Site icon আলাপী মন

গল্প- নবযৌবন

নবযৌবন
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

তনুদি এসে গেছে বড় মামি। তনুদি এসে গেছে।এই বলে চিৎকার করতে লাগলো তনুশ্রীর পিসতুতো বোন পম্পি।পম্পির কথা শুনে বিয়ে বাড়ির আগন্তুক আত্মীয়দের অনেকেই ছুটে এলো তনুশ্রীদের বাড়ির সদর দরজায়। মন্ডল বাড়ির সবচেয়ে আদরের মেয়ে তনুশ্রী। তবে সেই আদরের কারণে যে সকলে ছুটে এলো তা ষোলআনা ঠিক নয়। সবার মনের কৌতুহল এত অল্প বয়সে ইউট্রাস রিমুভ করে কেমন আছে তনুশ্রী।

তনুশ্রীকে দেখা মাত্রই তনুশ্রীর মেজ পিসির মেয়ে সুলতা বলে, হ্যাঁ রে তনু কেমন আছিস? শারীরিক কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? দেড়বছর হলো তো তোর অপারেশনের।

তনুশ্রী একগাল হাসি দিয়ে বলে, না গো আমি পুরোপুরি সুস্থ আছি।

এতক্ষনে তনুশ্রীর মা এসে হাজির সদর দরজায়।সবাইকে ধমকের সুরে বলে, কি আশ্চর্য মেয়েটা তিন ঘণ্টা জার্নি করে এলো এতটা পথ। ওকে একটু জিরিয়ে নিতে দে।

সুলতাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে তনুশ্রীর মা তমালী দেবী বলে, তনুর অপারেশন নিয়ে ওকে বেশি কথা জিজ্ঞেস করিস না। ও পছন্দ করে না।

সুলতা মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও মুখে বলে, ঠিক আছে মামী। আর কিছু জিজ্ঞাসা করবো না। আসলে কি বলো তো আমারও তো চার বছর আগে এই একই অপারেশন হয়েছে তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। দেখ অপরাশেনের পরই আমি কেমন মোটা হয়ে গেলাম। তনু তো বেশ ভালোই আছে দেখছি।

তমালী দেবী বলে, তোদের তো চল্লিশের পর ইউট্রাস বাদ গেছে আর মেয়েটার আমার বত্রিশ বছর বয়সেই শরীর থেকে এই রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে কেটে বাদ দিতে হলো। কথাগুলো বলতে বলতে তমালী দেবী কেঁদেই ফেললেন।

কোন রকমে নিজেকে সামলে বলেন, সুলতা জামাইদের জলখাবারের দিকটা একটু খেয়াল রাখিস। মলয় একদম মুড়ি খেতে পারে না। পারলে একটু ময়দা মেখে রাঁধুনিকে দিস। ও লুচি ভেজে দেবে।
-ঠিক আছে মামী। আমি মলয়কে বাগিয়ে গুছিয়ে জলখাবারটা দেবো। যতই হোক বড় শালী হই আমি।

তনুশ্রী সবার সাথে একটু আধটু সৌজন্য করে নিজের ঘরে গেল। দক্ষিণ দিকের এই দশ বাই বারো রুমটার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তনুশ্রীর ঘরের ডেকরেশন অনেক খানি পরিবর্তন হয়ে গেছে এখন। বিয়ের আগে জানালার পাশে একটা স্টাডি টেবিল রাখা থাকত।

আকবরের রাজত্ব কাল মুখস্থ করতে করতে যখন হাঁপিয়ে উঠত তখন জানালা দিয়ে বাইরের গাছপালা, ফুল, পাখি এদের দেখে বেড়াতো।
আর মনে মনে ভাবতো, ইশ্ যদি আমি কোকিল হতাম সুরেলা কণ্ঠ দিয়ে সকলের মন জয় করতাম।

আবার কখনো ইউক্যালিপটাস গাছটা দেখে মনে হতো, যদি আমি ইউক্যালিপটাস গাছ হতাম আকাশের কত কাছে পৌঁছে যেতাম। আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো মেঘগুলোর সাথে গল্প করতে পারতাম।

আসলে ছোট্ট থেকে তনুশ্রী ভীষণ আবেগপ্রবণ। তনুশ্রীর রুমের উত্তর দিকের বক্স জানালাটা বেশিরভাগ দিনই বন্ধ থাকতো।
একদিন তনুশ্রী লক্ষ্য করে এই জানালার এক কোণে একটি ঘুঘু পাখি বাসা বানিয়েছে। ডিম ফুটে ছোট্ট ছোট্ট তিনটে ঘুঘুর বাচ্চা বের হয়েছে।
তনুশ্রী রোজ সকালে দূর থেকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতো কিভাবে মা ঘুঘুটি বাচ্চা ঘুঘু পাখিগুলোকে আদর করল। তনুশ্রী মনে মনে বলতো পাখিদেরও মাতৃত্ব এর অনুভূতি কি প্রবল। প্রতিটি বাচ্চার প্রতি সমান স্নেহ।

প্রথম যেদিন প্রেগন্যান্ট হওয়ার মেডিক্যাল রিপোর্ট হাতে পায় তনুশ্রী সেদিন মলয়কে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমার কিন্তু দুটো বেবি দরকার। আমার মতো সিঙ্গেল চাইল্ড আমি চাই না।

মলয় রসিকতা করে বলে, আমার ঠাকুমার মতো গোটা পাঁচেক হলেও মন্দ হয় না। তুমি কি বলো?

তনুশ্রী সোহাগ মাখা সুরে বলে, আমি রাজি। আমার নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি না যৌথ পরিবার ভালো লাগে।

এই তনুশ্রীই মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে ইউট্রাস রিমুভ করতে বাধ্য হয়। পরিয়ডের অনিয়মিত ঋতুস্রাব, তলপেটের অসহ্য ব্যথা নিয়ে তনুশ্রী অস্থির থাকতো মাসের বেশিরভাগ দিন।

মাত্রাতিরিক্ত ব্লিডিং এর কারণে বাড়ি থেকে কোথায় বের হতে চাইতো না। একবার জোর করে মলয় শপিং মলে নিয়ে যায়। কিন্তু বাড়িতে ফিরতে না ফিরতেই ওভার ফ্লো এর কারণে চুড়িদারে লেগে যায় রক্তের দাগ। কোনো রকমে ওড়না দিয়ে ঢেকে আবাসনের কৌতুহলী চোখগুলো এড়িয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল সেদিন।

তারপর দিনই অফিস থেকে ফিরে মলয় প্রায় জোর করেই গাইনোকলজিস্ট এর কাছে নিয়ে যায়।

উনি সব শুনে প্রথমেই দ্বিতীয় সন্তানের কথা বলেন। কিন্তু তনুশ্রী জানায় তার স্বামী দ্বিতীয় সন্তান চায় না। ডাক্তার ইউ,এস,জি করতে বলে lower abdomen এর। ইউ.এস.জি রিপোর্টে ধরা পড়ে তনুশ্রীর জরায়ুতে মাল্টি ফাইব্রয়েড হয়েছে। যেহেতু মাল্টি ফাইব্রয়েড তাই জরায়ু কেটে বাদ না দিলে পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই কথা শোনা মাত্রই মলয় বলে, যখন আমাদের দ্বিতীয় সন্তান দরকার নেই তখন বার বার শরীরকে কাটা ছেঁড়া করে লাভ কি? ডাক্তার ম্যাডাম বলে,
জরায়ু কেটে বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স অত্যন্ত অল্প তনুশ্রীর। যদি ওষুধ দিয়ে আরো তিন চার বছর কন্ট্রোলে রাখা যায় এই অসুখটাকে তাহলে ভালো হয়।

কিন্তু তা আর সম্ভব হয় নি। দিন দিন তনুশ্রীর হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যেতে থাকে। গায়ের রং কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে আসছে। বয়স অল্প হওয়ার দরুণ ছোট সংসারের কাজ, ছেলেকে সামলানো সবই করতো কিন্তু একবার বিছানায় পিঠ পাতলে আর উঠতে ইচ্ছে করতো না তার।

তনুশ্রী দু’ একবার ভেবেছে দ্বিতীয় সন্তানের কথা। কিন্তু মলয়ের একদম ইচ্ছা ছিল না। মলয়ের ব্যস্ত জীবনে নতুন অতিথির জন্য অতিরিক্ত সময় একদমই ছিল না। আর তনুশ্রীর একার পক্ষে দু’টো বাচ্চাকে সামলানো সম্ভব ছিল না। সুতরাং দ্বিতীয় সন্তান এর ইচ্ছা পরিত্যাগ করে ইউটেরাস রিমুভ এর সিদ্ধান্তকেই স্বাগত জানায়।

যখনি পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন তনুশ্রীর ইউট্রাস অপারেশন হবে এই কথা জানতে পারলো তখনই উপদেশের ঢেউ আছড়ে পড়ল তনুশ্রীর জীবনে।

তনুশ্রীর সবথেকে নিকট প্রতিবেশী রায় জেঠিমা বলে, তনু ইউট্রাস বাদ যাওয়া মানে কিন্তু স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হওয়া। শারীরিক সম্পর্ক ঠিক না থাকলে স্বামীদের বিপথগামী হতে বেশি সময় লাগে না।

মলয়ের অফিসের সিনিয়র কলিগ ঘোষদার গিন্নি এসে বলে, মলয়ের আর কতই বয়স। তোর থেকে বছর তিনেকের বড়। এই বয়স থেকে তোর ইউট্রাস রিমুভ হয়ে গেলে মলয়ের তো আর তোর দিকে নজরই থাকবে না। দেখবি কেমন হঠাৎ করে মোটা হতে শুরু করবি, শরীরের গ্ল্যামার কমে যাবে। ইউট্রাস না থাকা মানে একটা মেয়ের জীবনের যৌবনটাই শেষ।

ডাক্তার ম্যাডামও বলেছিল, তনুশ্রী ইউট্রাস রিমুভ করা মানেই কিন্তু তোমার বয়সটা দশটা বছর বাড়িয়ে দিলাম। নিজের শরীরের জন্য কিন্তু তোমাকে যত্নশীল হতে হবে। খাওয়া দাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম এইগুলো কিন্তু নিয়ম মেনে করতে হবে।

তাই অপারেশনের একবছর পর থেকেই তনুশ্রী হালকা হালকা যোগাসন, মেডিটেশন এইসব জীবনের মূলমন্ত্র করে অকাল বার্ধক্যের সাথে লড়াই করার জন্য মনে মনে তৈরী হয়ে উঠেছে।

তার জন্য সপ্তাহের পাঁচ দিন তনুশ্রীকে ভোর পাঁচটায় বিছানা ছাড়তেই হয়। সকালে ফ্রেশ হয়ে নিত্য আধঘণ্টা যোগ ব্যায়াম করা চাই চাই। তারপর মলয়ের অফিসে নিয়ে যাওয়ার জন্য টিফিন বানায়।

স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির পর্ব শেষ হতে না হতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে ছিল তনুশ্রী। বিয়ের পর দুউটো বছর সকাল আটটার আগে কিছুতেই বিছানা ছাড়তো না। বড্ড ঘুম কাতুরে সে।

মলয় রোজ মর্নিং ওয়াকে বের হতো ঘরের ইন্টার লকটা লাগিয়ে দিয়ে। বিয়ের পর পর মলয় তনুশ্রীকে বলতো মর্নিং ওয়াকের করা কথা। কিন্তু তনুশ্রী আল্লাদে গদগদ হয়ে বলতো, আমার শরীর স্বাস্থ্যের চেয়ে ঘুমটা বেশি প্রিয়।

মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে যখন তার ইউট্রাসে মাল্টি ফাইব্রয়েড হলো তখন সে বুঝলো জীবন তার থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছে যৌবন।

তার জীবনে পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রতি মাসে অসহ্য তলপেটের যন্ত্রনা তাকে সহ্য করতে হতো। বিয়ের আগে তো তনুশ্রী পিরিয়ডের চারটা দিন মায়ের হাতে ছাড়া খাবার খেতেই চাইতো না।

সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতো পেটে হট ব্যাগ নিয়ে। কখনো কখনো ব্যথার ওষুধও নিতে হতো। বিয়ের পর স্বামীর ঘরে এসেও এক অশান্তি প্রতি মাসে। যদিও মলয় মাতৃ স্নেহ দিতে পারতো না তবুও অফুরান স্বামীর ভালবাসা সে দিত।

অফিস যাওয়ার আগে ভাত, ডাল ভাতে, আলু ভাতে, ডিম ভাতে করে ডাইনিং টেবিলে রেখে যেত। হট ব্যাগে জলও ভরে দিত। এয়ার টাইট কনটেইনারে বিকালে খাওয়ার জন্য ফলও কেটে রেখে দিত।

তনুশ্রী পিরিয়ডের যন্ত্রণা মলয়ের কাছেও ছিল অসহনীয়। তাই তনুশ্রীর শরীর থেকে ইউট্রাস রিমুভ করার ক্ষেত্রে পূর্ণ সমর্থন ছিল মলয়ের।

অপারেশন এর পর তনুশ্রীকে সব সময় আনন্দে রাখার চেষ্টা করে মলয়। অফিস থেকে পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে সারাদিন তনুশ্রীর সঙ্গে কাটিয়েছিল। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন যখন তনুশ্রীর মনোবল ভাঙতে বদ্ধপরিকর তখন মলয় সবসময় যুক্তি দেখিয়েছে, একটা রোগকে শরীরে বাসা বাঁধতে দেওয়ার থেকে তো দূর করা ভালো।

স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা কি শুধুই শরীর থেকে আসে! স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, বোঝা পড়া, নির্ভরতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এইসব কিছু আসে দু’জনের অন্তর থেকে।

আজ দেড়বছর হয়ে গেছে তনুশ্রীর ইউট্রাস কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে তনুশ্রীকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। বরং আগের থেকে অনেক বেশি ফিগার সচেতন হয়েছে সে। শরীরের লালিত্যও কোনো অংশে এখনও কম হয় নি।

মেয়েদের জীবনের এই কঠিন অসুখকে শুধুমাত্র মনের জোরে অনেক খানি দূরে সরিয়ে দিতে পেরেছে তনুশ্রী। পিরিয়ডের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেয়ে মাসের প্রতিটি দিনই এখন সে এ্যাকটিভ থাকে।

ভাইয়ের বিয়েতে তনুশ্রীকে দেখে সবাই তো হতবাক। ইউট্রাসের অপারেশন এর পরও তনুশ্রী পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে জীবনকে উপভোগ করছে। তবে তনুশ্রী সবাইকে বলে, তার এই মনের জোর কিন্তু সে মনের মানুষের কাছ থেকেই পেয়েছে।

Exit mobile version