নতুন সূর্য
– অঞ্জনা গোড়িয়া
কোলে একবছরের ছেলে মাথায় ধানের বোঝা। এক হাতে ছেলের কোলে আর এক হাতে বোঝাটা শক্ত করে ধরেছে। ছেলেটাকে মোটা গামছা দিয়ে বেঁধে নিয়েছে। যেন না পড়ে যায়। ধীরে ধীরে পা ফেলে চলেছে কল্যানী। পায়ে যে অসহ্য যন্ত্রণা। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে পা থেকে। রক্তে রাঙা পদচিহ্ন এঁকে চলেছে মেঠো পথে। এভাবেই ফসল নিয়ে চলেছে গাঁয়ের বধূ কল্যানী। কিসে যে পা কাটলো তাও দেখার সময় নেই। বাড়ি ফিরে আগুনের তাপে একটু আরাম পাবে। ধানের বোঝাটা রাখলো বাড়ির এক চিলতে উঠানে। পিছনে পিছনে আসছে বড়ো মেয়ে প্রিয়া। ক্লাস নাইনে পড়ে। বড়ো সাধ করে নাম দিয়েছিল ওর বাবা বিকাশ। পড়াশোনায় বড্ড ভালো। সব সময় বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলতো, দেখো বাবা আমি লেখাপড়া শিখে মস্ত বড়ো ডাক্তার হবো।
গাঁয়ের সবার সেবা করবো। তোমাকে, মাকে আর কাজ করতে দেব না। আমাকে পড়াবে তো বাবা? অনেক দূর পড়বো। বাবাও মেয়ের কথায় আপ্লুত হয়ে বলত নিশ্চয় পড়বি মা। আমি যত দিন আছি তোর কিচ্ছু ভাবতে হবে না। তুই পড়ে যা। কল্যানী বাবা মেয়ের আদিখ্যেতা দেখে শাসনের মেজাজে বলতো, হয়েছে বাবা হয়েছে। ঢের হয়েছে। মেয়েছেলে আবার ডাক্তার। এত টাকা কোথায় আমাদের? গরীবের ঘরে খেয়ে পরে বেঁচে আছি এই যথেষ্ট। একটা পাশ দিলেই ওর বিয়ে দিতে হবে বুঝলে। এসব স্বপ্ন দেখিও না। আমাদের সংসারে এসব মানায় না।
মেয়ে মুখটা কাঁচুমাচু করে দৌড়ে চলে যেত ঘর থেকে।
দিলে তো মেয়ের মনটা খারাপ করে। কত আনন্দ করে একটা স্বপ্নের কথা বললো, আর তুমি এক ঝটকায় ভেঙে দিলে স্বপ্নটা। ও আগে পড়ুক না। দেখি না কি করা যায়? দেশের সরকার আছে। কত সব জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি আছে। ওকে কত ভালোবাসে? আর আমি তো আছি। কষ্টে সৃষ্টে ঠিক হয়ে যাবে। এতকিছু ভেবো না তো।
কল্যানী মুখে বললেও মেয়ে-বাপের স্বপ্ন দেখে মনে মনে খুব গর্ব অনুভব করতো।
বোঝা মাথায় কত কথায় মনে আসছে। দু’ মায়ে ঝিয়ে ধান কাটা বাধা সব করেছে। ভেবে ছিল একটা লোক পেলে ধান কটা ঘরে আনবে। তাও কেউ করলো না। ভেবেছে যদি রোজ দিতে না পারে। যদি বেকার খাটতে হয়। কেউ আসে নি কাজ করতে। তাই দু’ মায়ে ঝিয়ে মিলেই তুলতে হচ্ছে ধান। আজকের মধ্যেই সব ধান তোলা শেষ করতে হবে। পরের লোকের জমি আগাম টাকায় ভাগ নিয়েছিল। কথা ছিল ধান তোলা শেষ হলে জমি ফেরত দেবে।
কে জানত একাই মাঠের ফসল মাথায় করে আনতে হবে? কে জানত সংসারের দায়, সন্তানের ভার নিজের কাঁধে একাই বয়ে নিয়ে যেতে হবে সারাজীবন?
কোভিড লকডাউন আর আমপান ঝড়ে তছনছ হয়ে গেল সুখের সংসার। লকডাউন শুরু হতে কারকাখার কাজ বন্ধ হয়ে গেল। তারপর কারখানা চালু হলেও কিছু লোক ছাঁটাই করলো। সেই লিস্টেই ছিল বিকাশের নাম। অনেক হাতে পায়ে ধরেও কাজটা আর পেল না। তারপরই আমপান ঝড়। একটা গরু ছিল। বাছুরও ছিল। যা দুধ হতো খেয়ে বেশি হলে বিক্রি করতো। কিন্তু এই ঝড়েই খোলা ভেঙে পড়লো গরুর গায়ে। সেই রাতে গাঁয়ের কিছু লোক নিয়ে কোনো মতে বাঁচালো গরু-বাছুরটাকে। ভিজে ভিজে সারারাত গরুতে মানুষে একসাথে কাটিয়েছে একটা মাত্র শোবার ঘরে। তাও মড়মড় করে আওয়াজ হচ্ছে ঘরের এসবেস্টসগুলো থেকে। এই বুঝি উড়ে যায়। কিংবা ভেঙে গায়ে এসে পড়ে। সে যাত্রায় বেঁচে গেল কোনোমতে। দুজনে মিলে পরের দিন যা হোক করে গোয়ালঘরটা সারিয়ে গরু রাখার ব্যবস্থা হলো। পঞ্চায়েত নেতা বলেছিল, একটা ত্রিপল দেবে। সেই ভরসায় ছিল। পরে শোনে সব শেষ হয়ে গেছে। এর পরের বার দেবে। কাজ বন্ধ, চারিদিকে ঘুরেঘুরে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে যেত বিকাশ। একদিন প্রচুর জ্বর গায়ে বাড়ি ফিরলো। সঙ্গে কাশি। কোভিড পরীক্ষায় ধরা পড়লো রোগ। তুলে নিয়ে গেল বিকাশকে। আর খোঁজ এল না তার। একঘরে হয়ে গেল ওরা। কেউ ধারে কাছে আসত না। বিকাশের কোনো খবর আর পেল না। এক মাস পরে কে একজন এসে বলে গেল সে মরে গেছে। ভাগ্য ভালো এদের মধ্যে কারোর কোভিডের কোনো লক্ষণ ছিল না। কল্যানী তখন সন্তান সম্ভবা। বিকাশ জানার পর আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছিল। তাই তো কাজের জন্য ছটফট করছিল। শেষ রক্ষা হলো না। পাষাণ হয়ে গেল কল্যানী। মেয়ের স্বপ্ন বাবার স্বপ্ন আর কল্যানীর স্বপ্ন সব এক ঝটকায় ঝড়ের মতোই গুড়িয়ে দিল চিরকালের মতো।
সরকারী ত্রাণ আর গাঁয়ের মানুষের কিছু সাহায্যে চলছিল দিনগুলো ।
বড় মেয়েই তখন ঢাল হয়ে দাঁড়ায় মায়ের সামনে। বয়স আর কত হবে? ১৩ কি ১৪। স্কুল বন্ধ তবু সে নিজেই ঘরে পড়ে হ্যারিকেনের আলোতে।
দিনের বেলায় সে মায়ের সব কাজে করে দিত। তারপরই ভাই হলো। সে কি আনন্দ! বাবার কথা বড্ড মনে পড়ে। মায়ের কথা ভেবে কাঁদতে ও পারে না৷ পাছে মা বুঝতে পারে। ভাইকে কোলে নেওয়া, মাকে যত্ন করা সব করত।
ধানের বোঝাটা ফেলেই ছেলেকে নামালো কোল থেকে। পায়ের দিকে চেয়ে দেখে কেটে গেছে অনেকখানি। মেয়েও বোঝাটা ফেলে ছুটে আসে মায়ের কাছে।
ভালো করে জল দিয়ে ধুয়ে দিল পা। ভাইটাও খিদেয় চেঁচিয়ে উঠলো জোরে। ভালো করে পরিস্কার করে পুই পাতার রস নিঙড়ে বেঁধে দিল পা-টা। ভাইকে তুলে নিল কোলে। একটু দুধ গরম করে খাইয়ে দিল। তারপর মা’কে দিল একগ্লাস জল। নিজের খিদের কথা ভুলেই গেছে মেয়ে।
কল্যানী মনে মনে ভাবে এ যে আমার বড় ছেলে। কে বলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে পরের বাড়ি দিতে হবে?
বিকাশের মুখটা মনে পড়ে গেল। এ মেয়েকে নিয়ে কত স্বপ্ন।
ধান বিক্রি করে আর একশো দিনের কাজ পেয়ে ধিকিধিকি এগিয়ে চলে সংসারের চাকা।
এমনি করেই কেটে যায় দিন রাত বছর। মেয়ের চাই একটা স্মার্ট ফোন। অনলাইন ক্লাস হচ্ছে স্কুলে। কোথা থেকে পাবে এত টাকা?
তাও জোগাড় হয়ে গেল। গরুটা বিক্রি করে দিল। এত দিন তার দুধ খেয়ে, গোবর ঘুঁটে গড়ে স্বার্থপরের মতো বিক্রি করতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। তবু উপায় নেই। বাছুরটা মা মা করে ডেকে ওঠে থেকে থেকে। কল্যানী এ কষ্ট সইতে পারছে না। স্বামীকে হারিয়েছে। এত দিন এই গরুই সংসারের অনেক দায়িত্ব পালন করেছে। তবু চোখের জল চোখেই শুকিয়ে গেছে। আর আসে না জল।
মেয়ের স্বপ্নটা তাকে যে পূরণ করতেই হবে। এ যে তার স্বামীর ইচ্ছে। ওকে পড়াতে হবে। অনেক বড় হবে। তার জন্য কল্যানী প্রাণ দিয়ে খেটে চলেছে।
বাছুরটা ‘হাম্মা..’ বলে ডেকে ওঠে। কল্যানী ছুটে যায়। গলা গায়ে আদর করে মায়ের মতো। ভুলিয়ে দেয় মা হারানোর কষ্ট। যেমন করে ভুলে গেছে স্বামী হারানোর কষ্ট।
সারারাত ছেলে মেয়েকে নিয়ে কেটে যায় রাতটা। নতুন একটা সকালের আশায়। নতুন একটা ভোরের আশায়।
নতুন আলোয় হেসে উঠবে মা মেয়ে আর কোলের ছেলেটা।
হামাগুড়ি দিয়ে সারা ঘর চড়ে বেড়ায় আর খিলখিল করে হেসে মায়ের বুকে মুখ লুকায়।