মায়া
-পায়েল সাহু
এলাটিং বেলাটিং শৈল,
কিসের খবর আইলো
রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো……
পাগলীটা গেয়ে যায় সারাদিন একই গান, ছেঁড়াখোঁড়া শাড়ি, বয়সের গাছ পাথর নেই, সে বুড়ি কি খায়, কোথায় থাকে কে জানে, কিন্তু রায়চৌধুরী বাড়ির চারপাশেই শুধু ঘুরে বেড়ায়, তাও আবার সন্ধ্যে হলেই।
রায়চৌধুরী বাড়ির সংলগ্ন বহু বছরের জাগ্রত শিব মন্দির, রায়চৌধুরী গিন্নী মানত করেছেন এবার যেন তার বৌমার অহনার গর্ভে একটি কন্যা সন্তান আসে।
একটু অবাক হলেন তো শুনে? সবার মতো পুত্র সন্তান কামনা না করে কন্যা কেন? সেটা জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকশো বছর।
অত্যাচারী উগ্র জমিদার দুস্মন্ত রায় চৌধুরীর শাসনে প্রজারা অতিষ্ঠ। খাজনা মেটাতে না পারলেই ঘরের বৌ ঝিদের ধরে নিয়ে যায় জমিদারের পেয়াদারা| বেশ কিছুদিন পর যখন ফিরিয়ে দিয়ে যায় তখন হয় কেউ জীবন্ত লাশ, নয়তো ফেরে মৃতদেহ হয়ে।
জমিদার বাবুর চারজন স্ত্রী, কেউই তাকে পুত্র সন্তান দিতে পারেননি, প্রতিবারই কন্যা জন্মেছে আর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মুখে নুন দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। তবু জমিদার বাবু আশা ছাড়েন না পুত্র সন্তানের, ফি বছর তাঁর একজন বা দুজন স্ত্রী গর্ভবতী হন। তার চতুর্থ স্ত্রীর এটি দ্বিতীয় সন্তান হতে যাচ্ছে।
আতঙ্কে আশংকায় রায় চৌধুরী ছোটো গিন্নী বাড়ির সংলগ্ন শিব মন্দিরে দিবারাত্র মাথা কুটে মরেন তার সন্তানের আয়ু কামনা করে|
যথা সময়ে তিনি একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেন। ধাই মা-রা জমিদারের কাছে সে খবর পৌঁছে দিলে জমিদার তার কন্যা সন্তানকে মেরে তৎক্ষণাৎ জলে ভাসিয়ে দেওয়ার হুকুম দেন।
ওদিকে আঁতুড়ঘরে জ্ঞান ফেরার পর ছোট গিন্নী সব শুনে কাঁদতে কাঁদতে জমিদারকে অভিশাপ দেন তাঁর বংশে এরপর থেকে শুধু পুত্র সন্তানই জন্মাবে, যে পরবর্তী কালে হবে তার পিতৃহন্তা। যদি কোনো ভাবে কখনো বংশানুক্রমে কন্যা সন্তান জন্ম নেয় এবং তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয় সেই কন্যা মুক্ত করবে এই অভিশাপ।
এরপর তিনি ওই শিব মন্দিরের ত্রিশূল বুকে ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করেন, শিবলিঙ্গ স্নান করে রক্তে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিশাপ ফলবতী হয়। জমিদার দুস্মন্ত রায়চৌধুরীর ছেলে জন্মায়, নির্বাণ রায়চৌধুরী। সেও বাবার মতোই অত্যাচারী হয়ে ওঠে। ছোটো থেকেই তার বাবার পাওয়া অভিশাপ সম্পর্কে সে বেশ ভালোই অবগত। আর তাই তিনি অভিশাপ খন্ডনের জন্য হয়ে ওঠেন পরম শিবভক্ত। কিন্তু এই শিব পূজা নিয়ে তার বাবা দুস্মন্ত রায়চৌধুরীর সঙ্গে চরম মতবিরোধ শুরু হয়, এমন কি দুস্মন্ত মন্দিরটি ভেঙে ফেলারও হুকুম দেন, তখন নির্বাণ গুপ্তচর লাগিয়ে নিজের বাবাকে হত্যা করেন।
এরপর নির্বাণ যথাসময়ে বিবাহ করেন, এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস যে তার শিবভক্তির কারণে অভিশাপ কিছুতেই ফলবে না, কিন্তু তার পুত্র সন্তান জন্মের রাতেই সাপের কামড়ে তিনি মারা যান।
এরপর থেকে শুরু হয় এক অলৌকিক ঘটনা। প্রতি রাতে প্রবল ঘন্টাধ্বনি সহকারে শুরু হয় শিবের মন্দিরে পূজা। পূজারীকে দেখা যায় না কিন্তু প্রতিদিন সকালে শিবলিঙ্গের ওপর ফুল মালা দেখা যায়। সকলের মনে হতে থাকে জমিদার নির্বাণ রায়চৌধুরীর আত্মা আসেন পুজো করে নিজের বংশের অভিশাপ খণ্ডন করতে। সেই থেকে আজও এই অলৌকিক ঘটনা ঘটে চলেছে।
জমিদারের জমিদারি বহুদিন অবলুপ্ত, কিন্তু বংশের একমাত্র পুত্র সন্তান যখনই পরবর্তী কালে পুত্র সন্তানের পিতা হন, তারপরেই কোনো না কোনো কারণে তিনি মারা যান।
এই বাড়ির নববধূ অহনা, তার জন্মকাহিনীও বেশ অদ্ভুত। সদ্যজাত মেয়েটি পড়ে ছিলো আস্তাকুঁড়ে আর একটি বিরাট সাপ ফণা তুলে তাকে পাহারা দিচ্ছিলো। অনেক মানুষ ভক্তিভরে তাকে দুধ কলা দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে, বাচ্ছাটিকে নেওয়ার প্রয়াস করলেও সেই চেষ্টা বিফল হয়।
সেই রাতে ওই পথ দিয়ে ফিরছিলেন এক নিঃসন্তান দম্পতি। জায়গাটি তখন প্রায় জনশুন্য, শিশু কন্যাটিকে দেখে তাঁদের চোখে জল এলেও তাঁরা সাপের ভয়ে এগোতে পারেননি, দূর থেকে প্রণাম করে চলে যাচ্ছিলেন, আর তখনই হঠাৎ সেই সাপ ফণা নামিয়ে চলে যায়। ঈশ্বরের দান মনে করে সেই কন্যাসন্তানকে তাঁরাই লালন পালন করেন। কিন্তু কখনোই এই মেয়েকে তার জন্ম বৃত্তান্ত জানতে দেন নি।
অহনা এ যুগের মেয়ে, যথেষ্ট শিক্ষিতা এবং চাকুরীরতা, সব কিছু জেনে শুনেই সে রায়চৌধুরী বাড়ির ছেলে প্রলয়কে বিয়ে করেছে | বিয়ের পর থেকে শ্বশুর বাড়ির সন্নিকটের এই শিব মন্দিরের অলৌকিক ঘটনা দেখে আসছে এবং বহুবার চেষ্টা করেছে সন্ধে থেকে মন্দিরে গিয়ে সারারাত কাটিয়ে এই রহস্যভেদ করতে। অহনার আগে যারাই এই রহস্যভেদ করার চেষ্টা করেছে তাঁদের প্রত্যেকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে পরের দিন ভোরবেলা। কিন্তু অহনা যেদিন রাতেই মন্দিরে থেকেছে সে রাতেই আশ্চর্য জনক ভাবে এতো বছরের অলৌকিক ঘটনা ঘটেনি শুধু কিছু ফুল মালা পাওয়া গেছে মন্দিরের দরজায়।
বিয়ের বছর দুই পরে অহনা এখন সন্তান সম্ভবা আর নিজের ছেলের প্রাণভিক্ষার জন্যই রায়চৌধুরী গিন্নী কাতর প্রার্থনা করে চলেছেন যাতে অহনার গর্ভে কোনো পুত্র সন্তান না আসে কারণ বংশের অভিশাপ অনুযায়ী পুত্র সন্তান জন্মালেই তার ছেলের মৃত্যু ঘটবে।
অহনা আজকাল একটু চিন্তায় থাকে, শাশুড়ির কান্না আর রাতদিন ঠাকুর পুজোয় সে ভাবতে থাকে তবে কি সে গর্ভবতী হয়ে ভুল করলো? বিশেষ করে যখন থেকে জানা গেছে তার গর্ভে একটি নয়, দুটি সন্তান, শাশুড়ি পুজো করা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁর স্থির বিশ্বাস নিশ্চয়ই দুটোই ছেলে হবে যদিও প্রলয়ের কোনো ভাবনা চিন্তা নেই, “যা হবে দেখা যাবে” একথা বলে সান্তনা দেয় মা আর বৌকে।
এসব ভাবতে ভাবতেই অফিস থেকে ফেরার সময় একদিন অহনা আনমনে হাঁটার সময় রাস্তায় হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হতেই আচমকা দুটো শক্ত হাত তাকে জড়িয়ে ধরে। অবাক হয়ে অহনা দেখে তার বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায় যে পাগলিটা সন্ধ্যে হলেই; সে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছে, অদ্ভুত সুন্দর এক গন্ধ সেই পাগলীর গায়ে, কেমন যেন “মা মা গন্ধ” অহনা নিজেকে সামলে কিছু বলে ওঠার আগেই পাগলীটা ওকে ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি কোথায় যেন চলে যায়।
সেদিনের পর থেকে ওই পাগলীটা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো।
ঠিক এর একমাস পরে একদিন ভোর রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসে অহনা।
স্বপ্নে সে দেখে ভীষণ সুন্দরী এক বিবাহিতা রমণী তাকে এসে বলছে “তোর গর্ভে আমার মেয়ে ফিরে এসেছে রে মা, তবে আমার অভিশাপ অনুযায়ী একটি ছেলেও আছে তোর গর্ভে, বহু বছর আগে যে অভিশাপ আমি দিয়েছিলাম তা যদি খণ্ডন করতে চাস তবে তোর ছেলের জন্মের একমাস পর শিব মন্দিরের লিঙ্গ ওই ছেলের রক্তে স্নান করাবি, তবেই সারাজীবনের মতো শাপমুক্তি ঘটবে” এই কথা বলে তিনি মিলিয়ে যান।
স্বপ্নে দেখা রমণী অহনার অচেনা হলেও তাঁর চোখের দৃষ্টিটা যেন সেদিনের সেই পাগলীটার মতোই।
এমন ভয়ানক শাপ মুক্তির কথা ভাবতেই শিউরে ওঠে অহনা, তবু কাউকে কিছু না বলে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় শিব মন্দিরের দিকে।
মন্দিরে গিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওখানেই জ্ঞান হারায়। বেশ কিছুক্ষণ বাদে অনেক লোকের হইচই শুনে তার জ্ঞান ফিরলে সে দেখে তার মাথার কাছে বিরাট বড়ো এক সাপ ফণা তুলে বসে আছে আর তাই দেখে মন্দিরে পুজো দিতে আসা লোকেরা হৈচৈ করছে।
অহনা ধীরে ধীরে উঠে বসতেই সাপটা কোথায় যেন চলে যায়। এই ঘটনা চারদিকে চাউর হয়ে যেতে অহনার মা বাবা এসে অহনার জন্ম বৃত্তান্ত জানান অহনার শ্বশুর বাড়িতে এসে। সমস্ত কথা শুনে অহনা মনে এক অদ্ভুত জোর পায়। তার মনে হয় ভগবান তার সহায়, কোনো বিপদ আর তার হবে না। যদিও তার স্বপ্নের কথা সে বাড়ির কাউকে জানায় না, মনে মনে ঠিক করে সে এর শেষ দেখে ছাড়বে।
নিদির্ষ্ট সময়ে অহনা তার যমজ সন্তান একটি ছেলে ও একটি মেয়ে প্রসব করে।
বাড়িতে খুশির ঢেউ বয়ে যায়। ঠিক একমাস পর এক রাতে অহনা তার ছেলেকে নিয়ে সবার অগোচরে উপস্থিত হয় সেই মন্দিরে, ঠিক যখন সেখানে প্রবল ঘন্টাধ্বনি সহকারে সেই অলৌকিক পূজারী পূজা করে চলেছেন। অহনা মন্দিরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে মন্দির শান্ত হয়ে যায়, কোথাও কোনো শব্দ নেই আর। নিজের বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটার শব্দ ছাড়া অহনা আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না তখন।
নিজের স্বামীর মঙ্গল কামনায়, শ্বশুরবাড়ির অভিশাপ কাটাতে চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আজ | স্বপ্নে পাওয়া আদেশ অনুযায়ী সে তার ছেলেকে তুলে ধরে মন্দিরের শিব লিঙ্গের ঠিক উপরে, চোখ বন্ধ করে অঞ্জলি দেওয়ার মতো করে ছেলেকে ফেলে দেয় শিব লিঙ্গের ওপর। ঠিক পরমুহূর্তেই তীব্র কান্নার আওয়াজ শোনার জন্য যখন সে প্রস্তুত, কোনো আওয়াজ না পেয়ে সে তাকিয়ে দেখে সেই পাগলী নিজের কোলে শুইয়ে আদর করছে অহনার ছেলেকে, আনন্দে চিৎকার করে উঠে পাগলীর পা ধরে কেঁদে ফেলে অহনা।
“ওঠ মা, আমি পারলাম না তোর সন্তান কেড়ে নিতে। বহু বছর আগে স্বামীর অত্যাচারে সন্তান হারানোর শোকে যে অভিশাপ দিয়েছিলাম, আজ তোর কোলে সন্তান ফিরিয়ে দিয়ে তার শাপমুক্তি ঘটালাম।” অহনা দেখে কোথায় সেই পাগলী ভিখারি, এক অপরূপা রমণী তার কোলে ছেলেকে তুলে দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গন ছেড়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছেন। “মা যেও না, যেও না, দাঁড়াও..” বলে চিৎকার করে ওঠে অহনা।
ততক্ষণে ভোর হয়েছে, অহনা আর ছেলেকে বাড়িতে কোথাও দেখতে না পেয়ে প্রলয় ছুটে এসেছে মন্দিরে।
অহনা সব কথা খুলে বলে প্রলয়কে।
দুজনে সাষ্টাঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেবকে প্রণিপাত করে শাপমুক্ত জীবনের সূচনা করে।
তারপর থেকে মন্দিরে আর কোনোদিন রাতে কেউ ঘন্টাধ্বনি শুনতে পায় নি।