হাঁটুর নিচে বুদ্ধি
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
পুরীর এক অত্যাধুনিক হোটেলের লবিতে একটি সাতাশ আটাশ বছরের যুবতী তার পায়ের হাই হিল স্যান্ডেল খুলে বেদম প্রহার করছে এক ত্রিশ বত্রিশ বছরের যুবককে। এই কাণ্ড দেখতে বেশ কিছু কৌতুহলী লোকজনও জমা হয়ে গেছে। সবার জিজ্ঞাসু মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এদের মধ্যে আসল সম্পর্কটা কি?
একজন বলে, নিঃশ্চয় ছেলেটা মেয়েটার সঙ্গে কোন অশালীন ব্যবহার করেছে।
আবার কেউ বলে, ছেলেটা নিঃশ্চয় মেয়েটাকে ধোঁকা দিয়েছে। হ্যান্ডসাম ছেলেদের তো মেয়েদেরকে নিয়ে খেলা করাই কাজ। এইসব নানা চটপটা খবরে ভরে উঠেছে হোটেলের লবি খানা।
তবে যে মারছে আর যে মার খাচ্ছে তাদের কিন্তু এইসব জমায়েতের দিকে কোন লক্ষ্য নেই।যুবকটি বারবার কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে মেয়েটিকে। কিন্তু মেয়েটি অবুঝের মতো বলেই চলেছে, তুই এখানে হানিমুন করতে এসেছিস না মেয়ে দেখতে?
হোটেলের ম্যানেজার ছুটে আসে ঘটনাস্থলে। তিনি যুবতীটির সামনে হাতজোড় করে বলেন, মিসেস চ্যাটার্জী, প্লিজ এইভাবে সিনক্রিয়েট করবেন না। এতে না আপনাদের ভালো হচ্ছে না আমাদের হোটেলের।
একজন পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক একটু আগবাড়িয়ে এসে ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করে, কি ব্যাপার বলুন তো। লবির মধ্যে এইসব কি? একটা রেপুটেড হোটেলের লবিতে এইরকম ঘটনা অবাঞ্ছনীয়।
ভদ্রলোকের কথা শেষ হতে না হতেই যুবতীটি ভদ্রলোকের ওপর সমুদ্রের বিশালাকার ঢেউএর মতো আছড়ে পড়ে বলে, দেখুন মিস্টার, ইটস আওয়ার ম্যাটার। ডোনট নিড টু ইন্টার ফেয়ার। উই আর হ্যাজব্যান্ড এ্যান্ড ওয়াইফ। ডু নট থিংক আদার ওয়াইজ।
যুবতীটির এই শব্দগুলো উপস্থিত কৌতুহলী চোখগুলোকে নিমেষে আরাম দিল। এক মধ্য বয়ষ্কা মহিলা বলে উঠলো, ওওওও স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার। তাহলে তো কারোর কিছুই বলার বা ভাবার দরকার নেই তেমন। তবুও বলি এটা তো পাবলিক প্লেস। তোমরা হোটেলের রুমে গিয়ে বাকি ঝগড়াটা কমপ্লিট করো।
এবার ক্রদনরত অবস্থায় যুবতীটি বলে ওঠে, আন্টি ইউ নো, আমাদের মাত্র দশদিন বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যেই আমার স্বামীর চোখে আমার থেকে অন্য মেয়েকে সুন্দরী লাগা শুরু হয়ে গেছে। আই কান্ট ইমাজিন!
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি যুবতীটির দুঃখে সমব্যথী হয়ে সমবেদনা পূর্ণ নিজের হাত খানি বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ইউ আর লাকি মাই চাইল্ড। তাও তো দশদিন মুগ্ধতা ছিল তোমার স্বামীর চোখে। আমার বিয়ের রিসেপশনেতেই আমার হ্যাজব্যান্ড আমাকে বাদ দিয়ে যেভাবে তার সুন্দরী সব অফিস কলিগদের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিল। আলাপ পরিচয়ের সময় উনি তার বান্ধবীদের জন্য যে যে এ্যাডজেকটিভগুলো ব্যবহার করেছিলেন তা শুনে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল।
আন্টি, সর্বকালের সব পুরুষই বোধহয় একরকমের হয় তাই না। মেয়েদের ফিলিংস নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আপনি সেদিন মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছিলেন। সেটা আপনার দুর্বলতা। আমি কিন্তু মোটেই সে বান্দা নই।
যুবকটির মুখ দেখেই মনে হচ্ছে জীবনে বোধহয় এতো অসহায় অবস্থায় সে আগে কখনও পড়ে নি। মধুচন্দ্রিমায় এসে নতুন বৌয়ের প্রখর তেজে ঝলসে যাচ্ছে তার চোখ মুখ।
কিন্তু এই যুবকটি তো মোটেই কোনো সাধারণ, পাতি, গো বেচারা যুবক নয়। সে হচ্ছে বর্ধমান শহরের একজন নামকরা চাইল্ড স্পেশালিস্ট।এম. বি. বি. এস. পাশ করার পর বর্ধমানের একটি সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে যুক্ত হয় অনির্বাণ চ্যাটার্জী।
ছয় ফুটের কাছাকাছি হাইট, ফেয়ার কমপ্লেকশন, মেদ হীন চেহারা, টিকালো নাক। এককথায় সুপুরুষ। অনির্বাণ যেদিন থেকে সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগদান করেছে সেই দিন থেকে রোগীর সমাগমও যথেষ্ট। শুধু কি রোগী পাত্রীর বাবা, কাকা? মেসো-রাও হাজির হয়ে যাচ্ছে সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সুন্দর মানবের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ কাজ করে। সুন্দর মানুষকে কাছে পাওয়া, একটু বার্তালাপ কে না চায়।
অনির্বাণের প্রতি মেয়েদের যে একটা দুর্বলতা আছে এটা অনির্বাণ বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতো। ডাক্তারি পাশ করার পর থেকেই মেয়ের বাবাদের আনাগোনার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল তাদের বাড়িতে। স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষিতা সুন্দরী মেয়েদের ফটোতে ভরে উঠতো অনির্বাণের স্টাডি টেবিল।
অনির্বাণের বিয়ের সম্বন্ধটা নিয়ে এসেছিল তার লতু মাসি। অনির্বাণের শুধুমাত্র শিক্ষিত, সুশ্রী মেয়ে হলে চলবে না পাত্রীর পরিবারকেও উচ্চশিক্ষিত হতে হবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এই রকম পাত্রী ও পরিবার পাওয়া গিয়েছে। লতু মাসির ননদের বড় জায়ের ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে লাজবন্তী। নামের সাথে যদিও কামের কোন মিল নেই। তবুও বিয়ের আসরে লাজবন্তীকে দেখে অনির্বাণের লাজুক লতাই মনে হয়েছিল।
লম্বা, ফর্সা, ডাগর চোখ দুটি দেখে অনির্বাণ নিমেষে হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে। একে সুন্দরী, দুই উচ্চ শিক্ষিতা। তবে শিক্ষিত এই বিষয়টিতে অনির্বাণের বদ্ধমূল ধারণা ছিল- এ্যাকাডেমিক কেরিয়ার ভালো হতেই হবে।
কিন্তু স্কুল কলেজের জীবনে ভালো নাম্বার পেয়ে পাশ করা আর গার্হস্থ্য জীবনে পাশ দেওয়ার মধ্যে যে বিরাট ফারাক আছে তা বোধহয় ডাক্তার অনির্বাণ চ্যাটার্জী জানতেন না। চিরকালই নিজের গর্ভধারিনীকে দেখেছেন হাসিমুখে শত অসুবিধাকে মানিয়ে নিতে। তাই অনির্বাণের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বোধহয় মেয়েদেরই সহজাত। ছোট থেকে অনির্বাণ তার বাবার মুখে শুনে আসছে মেয়েদের বুদ্ধি হাঁটুর নিচে থাকে। এই কথাটার মধ্যে পরিষ্কার লুকিয়ে রাখা হয়েছে মেয়েদের অবমাননার এক অধ্যায়।
লাজবন্তী অনির্বাণকে প্রথম দর্শনেই বুঝেছিল, এই ছেলে অহংকারে পরিপূর্ণ। অনির্বাণ পাত্র হিসেবে বিয়ের বাজারে ভীষণ দামী তা তার হাবে ভাবে ফুটে ওঠে সব সময়।
লাজবন্তীও সাদা কালো বাংলা ছবির নায়িকা সুলভ আচরণে কখনো নিজেকে জড়িয়ে রাখে নি। স্পষ্ট কথা শুনতে ও বলতে লাজবন্তীর কোন সংকোচ নেই।
ফুলশয্যার রাতে অনির্বাণ লাজবন্তীর অনামিকায় পড়িয়ে দেয় একটি হীরের আংটি। আংটিটা আঙ্গুলে পড়ে কয়েকবার বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে দেখে লাজবন্তী বলে উঠেছিল, হীরেই যখন কিনলে তখন সাইজটা একটু বড় কেনা গেল না।
নতুন বৌয়ের মুখে এই রকম কথা শুনে অনির্বাণ প্রথমে একটু চমকে ওঠে। অনির্বাণ কিছু বলার আগেই লাজবন্তী আরো বলে, যদি বাজেট কমই ছিল তা হলে শুধু সোনার আংটি দিলেই চলে যেত। কমসে কম সেটা একটু বড় হতো।
ফুলশয্যার রাতেই অনির্বাণ লাজবন্তীর কথার রাশ খানা টেনে ধরার চেষ্টা করেছিল। গুরুগম্ভীর আওয়াজে অনির্বাণ বলেছিল, তোমার পছন্দ হয়নি এটা বললেই চলতো। এত
ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বললেই হতো।
লাজবন্তী একটু মৃদু হাসি দিয়ে বলেছিল, স্পষ্ট কথা বলা সহজ কিন্তু স্পষ্ট কথা হজম করা কঠিন। আজকের ঘটনায় হোটেলের লবিতে বসে অনির্বাণ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছে লাজবন্তীর সেদিনের কথাখানি। স্পষ্ট কথা যে মাঝে মাঝে চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে তা সে যথেষ্ট বুঝতে পারছে।
মন তো মনই হয়। নারী কিংবা পুরুষ যারই হোক না কেন। সদ্য বিবাহিত বউ-এর কাছে অন্য মেয়ের রূপের প্রশংসা করতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে ডাক্তার অনির্বাণ চ্যাটার্জী। মেয়েদের বুদ্ধি হাঁটুর নিচে নয় সেটা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। মেয়েদের বুদ্ধি পুরুষদের কাঁধ স্পর্শ করেছে।
নারীদের বাস্তব বুদ্ধি, সাংসারিক বুদ্ধি পুরুষদের থেকে কোন অংশে কম নয় বরং বেশি বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। স্বামীর সংসার, সংসারের প্রতিটি মানুষকে অবলীলায় আপন করে তুলতে পারেন নারী। হাঁটুর নিচে বুদ্ধি এই প্রবাদটিকে যদি সদর্থক ভাবে দেখা যায়, তাহলে বলতে হয় নারী তার ইগো, নারী তার আমিত্ব, নারী তার অহংকার, নারী তার হিংসা লালসা এই সব ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তিগুলোকে কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয় না। সর্বদায় হাঁটুর নিচে রাখার চেষ্টা করে।
হোটেলের লবিতে লাজবন্তী কাছে বেদম মার খেয়ে অনির্বাণ তার বাকি জীবনে বাকসংযমকে জীবনের মূলমন্ত্র করবে ভেবে নিয়েছে। আর ভুলেও কখনো সংযম হীনতার কথা সে বলবে না।
হঠাৎই অনির্বাণের গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছিল একটু জলের জন্য। একটু জলের জন্যই এদিক ওদিক ঘুরে দেখেতেই সে দেখে সে তো হোটেলের লবিতে নেই সে তো তার হোটেলের রুমের বিছানায় শুয়ে আছে। পাশে লাজবন্তী।
অনির্বাণ সোজা হয়ে বিছানার উপর উঠে বসে। একি এতক্ষণ তাহলে সে স্বপ্ন দেখছিল! স্বপ্নের মধ্যে তাহলে লাজবন্তী সবার সামনে তাকে বেদম মারছিল। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, যাক বাবা। সবটাই স্বপ্ন ছিল তাহলে।
অনির্বাণকে উসখুস করতে দেখে আলস্য জড়ানো গলায় অনির্বাণের কোমরে হাত রেখে লাজবন্তী বলে, হোয়াট হ্যাপেন হানি? এনিথিং রং?
অনির্বাণ লাজবন্তী দিকে ঘুরে বলে, এভরিথিং ইজ অলরাইট বেবি। বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা গ্লাস ভর্তি জলটা নিমেষে শেষ করে। তারপর লাজবন্তীকে জড়িয়ে ধরে চুপটি করে শুয়ে পড়ে।
ভোররাতের এই উদ্ভট স্বপ্ন থেকে অনির্বাণ যে বিশেষ শিক্ষা লাভ করেছে তার কথা লাজবন্তীর কাছে একদম চেপে গেল। অনির্বাণ শুনেছে ভোরের স্বপ্ন দেখে যদি ঘুম ভেঙে যায় আর তারপর যদি আর ঘুম না আসে তাহলে সেই স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। তাই অনির্বাণ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এইরকম ভোরের স্বপ্ন কোনদিন সে সত্যি হতে দেবে না। তার বাবার যুগ আর নেই। মেয়েদের বুদ্ধি হাঁটুর নিচে মোটেই নয়। বরং মেয়েদের বুদ্ধির তল পাওয়াই মুশকিল।