সম্পর্কের জটিল সমীকরণ
– জয়তী মিত্র
ভোরবেলা উঠেই তানিয়া কালী মন্দিরে শাশুড়ি মায়ের সুস্থতা কামনা করে পূজো দিতে গেল। জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে গিয়ে এক পথ দুর্ঘটনার আহত হন তানিয়ার শাশুড়ি মা সুমনা দেবী। এই দুদিন নাওয়া, খাওয়া ভুলে হাসপাতালেই পড়ে ছিল তানিয়া। যতই তার সাথে শাশুড়ি মায়ের সম্পর্ক খারাপ থাক, তবুও তিনি মা তো।
হাসপাতাল থেকে ছেলে প্রকাশের সাথে বাড়ি ফিরে বৌমার খোঁজ করতে থাকেন তার শাশুড়ি মা। ঠিক তখনই পূজো দিয়ে বাড়ি এসে ঠাকুরের ফুল শাশুড়ি মায়ের মাথায় ঠেকিয়ে, মুখে একটু প্রসাদ তুলে দেয় তানিয়া। সুমনা দেবীর চোখ জলে ভরে যায়। যে মেয়েটাকে তিনি কখনও আপন বলে ভাবতে পারেন নি, সেই মেয়ে তার জন্য এত করছে। নিজের মনেই নিজেকে বললেন, “ছি! আমি নিজের কাছের মানুষদের আপন ভাবতে পারি নি। নিজের বিবেকের কাছেই যে নিজে ছোট হয়ে গেলাম। ছোট্ট মেয়েটা যে সংসারের জটিল খেলায় আমাকে হারিয়ে দিল।”
প্রকাশ আর তানিয়া সেই কলেজ জীবন থেকে পরস্পরকে ভালোবাসে। তানিয়া ছোট বেলায় বাবা মা-কে হারিয়েছে। মামার বাড়িতে অতি অবহেলায় মানুষ হয়েছে। একমাত্র দাদু দিদা ছাড়া তাকে কেউ কোনোদিন ভালোবেসে নিজের করে নেয়নি। ওনারা বেঁচে থাকতেই বি এ পাশ করে তানিয়া, না হলে কলেজের মুখই তার দেখা হতো না। মামা মামী তাকে বেশিদূর লেখাপড়া শেখানোর পক্ষপাতী ছিল না।
তানিয়ার খুব ইচ্ছা ছিল এম এ পড়ার। প্রকাশ কথা দিয়েছিল তানিয়াকে, তার ইচ্ছা প্রকাশ পূরণ করবে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয় নি।
এই বিয়েতে মায়ের একদম মত ছিল না। সুমনা দেবী তার ছোটবেলার বান্ধবীর মেয়ে পৌলমীর সাথে বিয়েটা দিতে চেয়েছিলেন। শহরের বিখ্যাত বস্ত্র ব্যাবসায়ীর মেয়ে পৌলমী। আর্থিক স্বচ্ছলতাও ছিল প্রচুর। এমন বাড়ির মেয়েকে বউ মা করে আনা তো লটারি পাওয়ার সমান। অন্যদিকে তানিয়ার দাদু তার শেষ জীবনের সম্বল টাকা দিয়ে যেটুকু সাধ্য নাতনীর বিয়েতে খরচ করেছেন। তাতে সুমনা দেবীর মন ভরে নি। ছেলের জেদের কাছে হার মেনেই এই বিয়েতে সুমনা দেবী রাজী হয়েছিলেন। ছেলে তার ভালোবাসাকে হারাতে চায়নি। মাকে সে সাফ জানিয়ে ছিল, “তানিয়া ছাড়া সে কাউকেই বিয়ে করবে না।” নিজের মন মতো ছেলের বিয়ে দিতে পারেন নি সুমনা দেবী, তাই প্রথম থেকেই তানিয়াকে ভালো ভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি। উঠতে বসতে নানা রকম কাজের ত্রুটি ধরতেন। বৌমার কোনো কিছুই তার পছন্দ হতো না। তানিয়া অনেক চেষ্টা করতো শাশুড়ি মায়ের মন পাবার কিন্তু সেটা আর হতো না। একটা, না একটা খুঁত তিনি ধরবেনই। তানিয়া খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে ছিল। তাই মুখে কিছু না বললেও শাশুড়ি মাকে একদম পছন্দ করত না। দুজনের মধ্যে সবসময় একটা ঠান্ডা লড়াই চলত।
তানিয়াকে বুকে জড়িয়ে সুমনা দেবী বললেন, “তোকে আমি এত অবহেলা করি আর তুই সব কিছু ভুলে আমার এত সেবা করলি, আমি তো তোকে কোনোদিন ভালোবাসতেই পারিনি, অথচ তুই আমাকে এইভাবে কাছে টেনে নিয়েছিস, তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস মা।”
তানিয়া বললো, “ছোটবেলায় নিজের মাকে হারিয়েছি তো তাই দ্বিতীয় বার আর মাকে হারাতে চাইনি। তোমাকেও আমি নিজের মায়ের আসনে বসিয়ে ছিলাম। কিন্তু তুমি আমার ভালোবাসা গ্রহণ করতে পারোনি। তুমি যতই আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করো তুমি আমার মা হয়েই থাকবে চিরকাল।”
সুমনা দেবী বললেন- “আমি আমার ভুল স্বীকার করলাম মা, আমার অন্যায় হয়ে গেছে। আর এমন হবে না। আজ থেকে তুই বৌমা থেকে আমার মেয়ে হলি। তানিয়া শাশুড়ি মা-কে জড়িয়ে ধরে বললো-“আজ আমি আমার নিজের মাকে ফিরে পেলাম।”
ছেলে প্রকাশ দুজনের মিলন দেখে টিপ্পনী কেটে বললো- “যাক বাবা, বাঁচা গেলো, বউ আর মায়ের মাঝখানে পড়ে তাকে আর স্যান্ডউইচ হতে হবে না।” মা আর বউয়ের মুখে তখন চওড়া হাসি।