একটি অবিশ্বাস্য চিঠি
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
ঘরের দরজা পুলিশ এসে ভাঙলো।
ফ্ল্যাটের মালিক, বাদল বাবু। এখন একাই থাকেন। ত্রিশ ঘন্টা অতিবাহিত। দরজা খোলেন নি। ডেকেও সাড়া পাওয়া যায় নি। কিছু গোলমাল নিশ্চয়ই। সময় বদলে গেছে। বদলে গেছে প্রতিবেশী মন। জর্জরিত জীবন। উটকো ঝঞ্ঝাট কে আর গায়ে পড়ে নিতে চায়! যাদের কাজ তারাই করুক।
বাদল ব্যানার্জির দেহ, পাখায় ঝুলন্ত। ধরাধরি করে নামিয়ে খাটে শুইয়ে দেওয়া হলো, লাশ।
হ্যাঁ, লাশ। মরণের পরে ওই একটাই নাম।
লাশ কিংবা বডি।
নাম নেই, ধর্ম নেই, জাত নেই। শুধুই লাশ।
পরনে পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি। একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
কত হবে বয়স..হ্যাঁ, সত্তর তো বটেই। একাই থাকতেন ইদানীং।
স্ত্রীকে হারিয়েছেন অনেকদিন আগেই। তারপর থেকেই বাপ ছেলের সংসার।
বিশাল সাজানো গোছানো সুদৃশ্য ফ্ল্যাট। মাত্র কয়েক বছর আগেও গমগম করতো। কত মানুষের যাতায়াত। জন্মদিন পার্টি। নারী পুরুষের সমবেত রাতজাগা হুল্লোড়। আজ নিস্তব্ধ।
আনন্দ স্মৃতিগুলো কালের নিয়মে ইতিহাস হয়ে যায়। বেদনার জন্ম দেয়।
স্ত্রীকে হারানোর শোক তাকে ভেতরে ভেতরে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল। যদিও, তা তিনি কখনও মুখে প্রকাশ করেননি। তবুও তার আচরণে আভাস পাওয়া যেতো সবই।
মন পোড়া গন্ধ বোধকরি গোপন থাকে না।
কিন্তু, ছেলের জন্যেই সব কষ্ট দুঃখ একপাশে সরিয়ে রেখে তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। অবিশ্যি তার কারণ একটা ছিল।
স্ত্রীর ভারি ইচ্ছে ছিল, তাদের একমাত্র সন্তান যেন মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারে। সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।
বাদল ব্যানার্জি সেই ইচ্ছে পুরনের বাসনায় জয়ী। তাদের একমাত্র ছেলে, আজ আই.এ.এস. অফিসার।
বাদল ব্যানার্জির লাশ এইমাত্র পুলিশ নিয়ে গেল লাশকাটা ঘরে।
আই.এ.এস. অফিসার ছেলে আর তার স্ত্রী এখনো এসে পোঁছোতে পারে নি। যদিও তারা খুব দূরে থাকে না। গাড়িতে ঘন্টাখানেক সময় লাগে। আসলে দুরত্ব বাধা নয়। অভাব হৃদয় নৈকট্যের। শিক্ষা বা পদমর্যাদা কাউকে জ্ঞানী করে না। সে একেবারেই অন্য বিষয়। মুখস্থ বিদ্যা শংসাপত্র দাবী করে, আর শংসাপত্র খুলে দেয় উপার্জনের উপায় পথ। জ্ঞান আসে অন্য পথ ধরে। মানবিকতা আর মনুষ্যত্বের হাত ধরে।
মালতী কাঁদছিল। রিটায়ার্ড কর্নেল বাদল ব্যানার্জির মৃতদেহের পাশে একমাত্র ক্রন্দনরতা মানুষ, মালতী।
গেল দুবছর যাবৎ এই একলা হয়ে যাওয়া বৃদ্ধটির নিরলস সেবা করেছে। একেবারে মেয়ের মতো।
বিয়ে করে বউকে নিয়ে ছেলে তাকে একলা রেখে দিয়ে চলে যাবার পর, কর্নেল মাঝে মাঝেই বলতেন, আমার একটা মেয়ে থাকলে বড্ড ভালো হতো। আর কিছুই হোক না হোক খবরটা অন্তত নিতো। মায়ের জাত কি না। ফোনে হলেও খবর নিতো প্রতিদিন, নিয়ম করে।
বেঁচে আছি নাকি মরে ভূত হয়ে গেছি।
মালতী রাগ করতো। ধমকে বলতো, ওসব কথা বলতে মানা করেছি না? লোকে শুনলে কী বলবে বলো দেখি! তারা আড়ালে হাসবে না? বলবে, নিশ্চয়ই তোমার কোনো দোষ আছে, তাই ছেলে তার বউকে নিয়ে চলে গেছে।
সবাই খুঁত খুঁজতে ওস্তাদ। বুঝেছো? যে যাকে নিয়ে ঘর করে, সে জানে কে কেমন। ওসব কথা এক্কেবারে মুখে আনবে না। বুঝেছো?
কর্নেল অবাক হয়ে ভাবে, মালতী এইসব কায়দা শিখলো কোথায়। ওই তো বয়স। কত হবে? বড়জোর ত্রিশ।
ওর বরটা ভালো নয়। নেশা ফেশা ক’রে প্রায়ই মালতীর গায়ে হাত তুলতো। সংসারে মন ছিল না। শোনা যায় নাকি অন্য মেয়েমানুষ আছে। সেখানেই সবসময় পড়ে থাকে।
মালতীরা সব এমনই কপাল নিয়ে জন্মায়। দারিদ্র্যের অনেক জ্বালা।
এসব মেদিনীপুরের দেশের বাড়ির ঘটনা। মালতী কলকাতায় পালিয়ে এসে বেঁচে গেছে। নইলে যা দিনকাল। হয়তো প্রাণটাই খোয়াতে হতো।
সেই থেকে মালতী এখানেই আছে। ভালোই আছে। মানে, এখন থেকে ছিল, হয়ে গেল। কর্নেল বাবু আর নেই। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হলেন। মালতী বাবা বলে ডাকতো। বলতো, তোমার তো মেয়ে নেই বলে মনে দুঃখ। সেই জন্যেই ওইইই ওপরওয়ালা তোমার মেয়ে করে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিচ্ছু চিন্তা করবে না। আমি তো আছি।
সেদিন সকালে মেদিনীপুরের গ্রাম থেকে ফোন এলো। পাশের বাড়ির কাকিমার কাছ থেকে, শিগগির আয়, তোর মাতাল বর মরতে বসেছে। মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে।
মালতীর একটুও যাবার ইচ্ছে ছিল না। বর? সে তো তার কাছে কবেই মরে গেছে। মনের মরণই তো আসল মরণ। দেহ পোড়ালে ছাই।
কর্নেল বাবার কথা ফেলা যাবে না। বললেন, যা একবার। দেখা দিয়ে না-হয় চলে আসবি। ডেকেছে যখন, একবার যা।
তখন কী মালতী জানতো, ফিরেই এমন দৃশ্য দেখতে হবে ! তাহলে সে কী যেতো, ঐ বর নামক পাষণ্ডটার অকাল মৃত্যুতে, অকারণ বিধবা সাজার নাটকের নায়িকা হতে? কখনোই নয়।
একটা সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে। ঠিক তার পাশেই যত্নে রাখা একটি চিঠি ।
পুলিশ অফিসার খুব মন দিয়ে পড়ছিলেন, সুইসাইড নোটটি। খুবই সাদামাটা, অথচ অদ্ভুত লেখা।
আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। মরণ কখন কীভাবে আসবে জানা নেই। তাই নিজের পথ নিজেই স্থির করলাম। চললাম। আমার এই ইচ্ছামৃত্যু অবশ্যই আমাকে চিরশান্তি দান করবে। আমার এইই বিশ্বাস।
শেষ বারের মতো নিজের নাম লিখছি..বাদল ব্যানার্জি
এবার পুলিশ অফিসার টেবিল থেকে চিঠিখানি তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন, এই চিঠি যার উদ্দেশ্যে লিখছি , প্রথাগত নিয়মে তার নাম বা পরিচয় দেওয়া উচিৎ।
কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছে না। তবুও প্রবল অনিচ্ছা সত্বেও দায়বদ্ধতার কারণে লিখলাম, আমার ঔরসজাত সন্তানের প্রতি। সারাজীবন ন্যায় এবং সত্যকে অবলম্বন করে বাঁচতে শিখেছি।অন্যায়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা, আমাকে আপস করতে শেখায়নি। সাদা এবং কালোর প্রভেদ স্বীকার করতে কুন্ঠা বোধ করিনি কখনও।
তবে এও জানি, দুর্বিনীতের সঙ্গে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকলে, তথাকথিত সাংসারিক সমৃদ্ধি, আয়েশি সুখ, বিনোদন শান্তি অনায়াস লব্ধ হতে পারতো। কিন্তু অন্তরআত্মার প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতার বিনিময়ে তা লাভ করে, প্রকৃত শান্তি লাভ হতো কী?
আমার মতো সৎ আদর্শে উজ্জীবীত মানুষের কাছে তা হতো জীবনমৃত্যুর সমান।
তাই আমি এবং তোমার পরলোকগতা মা, সহজ সরল সত্যের চড়াই উৎরাই ভাঙা বিধস্ত পাথুরে পথই বেছে নিয়েছি।
নিজের সুকর্ম দক্ষতায় যেটুকু সঞ্চয় এবং পেনসন আছে, তাতে করে নিশ্চিত আনন্দ সহকারে কেটে গেছে অসার- অবশিষ্ট জীবন। তাছাড়া মাথা গোঁজার একটা নিজস্ব ঠাঁই তো আছেই।
কখনও কোনোদিন কোনকারণেই কারোর কাছে হাত পেতে দয়া কিংবা অনুগ্রহ ভিক্ষা করিনি, সে আমার অহংকার।
যাক, যে কথা বলতে চাই,
তোমার কু-গর্ভধারিণী মা, আজ থেকে দুবছর আগে ঠিক আজকের দিনে, ওপারে চলে গিয়েছেন ।
আমিও এই দিনটাকেই বেছে নিলাম।
তিনি গিয়েছেন শোকে এবং রোগে।
আমি যাচ্ছি, আমার দায় দায়িত্ব এবং কর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার শেষে। বেঁচে থাকার অনীহা বোধ থেকে। স্ব-ইচ্ছায়, আনন্দ চিত্তে।
হয়তো অনেকেই পাপের প্রসঙ্গ তুলবেন। আমি বলি, মৃত্যুর ধরন দেখে মানুষের পাপপুণ্য বিচার না করাই শ্রেয়।
যদি নিতান্তই করতে হয়, তবে তা করা হোক, তার সারাজীবনের কৃতকর্মের ভিত্তিতে।
বিগত প্রায় দুবছর, আমি তোমার তোমার মুখও দেখতে পাইনি। আসলে তুমি মুখ দেখতে এবং দেখাতে লজ্জা বোধ করেছো।
এটাই স্বাভাবিক। যে সন্তান, একটা টেলিফোন করেও বৃদ্ধ নিঃসঙ্গ বাবার খোঁজ খবর নেবার সময় বা সুযোগ পায় না, সে তার আপন গর্বে গর্বিত হয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করতে পারে, কিন্তু তার দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার লজ্জা ঢেকে রাখতে পারে না।
যাই হোক, লোক মুখে প্রাপ্ত সংবাদে জানলাম, তোমাদের একটি সন্তান লাভ হয়েছে।
সত্য কিংবা মিথ্যা জানি না। কেন না, আমি বিশ্বাস করি, গঙ্গাজল যত পবিত্রই হোক, নলের মধ্যে দিয়ে তা শোভা পায় না।
তবুও, যদি ঈশ্বরের কৃপায় তা সত্যই হয়, তবে সেই নবসৃষ্টির প্রতি রইলো আমার আর তোমার পরলোকগতা জন্মদায়িনীর শুভকামনা। সে যেন মানুষ হয়ে উঠতে পারে। বিবেকবান মহৎই মানুষ। আদর্শবান দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দায়িত্বশীল মানুষ।
অনেকটা সময় বাঁচলাম। এখন মনে হচ্ছে, বড্ড অকারণ বৃথাই এই বাঁচা। তাই ফিরতে চাই আপন ঘরে।
একটা আশ্চর্য অভিজ্ঞতা নিয়ে যাচ্ছি। সম্পর্ক।
বুঝলাম, সম্পর্ক, একটি স্বল্প সময়ের ভেজাল নাটিকা। আসলে, আমরা কেউই কারোর নই। সবাই আলাদা । যে যার মতন। কেউই কারোর মতন কিংবা পরিপূরক নই।
আর রক্তের সম্পর্ক যদি বলো। আমি মনে করি, তার কোনও সারবত্তা নেই। আত্মার সম্পর্ক না থাকলে, তা নিছকই সামাজিক লৌকিকতা ভিন্ন আর কিছুই নয়। অনেক সময় তা সামাজিকতাকেও উপেক্ষা করতে কুন্ঠিত বোধ করে না। যেমন জলজ্যান্ত উদাহরণ তুমি নিজে।
সবশেষে তোমাদের জ্ঞাতার্থে জানাই । আমার সঞ্চিত ধনের সবটুকু, যার অর্থমূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। আমার অন্তিম সময়ের সাথী। আমার কন্যাসমা মালতীকে আইনমোতাবেক দানপত্র করে দিলাম।
এই ফ্ল্যাট কেবলমাত্র তোমাদের বসবাসের জন্য ব্যবহার করার অধিকার দিলাম। বিক্রি বা ভাড়ায় দেওয়ার অধিকার দিলাম না।
আমার মৃত্যুর একবছরের মধ্যে তোমরা আমার আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই মোতাবেক কাজ না করলে, এই ফ্ল্যাটের যাবতীয় সত্ব, মালতীর হবে। এই বিষয় কোনও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। এটাই শর্ত।
ওঃ হ্যাঁ, আর একটা কথা। তোমরা আমার পারলৌকিক কাজ ইত্যাদি করবার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছ। যদিও আমি মনে প্রাণে এইসব অকারণ অর্থহীন সংস্কারে একেবারেই বিশ্বাস রাখি না । তবু্ও, মালতীর যদি ইচ্ছে জাগে- তবে তার নিজস্ব মানসিক শান্তির জন্য, সে তা করতে পারে। আমার ইচ্ছে না থাকলেও আপত্তি থাকবে না। শুধুমাত্র মালতীর স্বাধীন ইচ্ছেকে মান্যতা দেবার জন্য। ওর কাছে ঋণী রইলাম।
তোমাদেরকে দেবার মতো আর কিছুই আমার নেই, এমনকি আশীর্বাদ কিংবা অভিশাপও। সেসব রইল ঈশ্বরের বিচারাধীন। আমার কাজ শেষ।
চেষ্টা করো ভালো থাকার, ভালো রাখার।
ইতি, বাদল ব্যানার্জি
পুলিশ অফিসার পড়া শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, মনে মনে বললেন,
বদলাতে হবে। ধরাবাঁধা জীবনের অনেক কিছুই বদলাতে হবে ।
এতক্ষণে গর্বিত পুত্র আর পুত্রবধূর আসার সময় হলো । সব গল্প শেষ হয়ে যাবার পর।