মাটির টান
– সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)
আর দু’দিন পর অনবদ্য-র পঞ্চাশতম জন্মদিন। বিরাট বড় করে পালিত হবে। আত্মীয় বন্ধু সবাই খুব উৎসাহী এই ব্যাপারে। কিছু কিছু আত্মীয় এসেও পরেছেন। তার শ্বশুর শাশুড়ী তো এক সপ্তাহ আগের থেকেই এসে গিয়েছেন। শালা শালীরাও আজ চলে এসেছে। ঘরবাড়ি বেলুন, রকমারি জিনিস দিয়ে সাজাচ্ছে তারা।ডেকোরেটরের লোকও আসবে। সারা বাড়িতে খুশির হাওয়া। কিন্তু অনবদ্যর মনে তেমন খুশি নেই কেন? তাকে কেমন যেন উদাস উদাস লাগছে। তার মনটা ফিরে যাচ্ছে ছোট্টোবেলায়।
আসনটা পাত রে তিন্নি। ধান দুব্বাগুলো ঠিক করে রেখেছিস তো? প্রদীপটাতে ঠিক ঠাক করে তেল দে। তিন্নি এ বাড়িতে মায়ের সহকারী। পায়েসের গন্ধে সারা বাড়ি ম ম করছে। দুপুরে আনন্দ করে মায়ের রান্না করা মাংস ভাত, পাঁচ ভাজা, মাছের মুড়ো, পায়েস, মায়ের হাতের কিছু বিশেষ মিষ্টি এইভাবেই কাটতো ছোটবেলার জন্মদিনগুলো। “জাম্বো, (ছোট শালী এই নামেই ডাকে) বারান্দাটা কেমন সাজানো হয়েছে একবার দেখে যাও। ও জাম্বো কি এত ভাবছো?”
“ওহ যাচ্ছি।”
“খুব সুন্দর করে বারান্দা সাজানো হয়েছে। রাত্রে আলো জ্বললে আরো ভালো লাগবে।”সানিরিটা (অনবদ্যর স্ত্রী)বললো। কিন্তু অনবদ্যর মন কি যেন খুঁজে বেরাচ্ছে। খুব ছোটবেলায় জন্মদিনগুলো খুবই উপভোগ করতো অনবদ্য, সকলের আদরের অনি। কিন্তু যত উচু ক্লাশে উঠতে লাগলো অনবদ্য ততই তার এই জন্মদিনের কর্মকাণ্ডগুলোকে অনর্থক মনে হতে লাগলো। তার বন্ধুদের জন্মদিনে কত বড় বড় কেক কাটা হয়, আর তার জন্মদিনে পুরানপন্থী সব ব্যাপার। জন্মদিনের দিনগুলো মায়ের তৈরী পায়েস পর্যন্ত সে খেতে চাইতো না। বাবাকে দিয়ে জোর করে কেক আনাতো। বিরিয়ানি, চিলি চিকেন খেতে বাবাকে জোর করে তাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে বাধ্য করতো। তবুও তার মা প্রতিবছর তার মঙ্গল কামনায় পায়েস, পাঁচভাজা সবই করতো। মুখে ছোঁয়াতেও চাইতো না এইসব।
ধীরে ধীরে দিন কাটে। অনবদ্য ইঞ্জিনিয়ার হয়। নামী কোম্পানিতে চাকরি পায়। একই কোম্পানিতে কাজ করা আধুনিকা সানিরিটাকে তার ভালোলাগে। ভালোবাসার বাঁধনে ধরা পরে। পরিণতিতে বিবাহ হয়। আধুনিকা সানিরিটা প্রথম থেকেই এ বাড়িতে মানাতে পারে নি। যদিও তার কোনো স্বাধীনতায় কোনোদিন হস্তক্ষেপ করেনি অনবদ্যর মা। পোষাক থেকে খাবার দাবার সব কিছুতেই নিজের ইচ্ছামত চলতো সানিরিটা। তবুও আলাদা বাড়ি কেনালো অনবদ্যকে দিয়ে। অনবদ্যরও তখন মনে হলো, সে তার নিজের মত করে থাকতে পারবে। মুক্তি মুক্তি বড় আনন্দের মুক্তি।
কয়েকবছর কেটে গেল। তাদের একটা পুত্র সন্তানও এসে গেছে এর মধ্যে। কিন্তু এই লাগামছাড়া জীবন, দিনরাত এই দোকান থেকে আনা খাবার আজকাল যেন আর তার ভালো লাগছে না।
“পাপা চলো দেখবে পুরো বাড়িটা কি সুন্দর লাগছে।”
“হ্যাঁ বাবু আসছি।” সত্যিই বাড়িটা সুন্দর লাগছে। কিন্তু অনবদ্যর মন কেন যেন বারবার পুরানো সেই মিষ্টি চন্দনের গন্ধ, পায়েসের গন্ধ পেতে চাইছে। একদিন নিতান্তই যা ছিল তার কাছে অপ্রয়োজনীয় আজ যেন তার দিকেই মন ফিরে যেতে চাইছে। জন্মদিনে খুব ভোরে তার ঘুম ভেঙে গেল, সবাই তখন আরাম নিদ্রায়। সব ব্যাবস্থাই তো করবে বাইরের লোক, বাড়ির মানুষের তো বিশেষ কাজ নেই। ধীরে ধীরে বাইরে এল অনবদ্য। মা বলতেন ভোরবেলা উঠলে মনে এক অকৃত্তিম ভালোলাগার সৃষ্টি হয়। ভোরের আকাশের দিকে তাকালে মনে এক পবিত্রতা অনুভব হয়। সদ্য উদিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে আকাশ। সারা আকাশে দিনমণির রাঙা আভা ছড়াচ্ছে। মনে পড়ছে সকালে উঠে তার মা বাবার সূর্য প্রণাম করার দৃশ্য। সেই সুন্দর সূর্য স্তোত্র কানে বাজছে। খুব ইচ্ছা করছে বাবার গুরুগম্ভীর গলায় ওই স্তোত্র শুনতে। মা প্রতিদিনই সকালে উঠে স্নান করে তুলসী মঞ্চে জল দান করে, সূর্য প্রণাম করে, ঠাকুর ঘরে ঠাকুর পুজো করে তারপর ঘরের কাজ করতেন নিপুণ হাতে। মিষ্টি ধূপ ধুনোর গন্ধে ঘর ভরে উঠতো। আর জন্মদিনের সকালে ঠাকুর ঘরে আসন পাতা, ধান দুব্বোতে আশীর্বাদ। “কিগো এত ভোরে বাইরে বেরিয়েছো কেন?” অনবদ্যকে পাশে না দেখে,উঠে বাইরে এসে বললো সানিরিটা। “আর একটু ঘুমিয়ে নাও, ক্যাটারার, ডেকোরেটার তো বাকি কাজগুলো করবে। আমদের তো বিশেষ কাজ নেই। কেকও দিয়ে যাবে নামী কোম্পানি। জলখাবারেও নামী নামী জায়গার দামী দামী খাবার আসবে।” সাজানো ডাইনিং রুমে বড় টেবিলে নামী জলখাবারের সম্ভার। অনবদ্য দেখছে। কদিন আগে অফিস ফেরত এক পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল অনবদ্যর। ছোট্ট বেলার পাড়ার বন্ধু রীতম। তারপর একদিন হঠাৎই সকালে তার বাড়িতে গিয়েছিল অনবদ্য। আজকাল পিছনের দিনগুলো বড় বেশী টানছে তাকে। রীতমের মা, বাবা,স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। রীতমের মা অনবদ্যকে দেখে খুব আনন্দিত। জলখাবারে তারা আলুসেদ্ধ ভাত খাচ্ছিল। অনবদ্যর জন্য লুচি করতে চাইলে সে বললো, “কাকিমা আলুসেদ্ধ ভাতই আমি খাব তুমি মেখে দাও।” দুপুরে কাকিমা ও রীতমের স্ত্রীর তৈরী শুক্তো, মুসুর ডাল,মোচার ঘণ্ট, আলুভাজা, পুঁই শাক, চাটনি, রুইমাছের ঝোল খেল। অনেকদিন পর তার যেন মনে হলো অমৃত খেলো। আর হ্যাঁ রীতমের মা বাবা আর রীতমের পরিবার বিরাট প্রাচুর্যের মধ্যে না থাকলেও ভীষণ ভীষণ আনন্দে আছে বুঝতে পারলো।
“ওয়াহ্” খাবার দেখে অনবদ্যর ছেলে খুব খুশি। জলখাবার খাওয়ার সময় হলো। কিন্তু কোথায় অনবদ্য!
জন্মদিনের সকালে জলখাবার খাওয়ার সময় অনবদ্যকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ছোট্ট একটা মেসেজ এল সানিরিটার মোবাইলে। অনবদ্য জানিয়েছে খুব দরকারী কাজে তাকে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের আগে সে ঠিক এসে যাবে। ফোন বন্ধ তার। বাড়ির গেট দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। গাড়ি নিজেই চালাচ্ছে অনবদ্য। মনে হচ্ছে কতক্ষণে বাড়িতে পৌঁছাবে। হ্যাঁ সেই বাড়ি যেখানে অনবদ্যর শৈশব, কৈশোর, যৌবন লালিত। স্নেহ ভালোবাসার মূর্তপ্রতীক সেই ঘর সেই বাড়ি। অনেক পুরানো স্মৃতি বিজরিত সেই বাড়ি। গেট দিয়ে ঢুকছে সে। একি পায়েসের গন্ধ ভেসে আসছে। কিন্তু মা তো জানতো না অনি তার আদরের অনি আসবে। তবে কেন মা পায়েস তৈরী করবে?
“মা… মা“
এ কার গলা শুনছেন অনিন্দিতা(অনবদ্যর মা)?নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না অনিন্দিতা। হ্যাঁ তার খোকাই তো। ঠিক দেখছেন তো? বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দুজনের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো অনি। ঠিক যেমন করে ছোটবেলায় করতো।
“মা মাগো তুমি তো জানতে না আমি আসবো, তবে কেন পায়েস করেছো মা?”
“আমি প্রতি বছরই পায়েস করি, আসন সাজিয়ে ধান দুব্বো নিয়ে অপেক্ষা করি, ভাবি যদি আসিস। প্রতিবছরই পায়েস গোপালকে নিবেদন করি আর পাশের বস্তির বাচ্চাদের পায়েস খাওয়াই। ওদের খুশি মুখ আমার মনকে ভরিয়ে দেয়। আর ধান দুর্বা গোপালের সামনে রেখে তোর মঙ্গল কামনা করি।” অনবদ্যর চোখে জল।
“মাগো খুব ক্ষিদে পেয়েছে। আমি জলখাবার না খেয়েই আমি বেরিয়ে এসেছি। ওই পিৎজা, কাটলেট আমার আর ভালো লাগছে না মাগো। ”তাহলে একটু লুচি ভাজি।”
“না মা তোমার হাতে মাখা আলুসেদ্ধ ভাত খেতে চাই সেই ছোট্টবেলার মত।” মার চোখে জল। ভাত মেখে নিজের হাতে খাওয়ালেন ছেলেকে।
“কিন্তু তোর বাড়িতে তো প্রচুর লোকজন”
“হ্যাঁ, অনুষ্ঠান সন্ধ্যাবেলা। আমি সময় মত ফিরে যাব, কিন্তু মাগো আজকের দুপুরটাকে ছোটবেলার মত করে দাও। দুপুরেও বিরিয়ানি চিলি চিকেনের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু মা আমি যে আজ দুপুরে তোমার হাতের রান্নাই খেতে চাই। বড় ক্লান্ত লাগে আজকাল ওইসব ভারী ভারী খাবার খেতে। দেবে না আমায় পাঁচভাজা সাজিয়ে খেতে?”
“পাঁচ ভাজা আমি করেছি। ওই যে বললাম প্রতি বছরই ঈশ্বরের কাছে চাই, তুই যেন একবারটি আসিস, আর অপেক্ষা করি। ঈশ্বর আমার কথা শুনেছেন রে!” আবেগে বারবার চোখে জল আসছে অনিন্দিতার।
না, ডেকোরেটার দিয়ে সাজানো টেবিল নয়, নিতান্তই সাধারণ টেবিল, আর নিজের বাগানের ফুল দিয়ে টেবিলটাকে সুন্দর ভাবে সাজিয়েছেন তিনি। ঐতিহ্যপূর্ণ বাঙালি রান্না আর পাঁচ ভাজা তার সামনে। মা পায়েস তুলে দিলেন ছেলের মুখে। কত কত দিন পর আবার সেই আগের মত। কী অসাধারণ তৃপ্তি এই খাবারে। যা একদিন ছিল একান্তই অপছন্দের তাই যেন আজ অনবদ্যের কাছে ভীষণ ভীষণ কাম্য হয়ে উঠেছে। ওই সুবিশাল কেক আজ মায়ের হাতের পায়েসের কাছে হেরে গেছে। হেরে গেছে বিরিয়ানি, পিৎজারা পাঁচ ভাজা সুশোভিত বাংলা মায়ের রান্না, বাংলা মায়ের স্নেহ ভালোবাসার কাছে।
বাঃ, খুব ভাল লাগল রে!