শিবরাত্রি
-শম্পা সাহা
“তাড়াতাড়ি চলো বৌমা আর ভালো লাগছে না” তাড়াতাড়ি পা চালায় সরমা। আজ মহা শিবরাত্রি আটটায় চতুর্দশী লেগেছে। পঁয়ষট্টি বছরের সরমা আর তার বৌমা তিথি দুজনেই উপোস করে রয়েছে। সংকেত দুজনকেই বারণ করেছিল কিন্তু মা-বউয়ের এই জোটের সামনে তার কোনো মতামত এর কি কোনো মূল্য আছে? আগে মা ছড়ি ঘোরাতো এখন আবার তার সঙ্গে জুটেছে তিথি। এ বাড়িতে তাই সংকেত যাকে বলে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার।
বাড়ি থেকে মন্দির প্রায় সাত মিনিট হেঁটে। যদিও মোটরসাইকেলে আসতে পারতো তাহলে আবার বৌমা শাশুড়ি আলাদা হয়ে যেত তা আর সইবে কেন? তাছাড়া সঙ্গে ডাবের জল, দুধ, গঙ্গাজল, ফুল মালা, হাজার গণ্ডা জিনিস, তাই দুটিতে গুটি গুটি হাঁটা দিয়েছে আর সংকেত জাস্ট বডিগার্ড।
মন্দিরের সামনে আজকে পুজোর দিনে কয়েকজন ভিখারি জমেছে। পুণ্যার্থীরা পুজোর শেষে যদি কিছু দেয় এই আশায়। মন্দিরের বাঁদিকে একটি মেয়ে কোলে বাচ্চা। বাচ্চাটা ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে। দূর থেকেই ওর কান্নার আওয়াজ কানে আসছে। কাছে যেতে তিথির চোখে পরলো মা আর বাচ্চা। নোংরা হতদরিদ্র চেহারা, সামনে একটা বাটি, যদি ফলমূল কিছু পায় ।
তিথির এখনো কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি, যদিও সংকেত বা সরমা এ নিয়ে কোনোদিন কিছু বলেনি তবে তিথির প্রথম বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর থেকেই ওর মনে ভয় চেপে বসেছে। ও যদি আর কোনোদিন মা না হতে পারে! শাশুড়ি স্বামী দুজনেই বোঝায়, “এটা কি কোন ব্যাপার? এরকম আজকাল কত হয়! “কিন্তু তিথির ভয় যায় না। আজ তো শিবরাত্রি, এটাও একটা কারণ আজকের উপোসের। সন্তানের জন্যই তাদের মূলতঃ এখানে আসা।
মন্দিরের সামনে মা আর কাঁদতে থাকা বাচ্চাটাকে দেখে তিথির অপূর্ণ মাতৃহৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠলো। ওর কি মনে হল মেয়েটাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “ও কাঁদছে কেন? মেয়েটা একটু হকচকিয়ে গেল, সবাই আসে, যায় কেউ কেউ দু’ চার টাকা, একটা আধটা ফল ও দেয় কিন্তু বাচ্চার কান্নার কারণ তো কেউ জিজ্ঞাসা করে না! তাই মেয়েটি চুপ করে রইলো। “কিগো ও কাঁদছে কেন?” আবারও জিজ্ঞাসা। এবার মেয়েটি উত্তর দেয়, “খিদে পেয়েছে গো মা” কাঁচুমাচু অসহায় মা। “তা ওকে খাওয়াও!” মেয়েটি মাথা নিচু করে রইলো। তিথি মেয়েটিকে ভালো করে দেখলো, অপুষ্ট শরীর তার নিজেরই খাবার নেই তা আর বাচ্চাকে কি খাওয়াবে? সব বুঝে তিথি বললো, “তোমার ওই বাটিটা সামনের কল থেকে ধুয়ে নিয়ে এসো তো”
-“কেন বৌদি?”
-” যা বলছি তাই করো” তিথি ধমক দেয়। পুণ্যার্থীদের হাত পা ধোয়ার জন্য মন্দিরের ভেতরে যে কলটা ছিল, মেয়েটি ওখান থেকে বাটিটা ধুয়ে নিয়ে এল। তিথি ঘটি সম্পূর্ণ উপুড় করে দিলো মেয়েটির বাটিতে, তারপর সংকেতকে ডেকে বললো,”দুশোটা টাকা দাও তো” সংকেত একটু ধীর পায়ে হাঁটছিল, ওর তো আর খিদে পায়নি। ও এসে দেখে তিথি দুধটা ঢেলে দিলো মেয়েটির বাটিতে। ও তিথিকে ভালই চেনে তাই আর উচ্চবাচ্য না করে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে তিথির হাতে দুঊটো একশ টাকার নোট দিলো। তিথি মেয়েটির হাতে দিয়ে বললৈ, “এই নাও আজ, আর বসে থেকো না ,বাড়ি গিয়ে দুধটা গরম করে বাচ্চাকে খাইয়ে দাও।”
শাশুড়ি বৌমার দেরি দেখে বেরিয়ে এসে ডাকলো, “ও বৌমা দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!” তিথি প্রসন্ন মনে চললো শিবের মাথায় জল ঢালতে। ও শুনতে পেল হতভম্ব মেয়েটি তখন বলছে ,”ভগবান তোমার ভালো করুক মা, তোমার কোলে চাঁদের মত ছেলে আসুক।”
তিথি মন্দিরে ঢুকতে ঢুকতে ভাবলো আজ পূজো আর প্রার্থনার আগেই ওর বর পাওয়া হয়ে গেল। ও গিয়ে দাঁড়ালো পুণ্যার্থীদের লাইনে।