Site icon আলাপী মন

ধারাবাহিক গল্প- পুনরাবৃত্ত (পর্ব-৪)

পুনরাবৃত্ত (পর্ব-৪)
-অযান্ত্রিক

মুখে জলের ছিটে লাগতেই জ্ঞান ফিরলো অরিত্রর। জ্ঞান ফিরতেই, উঠে বসে দেখলেন, অরিত্র নিজের ঘরের বিছানাতেই আছেন। মোহনা, মোহনা, মোহনা কোথায়? ও ঠিক আছে তো?
“যাক ঘুম ভাঙলো আপনার মহারাজ” চেনা কণ্ঠের স্বরে ফিরে তাকাতেই অরিত্র দেখলেন চা-এর ট্রে হাতে ঘরে খাটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মোহনা। আর খাটের থেকে একটু দূরে মেঝেতে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে এক বয়স্ক ভদ্রলোক। অরিত্রও তার দিকে তাকাতেই সে বললো “অপরাধ মার্জনা করবেন হুজুর, অনেকক্ষণ আপনার জ্ঞান আসছে না দেখে আমিই গঙ্গা জল ছিটালাম।”
“সে ঠিক আছে, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না, আর খামকা আপনি আমাকে হুজুরই বা বলছেন কেন?” অবাক হয়ে বললেন অরিত্র। “তুমি ওনাকে চিনবে না অরিত্র, উনি হচ্ছেন বংশী ও আমাদের সবার শীতলদাদা। উনি নিজেই আজ সকালে বংশীদের সাথে এসেছেন আমাদের সাথে দেখা করতে, উনি সব জানেন কাল রাতের ঘটনার ব্যপারে। উনি সব বলবেন, তুমি একটু হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো, তারপর খাওয়ার টেবিলে একসাথে বসে শুনবো” বললেন মোহনা। অরিত্র কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চা শেষ করে মাথা নাড়তে নাড়তে বাথরুমে চলে গেলেন ফ্রেশ হতে।
একটু বাদেই খাবার টেবিলে ওরা দুজনে পৌঁছে দেখলেন, টেবিলের উপর বড় বড় পেতলের পাত্রে ফুলকো ফুলকো লুচি, আলুরদম, ছোলার ডাল বেগুন ভাজা, মিষ্টি ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। দেখে অরিত্র চনমন করে উঠে বললেন, “বাবা এতো কিছু সকালে! যাক, দাও দাও পেটের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে কাল রাত থেকে পেটে কিছু পড়েনি, আর শীতলদাদা কোথায়, উনি খাবেন না?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ হুজুর, কেন খাবেন না তবে শীতল দাদা এসব খায় না , আপনি বসুন আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি” বলল বংশী।
“ওমা দাদা বাবু থেকে হুজুর হয়ে গেলাম কি করে গো বংশী দাদা?” বললেন অরিত্র।
“আজ্ঞে এই কারণে, হুজুর” শীতলদাদা কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে অরিত্রও খেয়ালই করেন নি শীতল দাদার হাতে একটা বাঁধানো অয়েল পেন্টিং, আর তাতে সম্পূর্ণ রাজ পোশাকে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে, যাকে অবিকল অরিত্রর মতই দেখতে। অরিত্রর চোখের সামনে আবার ভেসে উঠলো গতরাতের পুরো ঘটনা, আর এই সেই ছেলে যাকে মহারাজ নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে ছিলেন। “এই বাড়ি এতদিন আপনাদেরই অপেক্ষায় ছিল হুজুর, আজ পর্যন্ত বহুলোক এই বাড়ি কিনেছে কিন্তু ভোগ করতে পারে নি, কেউ এক রাতেই পাগল হয়ে গেছে নয়তো মারা গেছে। এই বাড়ি আর মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহের আত্মা এতদিন অপেক্ষা করছিল তার বংশজকে তুলে দেওয়ার জন্য। কাল বংশী ফিরে গিয়ে আমায় আপনাদের বিবরণ দিতেই আমি এই ছবিটা দেখাই, দেখাতেই ও জানায় আপনাকে অবিকল শৈল বিক্রম সিংহের ছেলে আদিত্য বিক্রম সিংহের মতো দেখতে। শুনে ভোরের আলো ফুটতেই চলে এসেছি হুজুর আমার শেষ দায়িত্ব পালন করতে..” কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই হাঁপাতে লাগলো শীতলদাদা।
“শেষ দায়িত্ব মানে, তুমি এসব কি বলছ শীতল দাদা” আঁতকে উঠলেন মোহনা।
“হ্যাঁ, শেষ দায়িত্বই গিন্নিমা, কাল রাতে আপনারা যে নব্বধুর সাজে এই বাড়িকে দেখেছেন, সেই মোটা মোটা কার্পেট, ঝাড়বাতি আসবাব সে সব তুলে দিতে হবে বৈকি মহারাজের হাতে। ওটাই তো আমার দায়িত্ব, এত বছর ধরে যক্ষের মতো আগলে রেখেছি এই প্রাসাদ, এই নিন গিন্নিমা চাবি। ঐ সিঁড়ির ঘরের চাবি সব অক্ষুন্ন আছে আজও। অরাও অপেক্ষায় আছে গত ষাট ষাটটা বছর।“ বলে একটা তৃপ্তির হাসি মুখে নিয়ে অপূর্ব কারুকার্য করা একটা চাবি এগিয়ে দিলো মোহনার দিকে। মোহনা চাবিটা হাতে নিয়ে বললেন, “এখন দিচ্ছো দাও কিন্তু এর পরেও এসবের দায়িত্ব তোমাদেরই থাকবে শীতলদাদা”
এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলে উঠলেন অরিত্র, “এসব কি হচ্ছে আমায় একটু খোলসা করে কি কেউ বলবে? কি ব্যাপার বলো তো শীতল দাদা?”
“তেমন কিছুই না হুজুর, এই প্রাসাদ বানিয়ে ছিলেন মহারাজ রবীন্দ্র বিক্রম সিংহ, তাও আমার দুই পুরুষ আগে, তখনও ইংরেজরা এদেশে আসেনি। তার ছেলে হলেন মহারাজা শৈল বিক্রম সিংহ, তিনিই যদিও প্রকৃত অর্থে এই প্রাসাদের শোভা বৃদ্ধি করেন। তিনি ছিলেন খুবই শৌখিন, কিন্তু প্রচণ্ড পরাক্রমী আর উনি ইংরেজদের একদম সহ্য করতে পারতেন না যদিও ইংরেজ সরকার ছলেবলে কৌশলে ওনার কাছ থেকে এই রাজ্য হাতিয়ে নিতে চাইছিল। তার ছেলে ছিলেন আদিত্য বিক্রম সিংহ, আমাদের ছোটো রাজা। রাজা হলেও তিনি ছিলেন খুবই সাধারণ আর নরম প্রকৃতির। আর ঘটনা চক্রে, আমাদের ছোট রাজা এখানকার ইংরেজ শাসকের মেয়ের প্রেমে পরে যান। যদিও ঐ ইংরেজ অফিসার চাইতো কোনোভাবে বড়রাজা আর ছোট রাজাকে মেরে এই অঞ্চলের দখল নিতে। কিন্তু কোনো ভাবে সুবিধা করতে না পেরে, একটা চাল খাটিয়ে বড় রাজাকে দিয়ে ছোট রাজাকে বন্দি করালেন। ওনাকে বোঝালেন, যে ছোট রাজা নাকি বড় রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বড় রাজা যদিও খুব ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। উনি ছোট রাজা আর ঐ ইংরেজকে সামনাসামনি এনে ফয়সালা করতে দুজনকেই এক জায়গায় আনলেন। কিন্তু ঐ ইংরেজ অফিসার আসার সময় কিছু সৈন্য নিয়ে আসে লুকিয়ে। রাজবাড়িতে এসে, সাধারণ পোশাকে ছোট রাজাকে দেখে ঐ ইংরেজ অফিসার আবেগ সামলাতে না পেরে সত্ত্যি কথা বলে ফেলেন আর উত্তেজনায় ছোট রাজার ওপর গুলি চালিয়ে বসেন। সেইখানে ছোট রাজা আদিত্য বিক্রম সিংহের মৃত্যু হয়। রাগে, দুঃখে মহারাজ সেই সৈন্য সমেত ইংরেজ অফিসার আর তার মেয়েকে কচুকাটা করে ফেলে দেন জঙ্গলে। তার কিছুদিন পরেই সন্তান হারানোর শোকে যন্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মহারাজ শৈল বিক্রম সিংহ। সেই থেকে এ বাড়িতে কেউ থাকে না। কিনেছে বহু লোকেই কিন্তু বাস করতে পারে না কেউই।”
মোহনা এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন, শীতল দাদার কথা শেষ হতেই বলে উঠলেন, “চলো বংশীদাদা, আমরা ঘরটা খুলে দেখি। তারপর না হয় আবার এই বাড়িটাকে আগের মতো করেই সাজানো যাবে, চলো..”
মোহনা, শিতলদাদা, অরিত্র আর বংশী টেবিল থেকে উঠে সিঁড়ির ঘরের দিকে গেলো। সেই ঘরটার সামনে, মোহনা চাবিটা বংশিকে দিয়ে বললেন, “তুমিই খোলো বংশী দাদা” বংশী চাবিটা ফেরত দিয়ে বললো “এই বংশের লোক ছাড়া কারো হাতে যে এ তালা খোলে না গিন্নিমা, আপনাকেই খুলতে হবে” অরিত্রও এগিয়ে এসে তালায় চাবিটা ঢোকাতেই তালাটা নিজে নিজেই খুলে গেলো আর সে সাথে দরজাটাও অদ্ভুত একটা শব্দ করে খুলে গেলো। অরিত্র আর মোহনা ঘরে ঢুকে দেখলেন কাল রাতে যা যা আসবাব আর জিনিষ দেখেছে সব এখানে আছে আর দেওয়ালে আছে একটা ছবি হাতে আঁকা নয় ক্যামেরায় তোলা। অরিত্র ছবিটা হাতে নিয়ে বাইরে এসে দেখলেন ছবির ব্যক্তিটি আর কেউ নয় শীতল দাদা, তলায় লেখাও আছে নায়েব শীতল মজুমদার, জন্ম ১৮২২ মৃত্যু ১৯০১ আর তার পাশে আরও এক ভদ্রলোক নাম বংশী মজুমদার জন্ম ১৮৪২ মৃত্যু ১৯০১। অরিত্র আর মোহনা দুজনে চিৎকার করে ডাকলেন, “শীতল দাদা আ আ আ আ, বংশী দাদা আ আ আ আ”
সারা বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেদ করে চলে গেলো ডাকগুলো কোন সাড়া এলো না তার বদলে, বাড়ির বাইরে কয়েকটা গাড়ি এসে থামার শব্দ এলো, আর কেউ যেন দরজায় টোকা দিয়ে ডাকল “হ্যালো, মিস্টার অরিত্র সোম, আপনারা কি বাড়িতে আছেন?” অরিত্রও এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন।
একজন নীল রঙের ইউনিফ্রম পরা ভদ্রলোক নমস্কার করে জানালো, “স্যার, আমরা রিবিল্ট ইন্টারন্যাশানাল থেকে আসছি । আমাদের যদিও পরশু আসার কথা ছিল, কিন্তু রাস্তায় ধ্বস নামায় আটকে পরে ছিলাম। ফোনেও নেটওয়ার্ক ছিল না। আমদের সঙ্গে মোহনা সোমের এগ্রিমেন্ট হয়েছিলো হসপিটালিটি অ্যান্ড হাউজ কিপিং ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারে। অনিচ্ছাকৃত দেরীর জন্য আমাদের ক্ষমা করবেন। “
অরিত্র পিছনে ফিরে মোহনার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মানে?”
তখনও টেবিলে আলুরদম লুচির থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

Exit mobile version