয়ে অম্বিকাকে আদর করে আজও বেবু বলে ডাকে।
অপর প্রান্ত থেকে অম্বিকা বলে, মম আমি মাসখানেক তোমাদের ওখানে গিয়ে থাকতে পারি?
অম্বিকার গলার সুরটা কেমন যেন অন্যরকম ঠেকলো মিনাক্ষীর কানে। তবুও নিজের উৎকণ্ঠাকে উপেক্ষা করে সে বলে, তোমার বাড়ি। তুমি যতদিন খুশি থাকতে পারো।
ওকে মম। আমি আজ ডিরেক্ট স্কুল থেকে তোমার কাছে আসছি। আর অন্য কোন কথা না বলেই ফোনটা কেটে দিল অম্বিকা।
অরুণ বাবু চুপচাপ সব শুনছিলেন। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বলতে থাকেন, যেমন একগুঁয়ে মা তেমনি তার একটা জেদি মেয়ে। মায়ের আস্কারাতেই তো মেয়ের এতো তেজ। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে উনিও জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার তোমার মেয়ে সাত সকালে কি বললো?
ফোনটা পাশে রেখে চায়ের কাপের চা-টা প্রায় এক বারেই শেষ করে ফেলে মিনাক্ষী। তারপর আস্তে আস্তে বলে, বেবু বিকালে আসছে। বেশ কিছুদিন থাকবে বলছে। জানো তো গলাটা কেমন যেন শোনালো ওর। কি জানি বাপু আবার কি হলো!
অরুণ বাবু বলে, আমি তো তোমাকে প্রথমেই বলেছিলাম মিনু। ওদের বিয়ে খুব একটা সুখের হবে না। দুজনেই সমযোগ্যতা সম্পন্ন। ব্যক্তিত্বের সংঘাত তো হবেই। তার ওপর সৌরভ একদমই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছে। অম্বিকা আর সৌরভের মানসিকতা কখনো মিলতে পারে!
মিনাক্ষী বলে, দেখি বিকালে এসে কি বলে শুনি। আগে থেকে এতো সিদ্ধান্ত না টানাই ভালো।
অরুণ বাবু আবারও মনে মনে বিরক্তি প্রকাশ করে ও বিড়বিড় করে বলে, তোমার এই বিজ্ঞভাবের জন্যই মেয়েটার জীবনে এতো অশান্তি। কোনোদিন কোনো ব্যাপারে মেয়েকে শাসন করলো না। বেশি শাসন করলে না কি ছেলে মেয়েরা বিগড়ে যায়। নাও এবার ভোগান্তির জন্য তৈরি হোও।
সারাটা দিন কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা মিনাক্ষীকে ছুঁয়ে রইলো। স্নান, খাওয়া সবই করছে ঠিকই কিন্তু মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে।
অম্বিকা তাদের একমাত্র সন্তান। কত না কষ্ট করে মেয়েটাকে বড়ো করেছে, নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছে মিনাক্ষী। অরুণ বাবুর তো বদলির চাকরি ছিল। কখনও পুরুলিয়া, কখনও বাঁকুড়া, কখনো আবার আসাম। এমন করেই তো চাকরি জীবনটা অতিবাহিত করেছেন উনি। শুধুমাত্র রিটায়ারমেন্টের আগে দু’বছর কলকাতাতে থাকতে পেরেছিলেন।
মিনাক্ষী একা হাতে মেয়ে, ঘর সংসার, নিজের চাকরি সব কিছু সামলেছে। একটা মাসের জন্য না বাপের বাড়ির কিংবা শ্বশুর বাড়ি থেকে কারোর কোনো সহযোগিতা সে পায় নি। এই নিয়ে বিশেষ কোনো আক্ষেপও সে করে না। মানসিকতার দিক থেকে সে বরাবরই খুব মজবুত।
অরুণ বাবুকে বিয়ে করে মিনাক্ষী যখন বাঁকুড়ার এক অজ পাড়াগাঁয়ে তার শ্বশুর বাড়িতে এসে পৌঁছায় তখন তার বাপের বাড়ির সকলে বলেছিল, এবার মিনু টের পাবে কত ধানে কত চাল। কলকাতা শহরের মেয়ে হলেও মিনাক্ষীকে কিন্তু একবেলার জন্য বেমানান লাগে নি তার শ্বশুর বাড়িতে।
সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যেই অম্বিকা স্কুল থেকে সোজা দমদমের বাড়িতে এলো। চোখ, মুখটা একদম বসে গেছে।
মিনাক্ষী বলে, কিরে এত রোগা দেখাচ্ছে কেন?
অম্বিকা বলে, ও তোমার চোখের ভুল। ৭০ কেজিই আছি। জিম জয়েন করেও এখনও পর্যন্ত এক কিলো ওজন কমলো না। তবে মনটা ভালো নেই তো তাই মুখটা শুকনো লাগছে। একটু ভালো করে আদা দিয়ে কড়ক চা বানাও সাথে ডিমের ওমলেট প্লিজ।
মিনাক্ষী হেসে বলে, ঠিক আছে। তুই ফ্রেশ হয়ে নে। আমি সব রেডি করছি।
ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যেতে অম্বিকা পিছন ঘুরে জিজ্ঞাসা করে, বাবা কোথায়? যদি বাড়িতে থাকে প্লিজ একটু বাজারে পাঠাও না। বাবা থাকলে তোমার সঙ্গে স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারি না।
মিনাক্ষী বলে, বাবা বাড়িতে নেই এই মুহূর্তে। তবে জানি না কখন আবার এসে পড়ে। একটু রিলায়েন্স ফ্রেশে পাঠিয়েছি।
অম্বিকা আর বাথরুমে না গিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারখানা টেনে মিনাক্ষীকে চেপে বসায় ও নিজেও বসে। তারপর শুরু করে, মা, বাবা একটা কথা কিন্তু ঠিক বলে যে সম্পর্ক সমানে সমানে করা উচিত।
মিনাক্ষী বলে, সৌরভের সাথে মানিয়ে চলতে তোর অসুবিধা হচ্ছে?
-শুধু কি অসুবিধা, দিন দিন নিজেদের মধ্যে এতো তিক্ততার সৃষ্টি হচ্ছে তোমায় কি বলবো। ছোটো খাটো বিষয় নিয়ে তুলকালাম কান্ড বেঁধে যাচ্ছে।স্কুল থেকে আমিও ক্লান্ত হয়ে ফিরি মা। আমারও রেস্ট দরকার। তার মধ্যে মাঝেমধ্যেই শ্বশুর, শাশুড়ি এসে থাকেন লম্বা। তাদের সামনে সৌরভকে কিছু কাজ করতে বললেই শাশুড়ি মায়ের গাল ফুলে যাচ্ছে।
আমি সৌরভকে বললাম, যতদিন তোমার মা বাবা থাকে ততদিন একটা রাঁধুনি রেখে দিই। সৌরভ বলে, রাঁধুনি রাখা মানে তো মাসে তিন হাজার টাকা বাড়তি একটা ফালতু খরচা। প্রতিমাসে বাড়ি, গাড়ির EMI বাবদ দিতে হচ্ছে ত্রিশ হাজার টাকা। তার ওপর মা বাবার ওষুধ পত্র বাবদ যথেষ্ট খরচা হয়। এতো খরচ চালানো সম্ভব নয়।
মা আমি তো চাকরি করি। আমার স্যালারি আমি কি নিজের প্রয়োজনে খরচা করতে পারি না! একটু আরাম করে থাকবো বলেই তো এত কষ্ট করে পড়াশোনা করে চাকরি জুটিয়েছি। কিন্তু বিয়ে করে একি ঝামেলায় পড়লাম।
মিনাক্ষী এতক্ষণে খুব ভালো করে বুঝতে পারছে অম্বিকা ও সৌরভের মনোমালিন্যের সুত্রপাত কোথা থেকে হয়েছে। মিনাক্ষী বলে, মোটামুটি হয়ে গেছে তোর কথা? এবার ফ্রেশ হতে যা। আমি চা রেডি করছি।
অম্বিকা বাথরুমের দরজা বন্ধ করা মাত্রই মিনাক্ষী সৌরভকে ফোন করে তাড়াতাড়ি এবং বলে রাইটার্স থেকে সোজা যেন সে দমদম চলে আসে। আরো বলে, অম্বিকাও এসেছে একটু আগে।সৌরভ আন্দাজ করে অম্বিকা নিঃশ্চয় রাগ করেই বাপের বাড়ি গেছে।
ফ্রেশ হয়ে একেবারে নাইট স্যুটটা পরেই ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো অম্বিকা। আগের থেকে অনেক খানি ঝরঝরে লাগছে। এসেই মাকে সব কথা বলে এবং গরম গরম ডবল ডিমের ওমলেট ও আদা দিয়ে কড়া চা খেয়ে তারও মনটা অনেকটা ভালো হয়ে উঠেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে, সৌরভও ডবল ডিমের ওমলেট খুব পছন্দ করে।
মিনাক্ষী বলে, ও আসলেই বানিয়ে দেবো।
অম্বিকা বলে, মানে?
মিনাক্ষী হেসে বলে, সৌরভও অফিস থেকে সোজা এখানে আসছে।
অম্বিকা বলে, মম কোনো মানে হয়। তোমাকে তো মনের কোনো কথাই আর খুলে বলা যাবে না দেখছি।
মিনাক্ষী বলে, তাই যদি মনে হয় বলিস না এবার থেকে। কিন্তু আমি তো তোর মা। কিভাবে মেয়ের সংসার ভাঙার ইন্ধন জুগিয়ে যাই। দেখ, অবিবাহিত ও বিবাহিত জীবনের মধ্যে অনেক তফাত। তুই নিঃশ্চয় জানিস সংস্কৃত ভাষায় বিবাহ শব্দের অর্থ- বিশেষ রূপে বহন করা। সেই বহনটা কিন্তু স্বামী স্ত্রী দুজনকেই করতে হবে। একে অপরের দোষ যতই খুঁজবি ততই অশান্তির সাগরে ডুববি। সৌরভ রাঁধুনি রাখতে বারণ করলো আর তা নিয়ে তুই মনকষাকষি শুরু করে দিলি! এতো ঠিক নয়।
তুই একটা শিক্ষিতা, চাকুরিরতা বিবাহিত মহিলা।তোর নিজস্ব মেরুদণ্ড থাকা দরকার। তোর প্রয়োজন তুই তোর স্বামীকে জানিয়েছিস। মানা না মানা সেটা তার ব্যাপার। তার জন্য তো প্রয়োজনটা বাতিল করা যাবে না। সংসার করতে গেলে কিছু সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে শিখতে হবে। সামান্য অশান্তি হলে হবে। তা বলে পালিয়ে বাঁচবি না কি?
বেবু, সৌরভকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণ তোমার নিজের ছিল। সেদিন কিন্তু তোমার বাবা আপত্তি করলেও আমি কিন্তু কোনো আপত্তি করি নি। বরং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম তুমি যেন তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে পারো।
অম্বিকা মিনাক্ষীকে জড়িয়ে ধরে বলে, মম, you are the best mom। ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া আমার জীবনের সেরা উপহার হলে তুমি। প্লিজ মা, তোমার ঈশ্বরের কাছে আমার জন্য একটু প্রার্থনা করো আমি ও যেন তোমার মতো ব্যক্তিত্বময়ী হয়ে উঠতে পারি।