বড় শুভ দিন
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনো পায়ের জোর পুরোপুরি পায়না…হাঁটতে
একটু অসুবিধাই হয় প্রতীকের। গতবছরেও দিব্যি ছিলো কিন্তু বড়দিনে বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করতে গিয়েই তো যত অঘটন।
গতবছর বড়দিনে বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করবে বলে মায়ের কাছে পঁচিশ হাজার টাকার বায়না করেছিলো ও।মা বাবাকে জানান কিন্তু বাবা ওই টাকা দিতে রাজী হন’না।বলেন–“খাওয়াদাওয়া আনন্দ করতে এত টাকা কিসে লাগে?টাকা অনেক কষ্ট করে উপার্জন করতে হয়।”
এই নিয়ে সংসারে অশান্তিও কম হয়নি!কিন্তু শেষে সন্তানের স্নেহের কাছে হার মেনেছিলো মা।
যদিও নীরা বা জয়দেব কেউই চাননা তাদের সন্তানেরা বৈভবের মধ্যে মানুষ হোক।জয়দেববাবু এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কিন্তু একটা সময় দারিদ্র্যের সাথে অনেক সংগ্রাম করেই বড় হয়েছেন তিনি। আজ স্বচ্ছল কিন্তু অতীতের কথা ভোলেননি ।তাই নিজে খুব সাধারণ ভাবেই জীবন কাটাতে ভালোবাসেন।তবে দরিদ্র হবার দুঃখ তিনি বোঝেন তাই গরীব-দুঃখীদের দিকে তাঁর হাত বাড়ানোই থাকে।সারাবছরই তিনি নানা সমাজসেবামূলক কাজে ব্যস্ত থাকেন।যদিও নিশ্চুপেই এসব কাজ করেন তিনি।তবে নীরাও এসব জানে আর স্বামীর এসব ভালো কাজে তার পুরো সমর্থন আছে।
ছেলেমেয়েকে ওরা ভালো স্কুলেই ভর্তি করেছেন।ছেলে প্রতীক দামী স্কুলে পড়ার সুবাদে সমাজের উচ্চবর্গীয় ছেলেমেয়েদের সংস্পর্শে এসে আধুনিক বিলাসিতার জীবন কিছুটা রপ্ত করে ফেলেছে।মাঝেমধ্যে মায়ের কাছ থেকে টাকাও আদায় করে সে।
দু’দিন আগে জয়দেববাবু নিজে থেকেই পঁচিশ হাজার টাকা ধরিয়ে দেন প্রতীকের হাতে,বলেন–“নে খরচ কর দেখি!’
নীরা অবাক হয়।গতবছরের দুর্ঘটনার কথা ভেবে বুকটা কেঁপে ওঠে ওর।গতবছর এই বড়দিনেই তো প্রতীক আর ওর বন্ধুরা নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ী এক্সিডেন্ট করেছিলো।নার্সিংহোমে দীর্ঘ চিকিৎসার পর আজ প্রতীক সুস্থ।সে এক দুঃসময়ের পর্ব।চীৎকার করে ওঠে নীরা—“ওর হাতে কেনো দিচ্ছো এতগুলো টাকা??”
জয়দেববাবু হাত দিয়ে থামিয়ে দেন নীরাকে আর বলেন– “শুধু টাকা নয়,একটা লম্বা লিস্ট ও দেবো ওকে।অনেককিছু কেনাকাটা করতে হবে। তুমিও যাবে ওর সাথে।”
পরেরদিন প্রতীক,ওর বোন আর মা-সবাই মিলে অনেক কেনাকাটা করলো।তারপর বাড়ি ফিরে কেক,চকলেট,জামা,সোয়েটার,বই,খেলনা সব সুন্দর করে রঙিন প্যাকেটে সাজাতে বসলো।
পরেরদিন সব্বাইকে নিয়ে জয়দেববাবু গেলেন সেই আশ্রমে…যেখানে অনাথ বাচ্চা,পথশিশুদের ভিড়ে ওরা হারিয়ে গেলো। প্রতীককে সান্টাবুড়োর বেশে দারুণ মানিয়েছিলো!আর সান্টা যখন বাচ্চাদের হাতে উপহার তুলে দিচ্ছিলো,তখন বাচ্চাদের চোখ খুশীতে ঝলমল করছিলো…খুশী যেন উপচিয়ে পড়ছিলো ওদের মুখে।সান্তা প্রতীকের চোখেও জল চিকচিক করে উঠলো।
তারপর সবাই মিলে কচিকাঁচাদের সাথে মাংস, ভাত, মিষ্টি খেয়ে,খুব হৈ-হুল্লোড় করে বাড়ি ফিরলো ওরা।জয়দেব আর নীরাও খুব খুশী আজ।
রাতে আজ কিছুতেই ঘুম আসছেনা প্রতীকের।মনের মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছে।খুব খারাপ লাগছে নিজেকে।নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।সে এমন ছেলে যে এমন ভালো বাবাকেও কৃপণ ভেবে দোষারোপ করেছে।বড্ড লজ্জা লাগছে ওর।
ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখে বাবার লাইব্রেরী রুমে আলো জ্বলছে।তারমানে বাবা জেগে বই পড়ছেন।
ধীরে ধীরে ও দরজার ভারী পর্দা সরিয়ে বাবার সামনে গিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়ালো।
বাবা মুখ তুলে নরম চোখে তাকালেন আর বললেন–” মনে রেখো,শুধু আত্মসুখের মধ্যে কোন মহত্ব নেই। বরং মানুষ হতে গেলে হৃদয়বান হতে হবে। তোমার যেমন সামর্থ্য তেমনভাবেই মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারো তুমি।শুধু নিজেরটুকু নিয়ে ভুলে থেকোনা।
আমার উচ্চশিক্ষার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু সংসারের অভাবের কাছে নতিস্বীকার করেছিলাম।ব্যবসাটাকে খেটেখুটে দাঁড় করিয়েছি খুব কষ্ট করে।তাই চাই তোমরা পড়াশুনো করে বড় হও…তোমাদের যেন কোন কষ্ট করতে না’ হয়।”
“ক্ষমা করো বাবা।ওই ভুল আর হবেনা”
“আসলে আমাদেরই দোষ। ছেলেমেয়েদের আমরা আত্মসুখী, স্বার্থপর একটা মানুষ করে গড়ে তুলি। চারপাশের অভাব অভিযোগগুলো দেখতে দিইনা। শুধু বলি পড়াশুনো করে বড় হও।ভালো চাকরি করো,উপার্জনশীল হও।সফল হও।নিজেদের জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য,বিলাস-ব্যসনে ভরিয়ে তোলো।ছেলেমেয়েরাও তাই শুধু নিজেদের ভালোবাসতে শেখে।পশুপাখীরাও তো খায়,ঘুমোয়। শুধু ভালো খাবো,ভালো পরবো,ভালো থাকবো –উন্নত মানুষ হিসাবে এই ভাবনার সার্থকতা কোথায়??
শুধু নিজেরটুকু নিয়ে ভুলে থেকোনা।আমি চাই তুমি নিজেকে মানুষ হিসাবে প্রমাণিত করো।”
“মনে রাখবো বাবা । আমিও তোমার মত মানুষ হয়ে সবার পাশে থাকার চেষ্টা করবো”।।