গল্প – স্নেহের পরশ

স্নেহের পরশ
– জয়তী মিত্র

প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে শাশুড়ি মায়ের জন্য একটা জামদানি শাড়ি কিনলো সুমি। জামদানি শাড়ি শাশুড়ি মায়ের খুব পছন্দ। বাড়ি এসে শাশুড়ি মাকে প্রণাম করে শাড়ির প্যাকেটটা ওনার হাতে দিল সুমি আর বললো,”এই নাও মা এটা তোমার উপহার, তোমার জন্যই আজ আমি এই জায়গায় পৌঁছেছি। তোমার অনুপ্রেরণা না পেলে চাকরী পর্যন্ত পৌঁছাতাম না। তুমি আমাকে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে শিখিয়েছ মা।”
অনিতা দেবী বৌমাকে আশীর্বাদ করে বললেন, “তুই আরো এগিয়ে যা, আমি তোর সাথে সবসময় আছি।”

অনিতা দেবী নিজে দেখে তার একমাত্র ছেলের বউ করে নিয়ে এসেছিলেন সুমিকে। ওনার ছেলে সৌরভ একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চ পদে চাকরি করে। বছর দুয়েক হলো অনিতা দেবীর স্বামী মারা গেছেন। মা ছেলের সংসার। অনিতা দেবীর একটা ছোট্ট আঁকার স্কুল আছে। সেখানে তিনি বাচ্চাদের আঁকা শেখান।
সুমিকে তিনি কখনোই বৌমা ভাবতেন না। নিজের মেয়ে ভাবতেন। আর সুমিকে তিনি তুই বলে ডাকতেন। খুব স্নেহ করতেন সুমিকে। সৌরভ ও সুমিকে খুব ভালোবাসত। উইকেন্ডে ঘুরতে নিয়ে যেত, রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে যেত। বেশ ভালই কাটছিল দিনগুলো। কিন্তু চাকরির নাম শুনলে সৌরভের মাথা গরম হয়ে যেত সৌরভ বলতো, “আমার তো বেশ ভালো স্যালারি, তোমার চাকরির কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি মায়ের সাথে বাড়ীতে রান্না বান্না শেখো, সংসারের কাজ কর্ম শেখো, বাইরে বেরোবার তোমার দরকার নেই।”
ছেলের এই কথায় অনিতা দেবী রেগে গিয়ে বলতেন,”সুমি চাকরী করবেই, এম এ পাশ করে কি ঘরে বসে থাকবে, তাছাড়া আজকাল যা যুগ পড়েছে প্রত্যেক মেয়ের চাকরির প্রয়োজন আছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মেয়েদের খুব দরকার।” মায়ের এই কথা শুনে সৌরভ রেগে গিয়ে বলতো, “তোমার আস্কারা পেয়ে সুমি মাথায় উঠেছে, যা খুশি করো তোমরা, আমার কিছু বলার নেই।” সুমি এসে শাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তুমি পাশে থাকলে আমি সব পারবো মা। সুমি ভাবে তার শাশুড়ি মা কত আধুনিকমনস্কা। আর তার মা তো খালি বলতো,”এত পড়ে কি হবে! সেই তো রান্নাঘরে কাটাতে হবে।” দুই মায়ের মধ্যে মানসিকতার কত তফাৎ। মনে মনে সুমি ভাবত, সে সত্যিই খুব ভাগ্যবতী, না হলে এমন শাশুড়ি মা পায়।

দুই, তিন জায়গায় পরীক্ষা দেবার পর স্কুলের চাকরিটা পায় সুমি। শাশুড়ি মা খুব খুশি হয়, সৌরভের খুব একটা ভালো লাগে না। আজকাল সৌরভের সুমির হাতের রান্নাও পছন্দ হয় না। রান্নার প্রতি সুমির খুব আগ্রহ ছিল। শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে অনেক রান্না শিখেছিল। সুমির হাতের “ইলিশ ভাপা” খেতে খুব পছন্দ করত সৌরভ। আজ সৌরভ খাবার টেবিলে বসে চিৎকার করে উঠলো আর বললো, “এটা কি রান্না করেছো সুমি, আজকাল খুব বাজে হচ্ছে তোমার রান্না।” সুমি খেয়ে বললো, “কেন ভালই তো রেঁধেছি, আজ রবিবার, আজ সব পদ আমি রান্না করেছি। আসলে তোমার আজকাল আমার রান্না মুখে রোচে না। গত রবিবার তোমার পছন্দের রুটি আর চিলি চিকেন রান্না করলাম, তুমি বাইরে খেয়ে এলে। তুমি আজকাল আমাকে আর আগের মত ভালোবাসো না।”

ছেলে বৌমার ঝগড়া শুনে অনিতা দেবী ভাবলেন, তার বান্ধবী রিনা তাহলে ঠিকই বলেছে। সৌরভকে রিনা সুস্মিতা নামের একটি মেয়ের সাথে দুদিন ঘুরতে দেখেছে শপিং মলে। সুস্মিতাকে রিনা চেনে। এই কারণে বৌমাকে আর ভালো লাগছে না ছেলের। আজই এর বিচার করতে হবে। সুমির সাথে ছেলের এই বাজে ব্যাবহার কিছুতেই তিনি বরদাস্ত করবেন না।
ছেলেকে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “সুস্মিতা কে?” ছেলে তো আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললো, “কি সব উল্টো পাল্টা বলছো মা।” অনিতা দেবী বললেন,”আমি ঠিকই বলছি, আমার বান্ধবী রিনা তোদের শপিং মলে দেখেছে। সৌরভ দেখলো, ও ধরা পড়ে গেছে মায়ের কাছে,আর লুকানোর উপায় নেই। মায়ের চাপে বাধ্য হয়ে মুখ খুললো, “সুস্মিতা আর আমি একই কলেজে পড়তাম, দুজনে দুজনকে ভালবাসতাম। কিন্তু কেউ কাউকে সে কথা কোনোদিন বলি নি। আজ চার মাস হলো সুস্মিতা আমাদের অফিসে জয়েন করেছে।” মাঝখানে বহু বছর ওর সাথে যোগাযোগ ছিল না। আর ওর কোনো ফোন নম্বরও আমার কাছে ছিল না। অনেকদিন বাদে অফিসে দেখা।”
মা ছেলের এই এই কথা শুনে সুমি বললো, “মা তোমার ছেলের সাথে এক সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আমি কাল আমার বাবা মায়ের কাছে চলে যাব।”
” না সুমি তুই কোথাও যাবি না। তুই এই বাড়িতেই থাকবি। আর সৌরভ এই বাড়ি আমার। তুই আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি।” সৌরভ বললো,”সুমির জন্য তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিলে মা!” অনিতা দেবী বললেন,”তুই বিবাহিত হয়ে রাস্তা, ঘাটে প্রেম করে আমার মান সম্মান নষ্ট করবি আর আমি তোকে আদর করবো? সুমিকে আমি দেখে এনেছি, ওর ভালো মন্দ আমাকে দেখতে হবে।” সুমি বললো, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে ডিভোর্স দিও। আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম।”
অনিতা দেবী সুমিকে বললেন, “আজ থেকে তুই আর আমি এই বাড়ীতে থাকবো। আমি আবার তোর বিয়ের ব্যাবস্থা করে তোর নতুন সংসার সাজিয়ে দেব, আজ এই প্রতিজ্ঞা করলাম। আমি তোর মা, তোর সুখে থাকার রাস্তা যে আমাকেই খুঁজে দিতে হবে।” সুমি শাশুড়ি মা-কে ধরে খুব কাঁদল। সৌরভ যে তার স্বামী, এত সহজে কি তাকে ভোলা যায়? অনিতা দেবী বললেন,”কাঁদিস না, তোকে অনেকদূর যেতে হবে, সৌরভ যদি তোকে ভুলে অন্য মেয়ের হাত ধরতে পারে তাহলে তুই কেন ওকে ভুলতে পারবি না। সামনের দিকে তাকা, পিছন দিকে নয়। নে খাবার টেবিলে চল, আমি তোর খাবারের ব্যাবস্থা করছি”
সুমি বললো,”আসছি মা।”

Loading

Leave A Comment