Site icon আলাপী মন

গল্প- নৃত্যজা  

নৃত্যজা
– সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা) 

 

   

   আমি নৃত্যজা। বড়দের প্রণাম জানাই, সমবয়সীদের শুভেচ্ছা, ছোটদের এবং সবাইকে মুঠো মুঠো ভালবাসা জানিয়ে এখন আমি একটা রবীন্দ্র নৃত্য পরিবেশন করতে চলেছি।

রবীন্দ্র নৃত্যের একটা প্রতিযোগিতা  চলছিল শিলিগুড়ির একটা বিখ্যাত মঞ্চে। মঞ্চের সামনে উপস্থিত আছেন পাঁচজন বিচারক। সৃজন সেন বিচারকদের অন্যতম একজন, এসেছেন কলকাতা থেকে। মুগ্ধ চোখে নৃত্যজার নাচ দেখছেন তিনি। তার কথা বলার ভঙ্গীমা থেকে শুরু করে নৃত্যভঙ্গীমা সবই খুব পরিচিত লাগছে সৃজনের। মনে হচ্ছে এই মেয়ে যেন তার কতদিনের পরিচিত। বিচারকগণ এবার তাকে অন্য আরো দু’টো রবীন্দ্র নৃত্য পরিবেশন করতে বললেন। পারদর্শীতার সাথে প্রতিটি নৃত্য পরিবেশন করলো নৃত্যজা। কিন্তু নৃত্যজার নাচ দেখতে দেখতে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছেন সৃজন। সৃজন ও সঙ্গীতা তখন কলেজের প্রথম বর্ষে। দুজনেই খুব ভালো নাচ করে। কলেজ সোস্যালে নৃত্যনাট্যগুলোতে তারা নিয়মিত অংশগ্রহণ করে। বিশেষত রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে তারা সবসময়ই নায়ক নায়িকা। কলেজে সকলে তাদের ‘জুটি জুটি’ বলে ক্ষেপাত। সৃজন একদিন সঙ্গীতাকে বলে- কবে কেমন করে তুই আমার হৃদয় জুড়ে বসে গিয়েছিস, আমি জানিনা রে! শুধু জানি তোকে ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।

সঙ্গীতাও মনে মনে সৃজনকে ভালবেসে ফেলেছিল। তাই বন্ধুত্বের পথ ধরে চলতে চলতে ভালবাসার নিবিড় বন্ধনে তারা বাঁধা পড়লো। এরপর নৃত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রী করলো দুজনে। নৃত্যজা এবং সৃজন দুজনেই নৃত্যকে পেশা হিসাবে নিল।  নৃত্যকলাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সঙ্গীতা অনেক প্রতিভাময়, প্রতিভাময়ী ছেলে মেয়েদের বিনা বেতনে নাচ শেখাতে শুরু করলো। নৃত্য জগতে বিচরণ করতে এক অপূর্ব স্বর্গীয় আনন্দ পেত সে। নাচ ছাড়া তার জীবনকে ভাবতেই পারত না সে। সৃজনের বাড়িতে তার নিত্য যাতায়ত ছিল তার । ওই পরিবারের সবাই জানতেন সৃজন সঙ্গীতার সম্পর্কের কথা। জানতেন সঙ্গীতার পরিবারও। তাই প্রেম পরিণতি পেতে সময় লাগলো না। শুরু হলো তাদের যুগল চলা। সব কিছু সামলেও সঙ্গীতার নাচের জগতের সাথে সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ছিল। নাচ ছিল তার মুক্তির জায়গা। প্রাণ ভরে অক্সিজেন নেওয়ার জায়গা। ধীরে ধীরে বাড়ির পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে শুরু করলো। শাশুড়ি আরো সময় দাবী করতে লাগলো সঙ্গীতার কাছ থেকে। সব কাজ সেরেই তো সে কাজে যেত। তবুও বাঁকা মন্তব্য আসতে লাগলো।
বিচারক বর্গ একটা ব্যাপারে সৃজনের মতামত চাইলো। এক ঝটকায় বর্তমানে ফিরলেন সৃজন।               বিচারকবর্গ  নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নৃত্যজাকে প্রথম স্থান দিলেন। সার্টিফিকেট লেখার সময় নৃত্যজার পদবী জানতে চাওয়া হলে সে বলে, “আমি পদবী ব্যবহার করি না, আমার মাও পদবী ব্যবহার করেন না। আপনারা সার্টিফিকেটে শুধু নামই লিখে দিন, তা নাহলে এই পুরস্কার আমি গ্রহণে অপারগ।” শেষ পর্যন্ত বিচারকগণ সম্মত হলেন। কারণ এটা এখন আইনসিদ্ধ। এই দৃঢ়তা, এই কথা বলার ভঙ্গীমা ভীষণ ভীষণ চেনা লাগছে সৃজনের। নাচ সম্পর্কে নৃত্যজার মতামত চাওয়া হলে নৃত্যজা বললো, নাচ তার জীবন, নাচ ছাড়া জীবন তার অপূর্ণ। তাই নাচ ছেড়ে সে জীবনকে কল্পনাও করতে পারবে না কোনোদিন। কোনোকিছুর বিনিময়ে সে নাচ ছাড়বে না।   

 “রোজ রোজ মায়ের সাথে তোমার এই অশান্তি আমার ভালো লাগে না। নাও না একটু মানিয়ে।”
– ”মানিয়ে নেওয়া মানে নাচ ছেড়ে পুরোপুরি  সংসার করা তাই তো! আমি পারবো না।

”সন্তান এলে?”
-“আমাদের দেশে অনেক নৃত্যশিল্পী আছেন, যারা সন্তান জন্ম দিয়েছেন, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিয়ে, নাচের জগতে প্রত্যাবর্তন করেছেন, এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।”
-“তাহলে তুমি মায়ের কথা শুনবে না।”
-“না”!দৃঢ় কণ্ঠে জানালো সঙ্গীতা। “তোমার সঙ্গে আর তোমার সঙ্গে কেন তোমার পরিবারের সবার সঙ্গে আমার এই নিয়ে বিয়ের আগে কথা হয়ে গিয়েছে, কথা ছিল আমি নাচ কোনোদিন ছাড়বো না।”
-“পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী আমার পরিবার চাইছে না তুমি নাচের জগতে থাকো! আমার নাচের মধ্যে তুমি নিজেকে খুঁজে নিও! অর্ধাঙ্গিনী তো!”  কথা কাটাকাটি, তিক্ততা বাড়তেই লাগলো।
-“আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান,তাদের উপর আমি কথা বলতে পারবো না, হয় নাচ নয় আমি যে কোনো একটা তোমায় বেছে নিতে হবে।” সৃজন ভেবেছিল হয়তো সঙ্গীতা সংসার আর তাকে ছাড়তে পারবে না। কিন্তু সঙ্গীতা দৃঢ় ভাবে উত্তর দিল, “তবে আমি নাচকেই বেচে নিলাম”।                              নৃত্যজার কাছে এসে তার সাথে আলাপ করলো সৃজন। জানতে চাইলো কোথায় থাকে সে। কার কাছে নাচ শিখেছে সে।

“আমার মা-ই আমার নৃত্যগুরু। তাঁর কাছেই আমার নৃত্যশিক্ষা।” ”তোমার বাবা কি করেন?” আমার মা এবং বাবা দুজনের নামই সঙ্গীতা। আমার মা একক মা হিসাবেই আমাকে মানুষ করেছেন।” নামটা শুনে চমকে উঠলো সৃজন তবে কি! তবে কি সঙ্গীত! “আমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাবে?”
-“কিন্তু কেন?”
“আমিও একজন নৃত্যশিল্পী তাই, আর একজন নৃত্যশিল্পীর সাথে পরিচিত হতে চাই।”
“আমার মা একটু পরে এখানে আসবেন, তাঁর অনুষ্ঠান আছে আজ এখানে।”
“আমি অপেক্ষা করছি।”                                   

– “মা ইনি তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান।” দুজনে দুজনকে অপলকে দেখলেন কিছুক্ষণ।   নৃত্যজা তাঁদের লক্ষ করতে লাগলো।
– “নৃত্যজা কে?”
-“আমার আত্মজা ,আমিই ওর মা, আমিই ওর বাবা।”
-“কিন্তু ওর জৈবিক বাবা।”
-“তার কোনো প্রয়োজন নেই আমার কাছে।” এবার দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল নৃত্যজা।                       আলাদা থাকা যখন তারা শুরু করে, তখন সবে মাত্র গর্ভে সন্তানের অস্তিত্ব টের পায় সঙ্গীতা। মনে মনে ভাবে মেয়ে হলে নৃত্যজা আর ছেলে হলে নৃত্যজ। যেই আসুক নাচ শিখিয়ে নিজের মনের মত করে গড়বে তাকে। না গর্ভে সন্তানের অস্তিত্বের কথা সৃজনকে জানায় নি সে। হয়তো তীব্র অভিমানে। তার পর শিলিগুড়িতে নৃত্য শিক্ষিকার চাকরি নিয়ে চলে আসে সঙ্গীতা। ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে নৃত্যজা। হ্যাঁ, সঙ্গীতার স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। নাচের জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে  চলেছে নৃত্যজা।
– “জৈবিক বাবা  তুমিই, বেশ আজ আমি স্বীকার করছি, মেয়ের সিদ্ধান্ত সে তোমায় মেনে নেবে কিনা? সে বড় হয়েছে এখন তার নিজস্ব মতামত আছে।”                                  

-“আমাকে কিন্তু মা সব কিছু জানিয়েছিল আগেই, তোমার বাড়িতে নৃত্যকলার যে অপমান হয়েছিল, তা মা মানতে পারে নি, আমিও পারবো না”। নৃত্যজা বললো।                       

-“কিন্তু আমি যদি তোমাকে নৃত্যকলার কিছু প্রশিক্ষণ দিতে চাই তুমি নেবে না? বাবা হিসাবে নাই বা হলো একজন নৃত্যজগতের মানুষ হিসাবে আমার শিক্ষাটাও তোমাকে দিতে চাই, এইটুকু সুযোগ আমায় দেবে না?”
– “নৃত্যকলাকে ভালবাসি, তাই হ্যাঁ আপনার কাছে শিক্ষা গ্রহণ আমি করবো। গুরুজি নামেই আপনাকে ডাকবো, গুরুজি হিসাবেই আপনাকে দেখবো। কখনও কোনোদিন বাবার দাবী নিয়ে আপনি আমার কাছে আসবেন না।”

– “বেশ তাই হবে…সঙ্গীতা  তোমার কোনো আপত্তি?”
– “আমি তো বলেইছি মেয়ে বড় হয়েছে তার মতকে আমি গুরুত্ব দিই।”                                     বাবার বাড়িতে নয়, হস্টেলে থেকেই শিক্ষা শুরু হলো তার। নিজের সমস্ত বিদ্যাকে উজার করে দিলেন মেয়ের মধ্যে।                                         

না আর বিয়ে করেননি সৃজনও। নাচের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেন সৃজন। একসময় নিজের ভুল বুঝতে পেরে সম্ভবনাময় শিল্পীদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতেন তিনি। অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া প্রতিভাকেও তিনি সামনে আনতে লাগলেন। এমনকি সংসারের চাপে যে গৃহবধূরা নাচের জগৎ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন, তাদের অনেককেও নৃত্যজগৎ ফিরিয়ে দিলেন তিনি। হ্যাঁ, এটাই তার প্রায়শ্চিত্ত। কাছ থেকে সব দেখলো নৃত্যজা।     

-“বাবা” চমকে তাকালো সৃজন। আরো বেশ কয়েকটা বছর অতিবাহিত।
-“আমাকে!” অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সৃজন।
-“হ্যাঁ তোমাকেই!” পাশে সঙ্গীতা।
– “তুমি এতদিন ধরে এত মানুষের প্রতিভা বিকাশে সাহায্য করেছো। তোমার প্রায়শ্চিত্ত  হয়ে গিয়েছে। বাবা বলে মেনে নিলাম তোমায়।”

– ’আর তুমি সঙ্গীতা! পারবে আবার আমাকে মেনে নিতে?”
-“না আমি বাকি জীবনটা আমার মত করেই কাটাতে চাই, এক ছাদের তলে এলে আবার হয়তো স্বকীয়তা নিয়ে সংঘাত হবে। বাকি জীবনটা আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বই থাক। নৃত্যজা থাক আমাদের সংযোগ সূত্র হয়ে।”

Exit mobile version