পাগলী
– শম্পা সাহা
-এই শুনছো?
-উঁ”, মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে স্বাতীর ডাকে অন্যমনস্ক সাড়া রথীনের।
-শোনো না…
-কি হল? রথীনের গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ে।
-আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না।
-কেন, ঘুমের ওষুধটা খাওনি আজ?
-খেয়েছি তো!
-তাহলে? মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ না তুলেই স্বাতীর দিকে আলগা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় রথীন।
-তবু ঘুম আসছে না! স্বাতীর গলায় ক্লান্তি আর হতাশার মিশেল।
-এবার গিয়ে তাহলে ডাক্তারকে বলবে, ডোজটা একটু বাড়িয়ে দিতে। রোজ রোজ এভাবে না ঘুমিয়ে থাকলে সকালে অফিস যাবে কি করে? তাছাড়া এভাবে চললে তো শরীরও খারাপ করবে।
-আমায় তুমি আর ভালোবাসো না বলো? স্বাতীর গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে।
-কেন? হঠাৎ আবার এসব কথা কেন? রথীনের চোখ তখনো হোয়াটসঅ্যাপে।
-কখন থেকে ডাকছি, আর তুমি সেই থেকে মোবাইল খু্ঁচিয়েই যাচ্ছো!
-চোখ দিয়ে শুনবো না কান দিয়ে? আমি শুনছি। রথীন গম্ভীর।
-স্বাতীর বাচ্চাটা মিসক্যারেজ হয়ে যাবার পর থেকেই ও ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনে চলে যেতে থাকে। কারো সঙ্গে কথা বলতো না, ঘর থেকে বেরোতো না, এমনকি একটা সময় তো এমন হয়েছিল, অফিস যাওয়াও বন্ধ!
বহু ওষুধ, ডাক্তার, কাউন্সেলিং-এ এখন অনেকটা ভালো কিন্তু তার পরবর্তী উপসর্গ হিসেবে এই ইনসমনিয়া!
বেশিরভাগ দিনই সারারাত দু’ চোখের পাতা এক করতে পারে না। লম্বা লম্বা অসহ্য, বেসুরো গানের মতো রাতগুলো মনের সবকটা স্নায়ুকে একেবারে জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।
চোখের সামনে দেখে, কি ভাবে রথীন নাক ডেকে ঘুমোয়, কি ভাবে রাত জাগা ট্রাক ড্রাইভার জোরে হুঁস্ করে ট্রাক নিয়ে বেড়িয়ে যায়। বড় রাস্তার একেবারে পাশে ওদের ফ্ল্যাট, সব শব্দই যেন ওর রাতজাগাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ঘুমের ওষুধগুলোও যেন আজকাল ঠাট্টা করে। শুধু ধীরে ধীরে রক্তে স্নায়ু ক্লান্তির রাসায়নিকের মাত্রাই বাড়তে থাকে, ঘুম আর আসে না!
আজ কতদিন যে স্বাতী ঘুমোয়নি! মাঝে মাঝে রথীনকে ডাকে গল্প করতে, একটু কেউ কথা বললেও শান্তি! রথীন বিরক্ত হয়, স্বাভাবিক। ওরও তো সকালবেলা অফিস যাওয়া থাকে। ডাক্তার দেখাচ্ছে, ওষুধ খাচ্ছে, কাউন্সেলিং চলছে, আর কি করার থাকতে পারে রথীনের?
আজ কিন্তু মনটাও চরম অশান্ত, স্বাতীর ভিতরে ভিতরে একটা ভয়ংকর আনচান অবস্থা। খারাপ লাগা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ভীষণ ভাবে।ও হঠাৎই উঠে বসে খাটের উপর, তারপর খাট থেকে মেঝেতে পা দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
-কি হলো, উঠলে যে?” ঝট্ করে রথীনের দিকে ঘাড় ঘোরায় স্বাতী।
-তুমি তোমার মোবাইল নিয়ে থাকো! আবার ভালো থাকা মন্দ থাকার তোমার কাছে কোন মূল্য নেই যখন, তখন তোমাকে ভাবতে হবে না!
দ্রুতপায়ে ঘর ছেড়ে বেরোতে যায় স্বাতী। আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে! এ জীবন অসহ্য! কারো কাছে আর কোন মূল্য নেই ওর! সন্তান হারানোর কষ্ট যেন ওর একার, মন খারাপ তাও ওর! রাত জাগার কষ্ট তাও শুধু ওরই! তাহলে ওর আর এসব কিছুরই দরকার নেই!
ওর ভাব দেখে রথীন ভয় পেয়ে যায়। চট করে উঠে তাড়াতাড়ি স্বাতীর হাত চেপে ধরে। স্বাতীর আচার-আচরণ ওর কেমন একটা অস্বাভাবিক ঠেকে।
স্বাতী এক ঝটকায় রথীনের হাত ছাড়িয়ে ঘরের বাইরে যেতে চায়, কিন্তু ততক্ষণে ও বাঁধা পড়েছে রথীনের দুই বাহুর শক্ত বাঁধনে। রথীন আঁকড়ে ধরে স্বাতীর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে, কে বলেছে পাগলী, তোমার থাকা না থাকার আমার কাছে কোন মূল্য নেই? কে বলেছে তোমার মন খারাপে আমার মন খারাপ হয় না?কে বলেছে তোমার কষ্টগুলো আমার কষ্ট নয়? তুমি একটা পাগলী, আস্ত পাগলী!
শক্ত করে ওকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রথীন। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে স্বাতী। রথীন চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় ওর পাগলীকে।