Site icon আলাপী মন

অণু গল্প- ক্ষত

ক্ষত

-অমল দাস

 

 

বিকালের আলো রক্তিম আভা নিয়ে আত্মিকার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে আছে। যেন বিদায় কালের অনুমতি চাইছে। বসন্তের পাতা ঝরা-রা এলোমেলো ঝরে আছে আশেপাশে। কোকিলের যে কুহু শুনে একসময় মন হারিয়ে যেত; সে সুর আর আত্মিকার কানে ভাসে না। না-কি সেও কোনও বিরহে আর ডাকেনা! জানেনা। জানার আগ্রহ আর নেই নিস্তেজ শরীরে। অশোক গাছের নীচে এই বেদীটায় সে একাই বসে থাকে মন হারা হয়ে। ওর সাথে আজ আর কেউ নেই। কেউ আসেও না…                         কতগুলো উৎসুক মুখ প্রয়াশই আশেপাশে পেঁচার মত উড়তে থাকে রোজ -শিকারের আশায়। ডানা ঝাপটায় কিন্তু কাজ হয়না। আত্মিকার আত্মাকে তারা ধরতে পারেনা। যে প্রেম প্রস্তাবে ওরা বিদ্ধ করতে চায়, তা অনেক আগেই বুকে গেঁথে নিয়েছিল আত্মিকা। হর্ষের প্রস্তাবে। তারপর কত আনন্দ, কত সুখের দিন। এই আকাশ, বাতাস, ময়দানের সবুজ ঘাস নীরব সাক্ষী। সাক্ষী বিকেলের হাঁটতে আসা বয়স্কদের ভিড়। ওদের দিকে চেয়ে তাঁদের মৃদু-মৃদু হাসি ঠোঁট বেয়ে নেমে আসতো আশীর্বাদ নিয়ে। আজ আর আসে না। ওঁরা আসেন। সেই ঠোঁটে চেনা হাসি আসে না।

কোনো এক অভিশপ্ত দিনে সব হাসি মিশে গেছে মেঠো ধূলোয়। এই অশোক গাছটার নীচে এখানেই এক অন্ধকার বিকালে হঠাৎ কালো ঘন মেঘের বজ্রপাত ছিনিয়ে নিয়ে যায় হর্ষকে। মুষলধারার  বৃষ্টি একাকী আত্মিকাকে সেদিন নির্মম ভাবে ভিজিয়েছিল আপাদমস্তক। অন্তরে বাহিরে আঘাতের শূল পুঁতেছিল উচ্ছৃঙ্খল হাওয়াদের চাবুকের ঘা। ফেরারি পথে বৃষ্টি ধুয়ে নিয়ে যায় সমস্ত অপরাধী দাগ।

পড়ে থকে নিথর হর্ষ আত্মিকার কোলে।

আজ কতগুলো দিন চলে গেছে। কত স্রোত বয়ে গেছে গঙ্গার জলে। আত্মিকার বিবর্ণ জীবনে রঙ লাগেনি আর বসন্ত-পলাশের। শুধু অন্ধকারে আসা আর যাওয়া স্মৃতির মেরু প্রদেশে।

যে বাদামওয়ালা রোজ ওদের কাছে এসে আবদার করতো ‘ও দিদি বাদাম নেবে? নাও-না।’

আত্মিকা একটা-ই চাইলে সে বলতো ‘তোমরা দুজনে একটা কি খাবে গো দিদি দুটোই নাও।’

আত্মিকা বলতো ‘দুটো নয় একটাই। কারণ আমরা দুজন নই আমরা এক’।  

সেই বাদামওয়ালা আজ আর বাদাম নিয়ে হাঁকে না। মাথা নিচু করে হেঁটে যায় আত্মিকার পাশ দিয়ে। সেও জানে সে দিনের সেই ‘এক’ আজ ক্ষত। পশ্চিমে ঢুলে পড়া আলো এই ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে যায় শেষ বিকালে। আত্মিকার আঁচল ভরে ফেলে যায় এক পৃথিবী ধূসর গোধূলি।

Exit mobile version