গল্প- শুভ বিবাহ

শুভ বিবাহ
– তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন একটা মেয়েকে খুব ভালো লাগতো অংশুমানের। কিন্তু সে মেয়ে তাকে বিশেষ পাত্তা দিতো না। আর দেবেই বা কেন? অংশুমান নিতান্তই গোবেচারা, ভালোমানুষ টাইপের। আজকাল মেয়েরা আবার একটু হ্যান্ডু কায়দাবাজ ছেলে পছন্দ করে। সে যাক গে। মনের দুঃখ মনেই চেপে মন দিয়ে পড়াশুনোটাই করেছে অংশু আর তারপর বেশ ভালো একটা চাকরী পেতেও অসুবিধা হয়নি ওর। তবে আর কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও চায়নি কখনো।

সেই অংশুমানের বিয়ে। বাড়ির পরিজনের উপরেই দায়িত্ব বর্তেছে পাত্রী পছন্দ করার।অংশুর একটাই দাবী পাত্রী যেন পড়াশুনোয় একটু ভালো হয়।

পুরোদমে পাত্রী দেখা চলছে। যদিও খুব বেশী বাছাবাছি অংশুর পছন্দ নয়। আর পাত্রী দেখতেও ও যায় না। এসব ব্যাপারে বাড়ির গুরুজনের উপরেই নির্ভর করে আছে ও।

ফাইনালি দু’টি মেয়েকে সিলেক্ট করেছে ওরা।এদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিতে হবে।তাই অংশুকে যেতে হয়েছে এবার।

একজন শ্রীতমা — শ্যামবর্ণা, সুন্দর মুখশ্রী, অপূর্ব চোখদু’টি-কেমন ভাসাভাসা। ওই চোখেই একবার চোখ পড়লো অংশুর। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলো সে।

আরেকজন অপর্ণা। বেশ অবস্থাপন্ন পরিবারের একমাত্র মেয়ে। ফর্সা, সুন্দরী, বেশ লক্ষ্মী লক্ষ্মী দেখতে।

দু’টি মেয়েই গুণী, লেখাপড়ায় ভালো কিন্তু রঙের বিচারে অপর্ণাকেই পছন্দ করলো অংশুর পরিবার। তারা বললো লক্ষ্মী আসুক ঘরে।

কিন্তু অংশুর মন আটকে রয়েছে সেই কাজল কালো চোখে। বোনকে চুপিচুপি পছন্দের কথা বলেওছে। কিন্তু বাড়ির গুরুজনেরা তো বেশী অভিজ্ঞ। আর তাছাড়া অংশুর কথায় তারা পাত্তা দিতেও রাজী নয়। ঠাম্মা তো বলেই বসলো মেয়ে ফর্সা হলে কাচ্চাবাচ্চারাও ফুটফুটে হবে। এসব শুনে সে মুখ ফুটে আর কিছু বলতে পারলো না লজ্জায়। আর বলবেই বা কেন? এতো আর প্রেমের বিয়ে নয়। অভিভাবকরা যেটা ভালো বুঝবে সেটাই করবে।

আর তাছাড়া অংশুর দাদা প্রেম করে বিয়ে করেছে আর সেই বড়বৌকে বাড়ির কারোর পছন্দ না। সে মেয়ে না’কি বাড়ির কারো সাথে মানিয়ে চলতেই পারে না। নানা অশান্তির পর দাদা আলাদাই থাকে। অবশ্য অংশুর বৌদির সাথে ভালোই ভাব আছে। বৌদি চাকরী করে, স্বাধীনচেতা। তাই সব ব্যাপারেই নিজস্ব মতামত আছে তার। পুরোনো ধ্যানধারণায় আটকে থাকা মানুষজন সে’সব মানবে কেন?

এমতাবস্থায় বাড়ির ছোটবউকে নিজেরাই পছন্দ করে আনুক…এই ভাবনা থেকেই অংশু চুপ থাকে। অংশু নিজে সবার সাথে খুব এডজাস্ট করে চলতে পারে কারণ ও উদার প্রকৃতির। তাই ও ভাবে বাড়ির সবাই যদি বউকে পছন্দ করে তা’হলে ওর কোন অসুবিধা নেই। আর তাছাড়া খারাপ কিছু হলেও কেউ অন্তত ওকে দোষারোপ করতে পারবে না।

বিয়ের তোড়জোড় শুরু হ’লো জোরকদমে।বিয়েবাড়ি ভাড়া, বিয়ের কেনাকাটা, কার্ড ছাপানো, নেমন্তন্ন সব শেষ। এখন শুধু বিয়ের দিনের অপেক্ষা।

কাল অংশুর বিয়ে। নিকট আত্মীয়স্বজনরা এসে পড়েছেন।
একেবারে হৈহৈ ব্যাপার। বাড়ির ছোটছেলের বিয়েতে বাড়িটাও আলোয় আলোয় সেজে উঠেছে। খাওয়াদাওয়া, সাজগোজ নিয়ে সবাই ব্যস্ত। হাসি-মজা আনন্দের হাট বসে গেছে।

হঠাৎ একটা ফোন এলো–বিয়ের কনে কা’র সাথে পালিয়ে গেছে। সবাই হতভম্ব। অংশুর বাবার মাথায় হাত। মা কেঁদে চলেছেন। বাকীরা সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। নিমেষে বিয়েবাড়ির চেহারা পাল্টে গেলো।
শুধু অংশু ফুট কাটলো- লক্ষ্মী পালালো!

অংশুমানের বাবা দীপনবাবু বিয়ে ভেঙে গেছে এটা সবাইকে ফোনে জানিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু এইপ্রথম অংশু বাধা দিলো। এত লোকজন, বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগ সবার সামনে ছোট হবে না সে। সে কালকেই শ্রীতমাকে বিয়ে করবে।

অগত্যা অংশুর ইচ্ছেয় আগের বাতিল করা পাত্রীর সাথেই যোগাযোগ করা হলো।
তারাও এত সুপাত্র হাতছাড়া করতে চাইলেন না। কিন্তু বেঁকে বসলো পাত্রী শ্রীতমা। তাকে বোঝাতে ছুটতে হলো অংশুকেই। তারপর দুজনে একান্তে কী কথা হ’লো কে জানে!! অবশেষে রাজী হলো সেই কৃষ্ণকাজল মেয়ে।

দীপনবাবুও মেয়ের বাবা প্রতাপবাবুকে বুঝিয়ে বললেন- “আপনাদের কোন অসুবিধা হবে না।কাল শুধু মেয়েকে নিয়ে আমার আত্মীয়ের বাড়ীতে চলে যাবেন। আমরাই সব ব্যবস্থা করে নেবো। কুলদেবতা আর মাকালীর আশীর্বাদে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না। আর একমাস বাদে একটা দিন দেখে রেজিস্ট্রিটা করিয়ে নেবো। তখন আপনাদের লোকজনদের সব নিমন্ত্রণ করে দেবেন। আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবেন–ছেলের ঠাকুমার বয়স হয়েছে অসুস্থ, তাই তাড়াতাড়ি বিয়েটা দিতে চাইছেন ওরা। ব্যস তা’হলে সবদিক সামলিয়ে যাবে। আমি আবার দেখি ওইদিকে কীভাবে ম্যানেজ দেওয়া যায়।”

দুপক্ষের কথার শেষে বাড়ি ফিরে আসে ওরা।
অবশেষে নির্ধারিত শুভদিনে শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হলো।
ফুলশয্যার রাত। বর-কনে মুখোমুখি।

“অগত্যা বাধ্য হয়েই এই কালো মেয়ের গলায় মালা দিতে হলো তা’হলে?” বললো শ্রীতমা।

“মোটেই না। এটা আমার ইচ্ছের জোর। আমি চেয়েছিলাম তাই কালো নয় আলো জ্বললো আমার ঘরে ” বলে মৃদু হাসলো অংশু।

“বাহ দারুণ তো! তা এই ইচ্ছের জোরে তুমি আর কি কি করতে পারো মশাই?”

“তুমি আমার কথা রেখেছো। আমার সম্মান বাঁচিয়েছো। কৃতজ্ঞতা জানাবো না…কাছের বন্ধুকে শুধু আজ একটা কথা চুপিচুপি বলি– তোমায় যেদিন দেখেছি সেদিনই ভালো লেগেছে…আমার সারাজীবন ধরে তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসবো আর তোমায় যোগ্য মর্যাদা দেবো।
আর এখন থেকে দেখতে থাকো প্রিয়া, তুমি পাশে থাকলে আমি কি কি করতে পারি” বলে হেসে শ্রীতমার হাতদুটো মুঠোয় নিলো অংশু।

Loading

Leave A Comment