স্বপ্নভঙ্গ
-জয়তী মিত্র
বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই যে স্বপ্নভঙ্গ হবে একথা স্বপ্নেও ভাবেনি নীলা। দেখাশুনা করেই তার সাথে রজতের বিয়ে হয়।
নীলা বি,এস,সি অনার্স পাশ করে এম.এস.সি. পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে নীলার বিয়ের সম্বন্ধ আসে। নীলা পড়াশুনা করে নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করবে না ঠিক করেছিল, কিন্তু বাবা মা তাকে বলেছিল, বিয়ের পরও সেটা করা যাবে। আগে বিয়েটা হোক। পাত্র রজত বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে, সরকারী চাকরী করে, দেখতে সুদর্শন, এমন পাত্র হাতছাড়া করা মানে বোকামি।
নীলা সুন্দরী, শিক্ষিতা, গান জানে, প্রথম দেখাতেই নীলার প্রেমে পড়ে রজত। রজতের বাবা, মা তো নীলার গান শুনে খুব খুশি। নীলাকে রজতের বাবা বলে, বিয়ের পর আমাকে রোজ একটা করে গান শুনিও মা আর তোমার পড়াশোনা আমার বাড়ীতে গিয়েই শেষ করবে, চাকরীও করতে পারো, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। রজতের বাবার মুখে এইসব কথা শুনে খুব খুশি নীলার পরিবার। নীলার’ও রজতকে বেশ পছন্দ হয়।
তারপর শুভ দিনে নীলা আর রজত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। প্রথম কদিন বেশ ভালই কাটলো শ্বশুরবাড়িতে। তারপর একদিন শাশুড়ি মা ভোর পাঁচটা বাজতেই ঘরে টোকা দিয়ে বললো, এই যে নবাব নন্দিনী ঘুম থেকে উঠে চা বানিয়ে সবাইকে দাও, তারপর বাসনগুলো মেজে, রান্নাঘরে যাও। কাজের মাসি, রান্নার মাসী সব ছাড়িয়ে দিয়েছি। এখন তোমার সংসার কাজকর্ম সব বুঝে নাও। বিয়েতে আমার প্রচুর ধকল গেছে আমি আর কিছু কাজ করতে পারবো না।
শাশুড়ি মায়ের মুখে এইসব কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল নীলার। এক মেয়ে হবার কারণে খুব আদরে মানুষ হয়েছে নীলা। বাসন মাজা, রান্না এইসব তো জীবনে করেনি। রজতকে মায়ের কথাগুলো বলতেই রজত বললো, এইসব মেয়েলি কথা আমাকে বলবে না, এটা তোমার আর মায়ের ব্যাপার। আর মায়ের কথাই এই বাড়ীতে শেষ কথা। মায়ের কথা শুনে চলো, ভালো থাকবে, আর না হলে মায়ের মুখ ঝামটা শুনতে হবে। আমি তোমাদের মধ্যে নেই। আমাকে কোনোদিন নালিশ করবে না মায়ের নামে।
নীলার দু’চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো,নীলা বললো, তোমরা তাহলে আমাকে কাজের লোক হিসাবে নিয়ে এসেছো? রজত বললো, বিয়ের পর সব মেয়েই নিজের সংসারে কাজ করে। সবাই কি তাহলে কাজের লোক? আমার মা তো ভোর বেলা উঠে আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে সবার সাথে মিলে সংসারের যাবতীয় কাজ করতো, তাহলে আমার মা কি কাজের লোক?
-থাক রজত আমার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে, আর কিছু বলতে হবে না। স্বামীর বাক্যবাণ শোনার পর শুরু হলো শাশুড়ির বাক্যবাণ। রান্নাঘরে গিয়ে রান্না না করতে পারার কারণে শুনতে হলো, মা কি কিছুই শিখিয়ে পাঠায় নি। চুপ করে রইলো নীলা। শ্বশুর বাড়িতে কম বেশি সব মেয়েদেরকেই এমন কথা শুনতে হয় শাশুড়িদের মুখে। অবশ্য তার ব্যাতিক্রমও আছে। সবাই একরকম হয় না। তবে তার সংখ্যা খুব কম। রজতকে একদিন এম,এ-তে ভর্তি হবার কথা বলতেই রজত বললো, আর কি দরকার পড়াশোনা করার, চাকরী আমি তোমাকে করতে দেব না, তাছাড়া মাও রাজি হবে না। আমাদের তো যথেষ্ট সচ্ছল অবস্থা। তোমাকে বাইরে বেরিয়ে টাকা রোজগার করতে হবে না। নীলার আবার স্বপ্নভঙ্গ হল। নীলা বললো, বাবা যে বলেছিল আমাকে পড়াবে?
– ও সব কথার কথা। মন দিয়ে সংসার করো। এরপর আমাদের সন্তান আসবে, তাদের মানুষ করো। পড়াশোনা আর চাকরীর ভূত মাথা থেকে তাড়াও।
নানা রকম বিধিনিষেধ নীলার ওপর আরোপ করলেও নীলাকে ভালোবাসতো রজত। নীলার কখন কি দরকার মুখ ফুটে বলার আগেই সব হাজির। সেই ভালোবাসার টানেই সব স্বপ্নভঙ্গের পরও সংসার করে চলেছে নীলা। নীলাও রজতকে ভীষণ ভালোবাসত।
অনেক বছর কেটে গেছে। শ্বশুর শাশুড়ি আজ কেউ বেঁচে নেই। নীলারও একটি মাত্র মেয়ে। নীলা মেয়েক নিজের মনের মত মানুষ করেছে। নিজের স্বপ্ন পূরণ হয়নি তাই মেয়ের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি ছিল নীলার। কোনো অবস্থাতেই মেয়ের স্বপ্নভঙ্গ হতে দেয় নি। রজতকে সাফ জানিয়েছিল, মেয়ে নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত মেয়ের বিয়ে দেবে না।
মেয়ের খুব ইচ্ছা ছিল আইন নিয়ে পড়ার। সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে মেয়ের। মেয়ে আজ একজন আইনজীবী।
নিজের স্বপ্নভঙ্গ হলেও মেয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, এটাই আজ নীলার একমাত্র ভালোলাগার জায়গা।