প্রতিদান
– জয়তী মিত্র
মাঝ রাতে বুকে ব্যথা উঠেছিল রঞ্জনার। স্বামী অশোক তৎক্ষণাৎ রঞ্জনাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। নার্স এসে বলেছিল, এই কাগজটা নিন, একটা ইনজেকশনের নাম লেখা আছে, এক্ষুনি নিয়ে আসুন, ওনাকে দিতে হবে না হলে ওনাকে বাঁচানো যাবে না। কি করবে ভেবে না পেয়ে একমাত্র ছেলে শুভ্রকে ফোন করেছিল তার বাবা। না ছেলে ফোন তোলে নি। রিং হয়ে ফোন কেটে গেল। ওষুধের দোকানে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করাতে দোকানদার বললো, ইনজেকশনের দাম দুই হাজার টাকা। কিন্তু এত টাকা তো তার কাছে নেই,মাত্র পড়ে আছে এগারশো টাকা। ওষুধের দোকানদারকে অশোক বললো, এই টাকাটা রাখুন, আমি বাকিটা পরে দিয়ে যাবো, কিন্তু ইনজেকশনটা এখুনি দরকার, না হলে আমার স্ত্রী বাঁচেবে না। দোকানদার কিছুতেই বাকিতে দিতে রাজি হলো না।
কোনো উপায় না দেখে অশোক ছেলের ফ্ল্যাটে গেল, গিয়ে দেখলো, ছেলে তার বউ আর বাচ্চাকে নিয়ে দামী গাড়ী চড়ে বেড়াতে বের হচ্ছে। ছেলেকে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ল অশোক বললো, তোর মা মৃত্যুশয্যায় এক্ষুনি টাকার দরকার। দু’হাজার টাকা দে, ইনজেকশন কিনতে হবে। ছেলের পাশে তখন তার কোম্পানির বস বসে। ছেলে তার কোম্পানির ম্যানেজার। দুই পরিবার তখন পিকনিক যাচ্ছে।
শুভ্রর বস বিক্রম বাবু বললেন, ইনি তোমার বাবা? পরনে ময়লা পোশাক, মাথার চুল উস্কো খুস্কো। চোখের নিচে কালি পড়া। শুভ্র বললো, না না, ইনি আমার বাবা নন, কোনো পাগল হবে হয়তো আমাকে ওনার ছেলের মত দেখতে তাই এই সব ভুল বলছে। ছেলে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে পিকনিকের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
অনেক কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করেছে রঞ্জনা আর অশোক। অশোক কাজ করতো একটা ছোট কারখানায়। ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় কারখানা বন্ধ হয়ে যায় অশোকের। পাড়ায় পাড়ায় সব্জি বিক্রি করে সংসার চালিয়ে ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছে। রঞ্জনা রাতে বাড়ির সামনে রুটি, তরকারি, ডিম কষা এইসব বিক্রি করে অনেক কৃচ্ছসাধন করে ছেলেকে শিক্ষিত করেছে। ছেলে পড়াশুনায় খুব মেধাবী ছিল। রেজাল্টও খুব ভালো ছিল। চাকরির পরীক্ষা দিতে শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই ছেলে চাকরী পেয়ে গেছে খুব তাড়াতাড়ি। প্রেম করে বড়োলোকের মেয়েকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়েছে শুভ্র। গরীব বাবা, মা জানতেও পারেনি ছেলে কবে বিয়ে করেছে। খুব একটা যোগাযোগও রাখত না বাবা মায়ের সঙ্গে। পাছে তার সম্মান নষ্ট হয়। মা রঞ্জনা ছেলেকে দেখার জন্য মাঝেমাঝেই আকুল হতো। চোখের জল ফেলত। ফোন করলে ছেলে বলতো, ব্যস্ত আছি। তাই তারা ছেলের সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টাও করতো না। ছেলেকে এত কষ্ট করে মানুষ করে এই প্রতিদান পাবে, স্বপ্নেও ভাবে নি অশোক আর রঞ্জনা। রঞ্জনা ভাবতো, এর থেকে নিঃসন্তান হলেই ভালো হতো। ছেলের চিন্তা করতে করতে দিন-দিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ছিল রঞ্জনা। অশোক বলতো, ছেলের কথা না ভেবে, আমরা নিজেদের মতো করে বাঁচব, মনে করো তোমার কোনো ছেলে নেই।
ইনজেকশনের ব্যাবস্থা করতে না পেরে যখন হাসপাতালে পৌঁছালো অশোক তখন রঞ্জনার দেহটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। নার্স এসে জানালো, উনি আর নেই।
কান্নায় ভেঙে পড়ল অশোক। বাচ্চাদের মত কাঁদতে, কাঁদতে বললো, তোমার এই হতভাগ্য স্বামীকে ক্ষমা করে দিও, আমি পারলাম না তোমাকে বাঁচাতে। অশোকের কান্না দেখে সেদিন অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারে নি।