জরায়ু
– শম্পা সাহা
একটা ঠিকানা বিহীন ট্রেনে উঠে বসলাম। না, না, ট্রেনটার ঠিকানা ছিল আমার ছিল না।
কদিন থেকেই মনটা বেশ খারাপ। জয়ী কেন যেন আমাকে অ্যাভয়েড করছিল। কারণটা বারবার জিজ্ঞাসা করেও উত্তর পাইনি!
গত সাত বছর আমার আর জয়ীর সম্পর্ক। শুধু সম্পর্ক বললে ভুল হবে, প্রেম..গভীর প্রেম। আমাদের সম্পর্কটা একটা নেশার মত যেন। ঝড় জল বজ্রপাত তুষার ধ্বস কোনো কিছুই যেন আমাদের বাধা নয়।
আমরা রোজ দেখা করতাম, কোনোদিন বেলেঘাটা লেক, ফুলবাগান মোড়, কোনোদিন ভিক্টোরিয়া। প্রথম প্রথম অচেনা জায়গায় তারপর সবার চোখ সওয়া হয়ে গেলে আমার মেসে ও আসতো। আবার কখনো আমি ওর হোস্টেলে।
আমাদের কথা যেন ফুরোতো না। পাড়ার নেড়ীটার সাইকেল চাপা পড়া থেকে বারাক ওবামার রাজনৈতিক পন্থা সব কিছুরই অবাধ যাতায়াত ছিল আমাদের প্রেমালাপে।
কি জানি? ঠিকঠাক প্রেমটা পারতাম কিনা আমরা? আমরা সংসারের কথাও ভাবতাম না, বিয়ের কথাও না। আমরা সমাজ বদলাবার কথা বলতাম, বিপ্লবের কথা ভাবতাম, নারী স্বাধীনতা, দেশের রাজনীতি এ সব নিয়ে ঝগড়া, তর্ক অবলীলায় এসে পড়তো আমাদের কথায়।
আমরা অবশ্য প্রেমও করেছি, যে রকম লোকে করে! ওর ঠোঁট আমার ঠোঁট ছুঁয়েছে বহুবার, আমি পথ হারিয়েছি ওর ভেতরে লক্ষ বার।
লোকে বলে শারীরিক সম্পর্ক হলে নাকি প্রেম শেষ হয়ে যায়। সব ভুল। আমার তো মনে হতো, জয়ী শুধু আমার। জয়ীকে এত গভীর ভাবে আর কে জানে? কে পেরেছে ওর এতো গভীরে প্রবেশ করতে, আমার মত?
আরো স্নেহে, আরো মায়ায়, ওর কপালে চুমু খেতাম, ওর কপালের চুল সরিয়ে দিতাম আলগোছে। ও ভয় পাওয়া তিতিরের মত আমার বুকের মধ্যে ঢুকে যেত যেন।
কিন্তু ওই দিনগুলোতে ও খুব কষ্ট পেতো। আসতো, দেখা করতে আসতো রোজই, কিন্তু বুঝতাম ওর কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝে পেট চেপে বসতো, হঠাৎ কেউ যেন পেটের মধ্যে খিঁমচে ধরছে এমন ভাবে আঁতকে উঠতো, যন্ত্রণায় নীল ওর ঠোঁট দুটো।
আমি জোর করে ওকে হস্টেলে পৌঁছে দিতাম, ঘন্টায় ঘন্টায় ফোনে জানতে চাইতাম কেমন আছে? ও ফোন না ধরলে অপেক্ষা করতাম ওর ফিরতি ফোনের।
দিব্যি তো চলছিল সব। কিন্তু ওর পেটের ব্যথা ওই দিন গুলোয় ধীরে ধীরে অসহ্য হতে লাগলো। হস্টেলে নাকি একদিন অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসা চলছিল, শহরের নামকরা গায়নোর কাছে।
কলেজ শেষে আমার কেউই গ্রামে ফিরে যাইনি। ওর নদীয়া আর আমার বাড়ি মেদিনীপুর। কিন্তু এই শহরটাকেই আমরা আমাদের স্থায়ী ঠিকানা করে ফেললাম।
চাকরি, পড়াশোনা আর প্রেম সবই চলছিল খুব সুন্দর ভাবে। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরেই দেখছি জয়ী কেমন অন্যমনস্ক। মনমরা হয়ে থাকতো, কথা বললে উত্তর দিতো না, আমার কাছে এসেও যেন আমার কাছে থাকতো না।
অনেক জিজ্ঞাসা করেছি, এড়িয়ে গেছে, অথবা হ্যাঁ, হুঁ ব্যস্। আমার কষ্ট হতো, ছটফট করতাম, বুঝতে পারতাম ও কোনো কিছুতে কষ্ট পাচ্ছে খুব কিন্তু বলছে না। কেন বলবে না? এ আমার রাগ! এতোদিনে কি আমি ওর আপন হতে পারিনি, যাতে ও ওর সমস্যাগুলো আমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে!
গত সাতদিন ধরে হঠাৎ জয়ী উধাও। ওর ফোন বন্ধ, হোস্টেলে গিয়েও ওর কোনো খবর পেলাম না। ওর বন্ধু বলতে বিধি, ও তখন অফিসে। আমি অফিস ছুটি নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, কিন্তু বিধি আমার সঙ্গে দেখা করলো না! এমনকি ওর নম্বরে ফোন করে দেখলাম বারবার বিজি আসছে, বুঝলাম আমাকে ব্লক করেছে।
শিয়ালদহ থেকে নর্থের একটা ট্রেনে উঠে বসলাম। বোধহয় লালগোলা প্যাসেঞ্জার। লালগোলা পর্যন্তই রিটার্ন টিকিট কেটে উঠে বসলাম। আমার ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছি। বাবা, মা, দাদা, বন্ধু কারো সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রাগ দুঃখ মনখারাপ ঘৃণা সব মিলিয়ে কেমন একটা অনুভূতি, সে যে কেমন একটা অসাড় করা অনুভূতি! এর যে কি নাম, আমি জানি না। মাথাটা একেবারে ফাঁকা! ব্ল্যাঙ্ক!
ট্রেন চললো, ফাঁকায় ফাঁকায় উঠেছিলাম বলে জানালার ধারে সিট পেয়েছিলাম। জানালার পাশে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার মত মানসিক অবস্থা আমার ছিল না। চোখ বুজে ঝিম মেরে বসে রইলাম। মাথার মধ্যে জয়ী ভাসতে লাগলো, মনের মধ্যে পাক খেতে লাগলো জয়ীর মুখখানা, ওর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখটা, পিরিয়ডের দিনগুলোর মলিন মুখ।
কি হলো? কেন হলো? আমি কি এমন করলাম যে কোন কিছু না বলে জয়ী আমাকে একা করে হারিয়ে গেল? কি দোষ আমার? কেন, কেন?
আমার অজান্তেই কখন যেন গাল বেয়ে জল পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার গাল, শার্টের কলার। এভাবে কতক্ষণ যে বসে ছিলাম, জানি না! কিন্তু ট্রেন যখন আবার ফিরে এলো শেয়ালদহ স্টেশনে, বাধ্য হলাম ট্রেন থেকে নামতে। ভীষণ অবসন্ন লাগছে! ধীরে ধীরে পা বাড়ালাম মেসের দিকে।
মেসে ঢুকতেই শুভ হৈ হৈ করে উঠলো, “কি ব্যাপার, সকাল থেকেই উধাও! কোথায় ছিলি?”
“এই একটু”, প্রচন্ড ক্লান্তি সারাদিন না খাওয়া আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
-“বিধি এসেছিল”
-“কি? কেন?” আমি যেন আবার শক্তি ফিরে পেলাম।
-“কিছু বলেনি, তোর ফোন অফ দেখে, এই কাগজটা দিয়ে গেছে..”
আমি লাফ দিয়ে ওর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে খুললাম! একটা চিঠি, জয়ীর চিঠি। বুঝলাম আমার ভেতরটা কাঁপছে, হার্ট বিট প্রায় একশো, আমার হাত কাঁপতে লাগলো থরথর করে, অজানা আশঙ্কাগুলো হুড়মুড় করে নামতে লাগলো যেন।
লক্ষ্মীটি,
রাগ কোরো না, ভুল বুঝো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি। তাই আমার অসম্পূর্ণ জীবন নিয়ে তোমার জীবনকেও অসম্পূর্ণ, দুর্বিষহ করে দিতে পারবো না।
আমার পেটের ব্যথাটা আসলে ইউট্রাস ক্যান্সার। ফার্স্ট স্টেজ, তাই জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়েছে।
এ কদিন হাসপাতালে ছিলাম, তাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো নি। আজ রিলিজ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।
ডাক্তার বলেছেন, আমি কোনোদিন মা হতে পারবো না। কিন্তু তোমার বাবা হবার অধিকার আমি কেড়ে নিতে পারবো না।
ভালো থেকো, সুখে থেকো, আর আমাকে ভুলে যেও।
জয়ী
আমার মাথা রাগে দপদপ করতে লাগল। দুঃখ নয়, প্রচন্ড রাগ! মেয়েটা কি মুর্খ? আমাদের মধ্যে ওসব বাবা হওয়া, মা হওয়া কবে এলো? আমি এসব কবে বললাম? জয়ী কেন টিপিক্যাল মেয়ে হয়ে গেলো? ও না বিপ্লবের কথা বলতো। ওর মনে কোথায় ছিল এই অত্যন্ত সাধারণ এক মেয়ের ইচ্ছে?
না, ওকে আমায় খুঁজে বার করতেই হবে, ওকে বোঝাতেই হবে, সন্তান হওয়া না হওয়ার সঙ্গে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই! ও আর সবার মত নয় ও আলাদা, সবার থেকে আলাদা!
আমরা একে অপরের জন্য বাঁচবো, বাকি দশজনের জন্য বাঁচবো। ওকে বোঝাতেই হবে, সন্তান না হলেই একটা মেয়ে শেষ হয়ে যায় না। সন্তান না হলেও একজন প্রিয় মানুষের মূল্য কখনোই কমে যায় না!
আমি সঙ্গে সঙ্গেই ছুটলাম জয়ীর হস্টেলের দিকে, দেখি বিধির থেকে ওর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা পাওয়া যায় কিনা! আমাকে যে জয়ীকে খুঁজে বার করতেই হবে, আমার যে শুধু ওকেই চাই, আমার যে শুধু ওকেই দরকার, আজীবন, সারা জীবনের জন্য।