Site icon আলাপী মন

ধারাবাহিক- পুনরাবৃত্ত (পর্ব-১)

পুনরাবৃত্ত (পর্ব-১)
– অযান্ত্রিক

 

 

“বারান্দা থেকে জঙ্গলের দিকটা দেখতে দারুণ লাগছে, তাইনা মোহনা? দক্ষিণ দিকটা বোধ হয় ঐটাই” বললেন অরিত্র বাবু, মানে অরিত্র সোম। সোম হলিডে রিসোর্টের মালিক। মাস ছয়েক আগেই কিনেছেন এই প্রাসাদপম অট্টালিকা। বরাবরের মতই অকশানে। এই সোম দম্পতির, পায়ের তলায় তো সর্ষে, আর ব্যবসাটাও যখন রিসোর্টের তখন সেটা বাড়ানোরও তো একটা তাগিদ দুজনেরই আছে। বছর কয়েক আগে, জলদা পাড়া ন্যাশনাল পার্ক ঘুরতে এসেই শুনে ছিলেন অরিত্র বাবু, জঙ্গলটাও কাছেই যদিও সেটা জলদা পাড়া নয়, চিলাপাতা জঙ্গল। অরিত্র বাবু, দেখেছিলেন জঙ্গলটা খুব পরিচিত নয় ভ্রমণ পিপাসু মহলে, আশে পাশে তেমন ভাল হোটেল নেই। কাজেই থাকতে গেলে সবাইকেই সেই হাসিমারা টাউনেই থাকতে হয়। অরিত্র বাবু ভ্রমণ পিপাসু মানুষ বলেই এই অভাবটা সত্যিই অনুভব করেছেন। আর ওনার যে খুব তীব্র ব্যবসায়িক বুদ্ধি সেটা কে আর না জানে। এমন জঙ্গলের কাছে যদি একটা আধুনিক সুযোগ সুবিধা যুক্ত থাকার জায়গা করা যায় তাহলে তো আর কথাই নেই। অরিত্র বাবুদের হোটেল ব্যবসা বেশ কয়েক পুরুষের, দেশের নানা প্রান্তে ওনাদের হোটেল রিসোর্ট আছে- বকখালী, মন্দারমণি, দীঘা, গাংটক, চাদিপুর, গোপালপুর। অরিত্রবাবু নিজেও বেশ কটা করেছেন মধুপুর, গিরিডি, নেতারহাট, বক্সার। যদিও নামগুলো শুনেই বুঝতে পারছেন অরিত্র বাবুর জঙ্গলের প্রতি একটা টান আছে। গত তিন বছর ধরে চেষ্টার পরে কয়েক মাস আগেই এই বাড়িটা কিনেছেন। বাড়ি বলা ভুল হবে হাভেলি বলাই ভালো, জঙ্গলের একদম গায়েই। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে তারপর অরিত্র বাবু খুলতে পারছেন তাদের সোম হোটেল রিসোর্টের নবতম শাখা চিলাপাতা জঙ্গলে। কেনার পর অরিত্র বাবু কয়েকবার ঘুরে গেলেও মোহনা দেবী প্রথমবার এলেন এবারই। আর আসবেন নাইবা কেন? দু’ দিন বাদেই তো উদ্বোধন হবে “চিলাপাতা গ্রিন ভাল্যি রিসোর্ট’। সব শাখা সাজানো গোছানোর দায়িত্ব সাধারণত মোহনা দেবীরই থাকে। আগে থেকে লাইভ ভিডিওতে যা যা করানোর, করিয়েছেন এবার শেষ বা ফিনিশিং টাচগুলো দিতে সশরীরে আসতেই হয়েছে। অরিত্র বাবুর কথায় মোহনা দেবী কোন উত্তর দিলেন না, শুধু মাথা নেড়ে সন্মতি জানালেন।
“তোমার কি মনে হয়? লোকেশন হিসেবে ব্যবসা কেমন হতে পারে?“ আবার বললেন অরিত্র বাবু।
“সবার তো জঙ্গল ভালো লাগে না, তবে যাদের লাগে সেই স্তরের লোকের কাছে পৌঁছাতে পারলে ব্যবসা না হওয়ার তো কারণ দেখি না। তবে আমার মনে হয় যদি বাড়িটাকে রাজবাড়ীর মত করে আরও ডেকরেট করতে পারলে অন্য শ্রেণীর লোকের কাছেও পৌঁছানো যেতো। আজকাল তো হামেশাই বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য এমন বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। ঘর তোঁ অনেক গুলোই আছে“ বললেন মোহনা দেবী।
“সেটা আমার মাথায়ও আছে, বহুদিনের বাড়ি হলেও, আমাদের রং করানো, আর ইলেকট্রিকের কাজ ছাড়া তেমন কিছু কাজ করতে হয় নি। তুমি লক্ষ্য করেছো কিনা জানি না একটাও দরজা জানলা দীর্ঘদিনের অব্যবহারেও পালিশ নষ্ট হয় নি, মেঝের মারবেল পালিশও খারাপ হয়নি। তাহলে ভাবো যিনি এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন, কত ভাল ভাল জিনিষ ব্যবহার করেছিলেন।“
“সে আমিও লক্ষ্য করেছি। আচ্ছা অরিত্র বাড়িটার ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু জেনেছ? মানে কাগজ পত্রে যা বয়স লেখা আছে সেটাই ঠিক নাকি বাস্তবে তার থেকে অনেক বেশী। আজ পর্যন্ত কতবার হাত বদল হয়েছে? কোন গঠনগত পরিবর্তন হয়েছে কিনা? অথবা প্রথম অবস্থায় কেমন ছিল দেখতে“ জানতে চাইলেন মোহনা দেবী।
“না না অতসব আমি খোঁজ নিই নি, যা জানি সেটা অকশান ডকুমেন্ট থেকেই জেনেছি। ওদের কাগজ আর দলিল দেখে জেনেছিলাম, এই বাড়িটা ১৮৯৭ সালে হাসিমারার কোনো মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহ করে ছিলেন, উনি নিজে ভাল শিকারীও ছিলেন। যদিও ১৯২০ সালে কোনো দুর্ঘটনায় উনি মারা যান। তার প্রায় বছর দশেক পরে ওনার পরিবারের লোক এই বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছেন। তারপরেও বহু হাত বদল হয়ে শেষমেশ বিজয় সরকার নামে একজন প্রপার্টি ডিলারের হাতে ছিল বাড়িটা। উনিও এই বাড়ি বাঙ্কের কাছে জমা দিয়ে বড় অঙ্কের টাকা লোন নিয়েছিলেন। পরে শোধ করতে না পারায়, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাড়িটা নিলাম করে দেয়। আমি সেখান থেকেই কিনেছি, মালিকানার ব্যাপারে এর থেকে বেশী কিছু জানি না।“
মোহনা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু চা জল খাবার নিয়ে বারান্দায় ঢুকলো বংশী, “স্যার চা নিয়ে এলাম, আর দুপুরে কি রান্না করবে জানতে চাইলো রাধার মা, যা বলবেন সেই মতো বাজার যাবো।“
“আসো, আসো বংশীদাদা আরে আমাদের স্যার ম্যাডাম, বলে বাইরের লোক করে দিও না। আমরা তোমাদের বাড়ির লোক, বাড়ির লোককে কি কেউ স্যার ম্যাডাম বলে নাকি?” হাসতে হাসতে খুব আন্তরিক ভাবে বললেন মোহনা। “দুপুরে যে কোনো কিছু রান্না করো, মাছ মাংস খাওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই। রাধার মাকে বলে দ্যাখো না যদি বাড়ির মতো করে মুসুর ডাল আর কিছু ভাজা টাজা আর একটা তরকারী করে দেয়, সারা রাত ট্রাভেল করে এসেছি তো, রিচ কিছু খাব না।“
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি সেটাই বলে দিচ্ছি, রাধার মাকে“ বলে চলে যাচ্ছিলো বংশী, কিন্তু অরিত্র বললেন, “আচ্ছা বংশীদাদা, তোমরা তো শুনেছি এখানকার আদি বাসিন্দা। তাহলে এই বাড়ির ব্যাপারে নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানো, মানে এই বাড়ির ইতিহাস আর কি। যদি একবার সে সব সময় করে একবার জানাও তাহলে সেই অনুযায়ী বাড়িটাকে সাজানো যায়, আমরা তো তেমন কিছু জানি না।“
“হ্যাঁ, সে ঠিক কথাই বলেছেন দাদাবাবু, আমরা প্রায় চার পুরুষ ধরে এখানেই আছি, আমার ঠাকুরদা তার বাপ তো এই বাড়িতেই কাজ করতো। তবে কিনা আমি জন্ম থেকে বাড়িটা বন্ধই দেখেছি, এর থেকে বেশী কিছু জানি না। জানলে শিতলদাদা জানতে পারে। বছর কয়েক আগে অব্ধি ঐ তো দেখাশুনা করতো, আর আমাকেও তো ঐ এখানে কাজের খবর দিয়েছিলো। দেখছেনই তো আশেপাশে দশ কিলমিটারের মধ্যে কোনো বাড়ি ঘর নেই, কে আর খবর রখে এই সিংহ বাড়ির.. “
“ওঃ তাহলে তো হয়েই গেলো, তাহলে একদিন চলো না শিতল দাদার কাছে বা একবার সময় করে নিয়েই এসো, আমার গাড়িটা আছেই এখানে।“ বললেন অরিত্র।
“হে হে দাদাবাবু, শিতল দাদা আমার ঠাকুরদাদা গো, বড্ড বুড়ো, হাঁটতে চলতে পারে না, আসবে কি করে? আপনাদের ম্যানেজার যোগেনকেও তো শিতল দাদাই খবর দিয়েছিলো, সেই জন্যই আমি আর যোগেন এক সাথেই কাজ লেগেছি।“
“ঠিক আছে, আমরাই না হয় যাবো একদিন সময় করে তোমার বাড়ি তাতে কোন আসুবিধা নেই তো? বললেন অরিত্র। বংশী লজ্জায় কানে হাত দিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। বংশী চলে যেতে মোহনা বললেন, “একবার পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখলে হতো না? কি কি কাজ বাকি আছে সেটা তো দেখাই হল না।“
“সে করা যেতেই পারে রানী সাহেবা, কিন্তু সারা রাত গাড়ি চালিয়ে আমার একটু ঘুম পাচ্ছে। বিকালে দেখলে হতো না? আচ্ছা ঠিক আছে চলো” মৃদু আপত্তি জানিয়ে বললেন অরিত্র। “না ছেড়ে দাও, তুমি বরং চা জলখাবার খেয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও, আমি নিজে ঘুরে দেখে নিচ্ছি, আর যোগেনবাবু তো আছেনই।“ বললেন মোহনা।
চা জলখাবার শেষ করে, ফ্রেশ হয়ে মোহনা দোতলার থেকে নীচে নেমে এলেন, সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে প্রথম যে ঘর সেই ঘরে। এসে প্রতি কোনা দেওাল খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। অরিত্র যদিও আগেই মোহনার কথা মতো সব দেওয়ালে ওয়াল পেপার আর মেঝেতে কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেওয়ালগুলো কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মোহনাকে নীচের তলায় ঘোরাঘুরি করতে দেখে এগিয়ে এলেন ম্যানেজার যোগেন সরকার।
“বৌদি, কিছু লাগবে?”
“ না না, আমার কিছু লাগবে না দাদা। এই একটু ঘুরে দেখছিলাম বাড়িটা। বাড়িটার গড়নটা তো বেশ রাজ বাড়ির মতো, তাই ভাবছিলাম এই দেওয়ালগুলোতে কিছু পুরনো ছবি লাগালে, সাজানোটা আরও আকর্ষণীয় লাগতো। আপনি কি দেখেছেন? উপরে ছাদের সাথে বেশ কয়েকটা হুক লাগানো আছে। এমন হুক সাধারণত ঝাড়বাতি লাগানর জন্যই হয় অথবা দড়ি টানা পাখা। আসলে দাদা, মানুষ এখন এমন রাজকীয় পরিবেশ বেশী পছন্দ আর তার জন্য অতিরিক্ত খরচ করতেও পিছুপা হয় না। তাই ভাবছিলাম এই বাড়ির পুরনো কোন ছবি, বা মালিকদের কোন তৈলচিত্র যদি এই দেওয়ালে লাগানো যায়, তাহলে মন্দ হয় না, আপনি কি বলেন?” বললেন মোহনা।
“সে আপনি যেমন ঠিক বোঝেন, মুশকিল হল আমি যত দিন এই বাড়িটাকে চিনি তাতে এই বাড়ির ছবি বা যেমন ছবির কথা আপনি বলছেন কোনটাই আমি দেখিনি। তবে শিতলদাদা জানতে পারে, কারণ উনিই দীর্ঘ দিন এই বাড়ির দেখভাল করেছেন আমিও তো গত দশ বারো বছর হলো ওর সাথেই এসেছি, তাও আমি ঝাড়বাতি, ছবি, দড়িটানা পাখা কোনোটাই দেখিনি।“ জানালো যোগেন সরকার ।
“ওহ তাহলে ঠিক আছে, আচ্ছা? গদি,খাট,পর্দা এসব যে পাঠিয়েছিলাম সে সব যেভাবে লাগাতে বলে ছিলাম সে ভাবেই লাগিয়েছেন তো, ভিডিও কলে যদিও দেখে ছিলাম তবে ওভাবে দেখলে তো ঠিক বোঝা যায় না তাই..“
“সে সব আপনার কথা মতই সেট করে দিয়েছি, আপনার যদি কোন অসুবিধা না থাকে তাহলে এখনই একবার দেখে নেবেন চলুন না।” বলে মোহনাকে সঙ্গে করে নিয়ে সব ঘরগুলো ঘুরে দেখাতে শুরু করলো। নীচ উপর মিলিয়ে কুড়িটা ঘর, যাদের মধ্যে একটা ঘর খুব বড়, সেটাই ওরা ঠিক করে রেখেছে খাওয়ার ঘর করবে, এমনি ঘরটা সাজানো হয়ে গেছে, শুধু চেয়ার টেবিলগুলো কাল কলকাতা থেকে এসে পৌঁছালে বসিয়ে দিলে হবে। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে এবার উঠতে উঠতে মোহনার মনে হল ঘরগুলো কেন জানি না বেশ চেনা চেনা লাগছে। তবে বাড়িটার ধরণটা কিন্তু বেশ। মূল দরজা দিয়ে ঢুকে বড় একটা ড্রয়িং রুম, সেই ড্রয়িং রুমের ঠিক শেষ যেখানে, সেখানে দুইদিক দিয়ে দু’টো সিঁড়ি উঠে এসেছে দোতলায়। ড্রয়িং রুমটার বাম দিকে সারি দিয়ে পাঁচখানা ঘর আর ডান দিকে তিনটে ঘর, কিচেন আর ডাইনিং রুম। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলে একটা লম্বা করিডর, যার পাশে পাশেই সার দিয়ে দশ খানা ঘর। নীচ থেকে যে সিঁড়ি দোতলায় উঠেছে সেটা মাঝখানে একটা জায়গায় এসে মিশেছে, সেখান থেকে আবার দু’দিকে ভাগ হয়ে উপরে উঠে গেছে। ঐ জায়গাটায় এসে মোহনা দেখলেন সেখানে দেওয়ালের মাঝখানে একটা দরজা। দরজাটায় অপূর্ব কারুকার্য করা, খুব পুরনো অথচ তার আকর্ষণীয়তা একটুও কমেনি। মোহনার সব থেকে আশ্চর্য লাগলো দরজার গায়ে লাগান তালাটা। একটু অদ্ভুত দেখতে, তার উপর একটা রুপালী রঙের চেন লাগানো, দেখে রুপোই মনে হচ্ছে আর সেই চেন থেকে অনেকগুলো ওঁ, স্বস্তিক চিহ্ন ঝুলছে। মোহনা কৌতূহলী হয়ে তালাটাতে হাত দিতেই ওর হাতটা যেন কেউ চেপে ধরলো সেই সঙ্গে কেউ যেন পিছন থকে টেনেও ধরলো ওকে। মোহনা সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ফিরে দেখলেন কেউ নেই, ভাবলেন হয়তো মনের ভুল। আবার দরজার দিকে ফিরে তালাটায় হাত দিতে যাবে এমন সময়ই–

 

চলবে………. 

Exit mobile version