পরশ্রীকাতর
– জয়তী মিত্র
পরশ্রীকাতর একটা কঠিন রোগ। আজকাল বেশিরভাগ লোকের মধ্যে এই রোগটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে। এর থেকে পরিত্রাণের কোনো ওষুধ আজ অবধি আবিষ্কার হয়নি, যদি নিজে না তার থেকে বেরিয়ে আসা যায়।
পরশ্রীকাতর লোকের সংখ্যা আজ খুব বেশি পরিমাণে দেখা যায় আমাদের সংসার তথা সমাজে। কিছু লোক আছে যারা পরের ভালো দেখতে পারে না। লোকের ভালো দেখলে মুখে অমাবস্যার কালো অন্ধকার নেমে আসে। শরীর, মন জ্বলে যায় অন্যের সুখ, শান্তি দেখে। মুখে তাদের মিষ্টি কথা মনের ভিতর থেকে বিষে ভরা। অন্যদের আঘাত করে এরা খুশি হয়। এই ধরনের মানুষরা কখনো শান্তিতে থাকতে পারে না।
আজকাল ঘোষ গিন্নি সুমিতা প্রচন্ড ডিপ্রেসনে ভুগছে, তার মানসিক স্ট্রেস ক্রমাগত বাড়ছে। এই নিয়ে তার স্বামী রজতের চিন্তার শেষ নেই। কি করে গিন্নির ডিপ্রেশনের অবসান ঘটাবেন সেই চিন্তাতেই তিনি রাতদিন চিন্তিত। গিন্নির ডিপ্রেশনের কারণ পরশ্রীকাতরতা। সুমিতা কারোর ভালো দেখতে পারে না। ইদানিং সুমিতার প্রিয় বান্ধবী রুমেলার বাড়ীতে বিদেশি ফ্রিজ এসেছে। ওনার ছেলে বিদেশে চাকরী করে, সেই কারণে বিদেশ থেকে কাড়ি কাড়ি ডলার আসছে। এই দেখে সুমিতার ব্লাড প্রেসার ক্রমশ বেড়ে চলেছে, ফ্রিজ আর ডলারের কথা শুনে।
আজকাল রূমেলার সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছে সুমিতা। রুমেলাকে একটু এড়িয়ে চলে আজকাল। একই রামে রক্ষা নেই তার ওপর সুগ্রীব দোসর। সেদিন সুমিতার বান্ধবী রুমির সাথে রাস্তায় দেখা হল। রুমি বললো, জানিস সুমিতা আমাদের পুরোনো বাড়িটা ভেঙে আবার নতুন করে তৈরি করলাম। পুরো বাড়িটা মার্বেল দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছি, মডিউলার কিচেন করলাম, ছাদে আর্টিফিসিয়াল ঘাস বসালাম। খুব সুন্দর লাগছে এখন ছাদটা। সামনের রবিবার দাদাকে নিয়ে আসিস আমার বাড়ি দেখে, রাতের খাবার খেয়ে তারপর বাড়ি যাবি। সুমিতা কোনো কথার উত্তর না দিয়ে চলে গেল।
বাড়ি গিয়ে বরের সাথে তুমুল অশান্তি শুরু করে দিল। বর রজতকে বললো- “কতবার বললাম, বাড়ীতে একটু মার্বেল বসাও, এই লাল রঙের মেঝে এখন আর চলে না। কিন্তু তুমি তো কোনো কথাই কানে নাও না। সবার বাড়ীতে মার্বেল বসছে আর আমার বাড়ি সেই আদ্যিকালের।”
রজত বললো- “দেখো আমার বেসরকারি চাকরী, এত টাকা নেই, মেয়ে রয়েছে দুটো, তাদের পড়ার খরচ, তার পর মায়ের জন্য মাসে ওষুধের খরচ, কিছু ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়, এত কিছু সামলে আমার পক্ষে বিলাসিতা করা সম্ভব নয়। আর শোনো তোমার বান্ধবীদের সাথে তাল মিলিয়ে চলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার আর্থিক সামর্থ্য দেখেই তোমার বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন আমার সাথে। তোমাকে বড়োলোকের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারতেন তোমার বাবা, তাহলে তোমার আমাকে নিয়ে এত হীনমন্যতা থাকত না।” এই ঝগড়ার মাঝে ফোন এলো সুমিতার ছোট বোন নন্দিতার। নন্দিতা একজন উঠতি লেখিকা। তার লেখা ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে। সেই ম্যাগাজিনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নন্দিতাকে সম্মাননা, আর মেমেন্টো দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কোনো এক সাহিত্য গ্রুপ থেকে।এই খবরটা দিদিকে জানানোর জন্য নন্দিতা ফোন করেছে। বোনের উন্নতি দেখে হিংসায় জ্বলে ফোনটাই কেটে দিল সুমিতা। মুখ বেঁকিয়ে বললো-“বুড়ো বয়সে সাহিত্য চর্চা করছে। সংসারে কাজ নেই, একগাদা কাজের লোক, সারাদিন খাতা কলম নিয়ে বসে থাকে। আমার মত সংসার নাকি, একটা কাজের লোক নেই, খাটতে,খাটতে হাড়, মাংস ভাজা ভাজা হয়ে গেলো।”
সুমিতার বর রজত বললো- “শোনো, হাজারটা লোক রাখলেও তোমার হাত দিয়ে লেখা বের হবে না, গল্প কবিতা লেখার জন্য প্রতিভা দরকার, যেটা তোমার নেই। আর ছি! শেষ কালে ছোট বোনটার সাথেও হিংসা। তুমি পাগল হয়ে যাবে সুমিতা।”
রজত আরো বললো- “শোনো সুমিতা হিংসা করলে তোমারই শরীর খারাপ হবে। অন্যের ভালোটা ভালোবেসে গ্রহণ করতে শেখো তাতে তোমার শরীর, মন দুটোই ভালো থাকবে। অন্যের ভালো দেখে নিজের ব্লাড প্রেসার, ডিপ্রেসন বাড়িয়ে তো তোমারই ক্ষতি হচ্ছে। তাই না বলো।অন্যের জন্য নিজের ক্ষতি না করে সহজে সব কিছু মেনে নিতে শেখ, মনটা পরিষ্কার রাখো তাহলে দেখবে তোমার জীবনটা কত সুন্দর হয়ে উঠেছে। নিজের যা আছে সেটা নিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা করো, তাহলে মানসিক শান্তি পাবে। নিজের মানসিকতা বদলাও দেখবে তোমার মত সুখী আর কেউ নেই।”
স্বামীর কথা শুনে সুমিতা বললো-“আজ থেকে ডিপ্রেসনকে উড়িয়ে দিয়ে নিজে ভালো থাকার চেষ্টা করবো আর নেই,নেই বলে কোনো অভিযোগ তোমার কাছে করব না,আর তোমাদের ও ভালো রাখার চেষ্টা করব। “
রজত বলল” সেটা আজ থেকেই শুরু হোক কি বলো? আর কথা নয়, এবার এক কাপ ব্ল্যাক কফি দাও দেখি, সুমিতা হাসিমুখে দিচ্ছি বলে রান্না ঘরের দিকে গেল কফি বানাতে।