বি পজিটিভ..
-রীণা চ্যাটার্জী
হঠাৎ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সব কাজ ফেলে রেখে মালতী ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল।
সমীরের সাথে কথা কাটাকাটির মধ্যেই ব্যাপারটা আড়চোখে দেখলো রুমা। কিন্তু তখন সমীরের সাথে তর্কে সমাধান খোঁজার মরীয়া চেষ্টায় মালতীর চলে যাওয়ায় অত গুরুত্ব দেয় নি। ভেবেছে- কোনো কাজে গেছে, চলে আসবে। এমন তো করেই মাঝে মাঝে। তবে অন্যদিন বলে যায়- আজ না বলেই..
সকাল থেকেই বিগড়ে আছে মেজাজটা সমীরের বে-আক্কেল কান্ডকারখানায়। তার ওপর যখন খেয়াল হলো মালতী সব কাজ অগোছালো করে রেখেই চলে গেছে ঘন্টা খানেক পেরিয়ে গেছে, মেজাজটা আরো বিগড়ে গেল। এদিকে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অনলাইন ক্লাস শুরু হয়ে যাবে- স্টুডেন্টরা অপেক্ষা করবে। রুমার যেন সসেমিরা অবস্থা!
ধপ করে সোফায় বসে পড়লো একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে। কিছুক্ষণ বসেই থাকলো চোখ বন্ধ করে। তারপর চোখ খুলে চর্তুদিকে চোখ বুলিয়ে ঠিক করলো এইভাবে তো ক্লাস নেওয়া সম্ভব নয়।
প্রথমেই মোবাইল হাতে নিয়ে গ্ৰুপে মেসেজ করে জানিয়ে দিলো নেটওয়ার্ক ইস্যু- ক্লাস নিতে পারবে না। অন্য কোনো দিন করিয়ে দেবে, পরে জানিয়ে দেবে সময়।
এর পর উঠে প্রথমে রান্নাঘরে গেল। সব ছড়ানো.. সব্জি, মাছ। ভাতের ডেকচিতে চাল বার করে রাখা। সব্জির খোসার ওপর বটি উল্টিয়ে রাখা। মাছে নুন হলুদ মাখানো। লাউ অর্ধেক কুচিয়ে জলে ভিজিয়ে রাখা একটা গামলায়। নারকেল, বড়ি সব আয়োজন সম্পূর্ণ.. ঠিক যেন কেউ রান্না করতে করতে কোথাও গেছে। মাথাটা আবার গরম হলো মালতীর ওপর। না বলে কয়ে দুম করে.. কোনো মানে হয়! এরমধ্যে সমীর এসে খেতে চাইলো। ওর আর কি আছে শুধু সময়মতো সব কিছু হলেই হলো। তার মধ্যে বে-আক্কেলে কাজকর্মের শেষ নেই। মনে পড়লো সকালের কথা, ‘রুমা বুঝলে মা-বাবাকে ঝুমুরকে নিয়ে আসতে বলে দিয়েছি এখানে।’
-মানে? ওনারা এখন এই পরিস্থিতির মধ্যে কি করে আসবেন? মালতী বাড়িতে থাকার জন্য কথাটা শুনেই মাথা গরম হয়ে গেলেও খুব চাপা গলাতেই কথা বলছিল রুমা। সমীর যথারীতি আস্তেই কথা বলছিলো, কারণ জোরে কথা বললে হিতে বিপরীত হতে পারে।
-ও ঠিক হয়ে যাবে, গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবো। সোজা চলে আসবে। এখন সবাই একসাথে থাকলে চিন্তা কম, বুঝলে।
-তুমি একবার আমার সাথে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করলে না!
-বাড়ির মানুষ বাড়িতে আসবে তাতে আলোচনা করার কি আছে?এমন অদ্ভুত কথা বলো না..
-আচ্ছা আমি অদ্ভূত কথা বলি? আর তুমি যে কাজগুলো করো সেগুলো। তুমি জানো আমার স্কুল অনলাইন চলছে। একস্ট্রা লোক দেখলেই মালতী ডুব দেবে, মাসি আসবে না রোজ.. কি করে সম্ভব বলতে পারো? বাড়িতে বেশী লোক থাকলে কতো অসুবিধা বুঝতে পারো? হাটের মাঝে অনলাইন ক্লাস করানো যায়? কিছু ভাবলে না, দুম করে.. অন্তত মানুষ একবার তো বলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে.. আশ্চর্য!
-আর বাবা ফোনে কথা বলছিলাম, ঝুমুর বললো কতোদিন বাড়িতে বন্দী। কোথাও যাওয়া হয় না। মন খারাপ মনে হলো, তাই মা’কে বললাম চলে এসো সবাই মিলে, ব্যস।ব্যস.. আর কিছু না! আমার কিছু বলার থাকতে পারে না, তাই তো? তাহলে তুমি ছুটি নাও, সংসার সামলাও। এরপর আর সমীর আস্তে গলায় কথা বলতে পারে নি। হাত পা নেড়ে বলে উঠেছিল,
-বি পজিটিভ রুমা, বি পজিটিভ..পজিটিভ!
-আমাকে বলছো পজিটিভ? আর কোনো কথা বলার আগেই দেখলো মালতী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওদের তর্ক আরো কিছুক্ষণ চলার পর অমীমাংসিত ভাবেই শেষ হলো ঘড়ির কাঁটা দিকে চোখ পড়তে। রুমার খেয়াল হলো রান্নাঘরে কোনো আওয়াজ নেই। রান্নাঘর আর মালতী, সমীরের অফিস- নিজের স্কুল বোঁ বোঁ ঘুরতে লাগলো মাথায়।
সমীর অফিস যাবে- ফ্রিজ খুলে ডাল, দৈ বার করে রাখলো রুমা। ভাত বসালো, কড়াইতে তেল দিয়ে মাছ ভাজলো। আধ ঘন্টা পর সমীরকে টেবিলে খাবার দিয়ে ডাকলো। টেবিলে বসে সমীর বললো,
-অনেক দেরী করে দিলে আজ.. শুধু এই? লাউঘন্ট দিলে না? লাউঘন্ট.. এবার আমার ঘন্ট খেও, করে দেবো। মালতী চলে গেছে কোনো কাজ না করেই। তুমি তো অফিসে চললে। আমার ক্লাস অফ করতে হলো। যত ঝামেলা তো আমার। যা পেয়েছো.. চুপচাপ খেয়ে অফিসে যাও।
-মালতী চলে গেছে! কেন?
-সেটা জানলে তো হয়েই যেত। বলে রান্নাঘরে চলে গেল কাজ সারতে। কিছুক্ষণ পরে ঠিকে মাসি আসবে বাসন মাজতে, ঘর মুছতে। তার আগে রান্নাগুলো সেরে ফেলতে হবে।
কিন্তু প্রায় দুপুর হতে চললো ঠিকে মাসি এলো না।
বাধ্য হয়েই বাকি কাজ সব সারতে হলো। দুপুরে খেয়ে একটু শোবার পর ভাবলো, বিকেলে একবার কণিকাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করবো। ঠিকে মাসি তো ওর বাড়িতেও কাজ করে। আর মালতীর ছেলেকে ফোন করবে- তাকে আবার রাতে ছাড়া পাওয়া যায় না। এইসব সাত- পাঁচ ভাবতে ভাবতে ক্লান্তিতে, চিন্তায় চোখ লেগে গেল।
বিকেলে কণিকাকে ফোন করে জানতে পারলো, মাসি কাজ করে গেছে ওদের বাড়ি। একটু অবাক হলো। তাও কণিকাকে বললো- ‘কাল তোমার বাড়িতে এলে আমাকে একটু ফোন করবে?’
কণিকা সম্মতি জানিয়ে ফোন রেখে দিলো।
রাত্রিবেলা মালতীর ছেলেকে ফোন করলেও কেউ ফোন তুললো না। এমনটা তো হয় না। কি হলো মালতীর! শরীর খারাপ নয় তো? কাল যদি না আসে তো খুব অসুবিধা হবে। রোজ তো আর ক্লাস অফ করা যাবে না। এই ভেবে তখন আবার রান্নাঘরে ঢুকলো- কিছুটা সকালে রান্না করেছিলো। ভেবেছিলো রাতে হয়ে যাবে। তবুও আর ঝুঁকি না নিয়ে আরো দু’ তিন রকম করে রাখলো- ডাল, ডিম, মাছের ঝোল যেটুকু হাতের কাছে পেলো।
রাতে খেয়ে বাসনও মেজে রাখলো। সমীর নির্বিকার, নিজের মতো টিভি, ফোনে ব্যস্ত। রাগ ধরলেও রুমা আর কথা বাড়ালো না। শুয়ে পড়লো। ভোরবেলায় কলিং বেল বাজলো না- মালতী এলো না।
কাজের চাপ নেই আজ। সমীর অফিস চলে যাবার পর নিজের দৈনন্দিন কাজ সেরে ক্লাস নিতে বসে গেল। কালকে অফ করেছিলো ক্লাস, কিছু কিছু করে নিয়ে নিতে হবে। আজ দু’টো ক্লাস বেশী নেবে গ্ৰুপে জানিয়ে দিলো। দিন গড়িয়ে বিকেল হলো। নাহ্, ঠিকে মাসি আজো এলো না। কণিকাকে ফোন করলো, ‘হ্যালো, আমি রুমা বলছি। মাসি এসেছে গো? একটু কথা বলা যাবে?’ কণিকা একটু সময় চুপ করে থেকে বললো, ‘তোমার শরীর কেমন আছে? দাদা অফিস যাচ্ছে?’
-‘ভালো আছি গো। কিন্তু মাসি এসেছে কি?’
-‘এসেছে.. কাজ করছে। আচ্ছা রাখি এখন। কাজ আছে একটু।’
‘আশ্চর্য মাসির কথা না বলেই ফোন কেটে দিলো। থাক দরকার নেই। অন্য লোক দেখে নেবো। সিকিউরিটিকে বলে রাখতে হবে- অন্য লোকের কথা।’ নিজের মনেই কথাগুলো বলে নিচে নামলো রুমা। দেখে কয়েকটা কাজের লোক দাঁড়িয়ে জটলা করছে। কাজের কথা বলার জন্য এগিয়ে যেতেই সবাই কেমন দূরে সরে গেল- কেউ কেউ চলেও গেল। রুমা একটু অবাক হলেও বললো, ‘তোমরা রান্নার কাজ কে করো? বা ঠিকে কাজ? সময় হবে আমার ঘরে কাজ করার?’
সবাই চুপ করে থাকলো, শুধু একজন বলে উঠলো, ‘মালতী দিদি কয়েছে আপনে পজেটিভ.. আপনের ঘরে একন কেউ কাজ করবে নে কো..’
-মানে? পজেটিভ.. কি? কি সব বলছো তোমরা? কে বলেছে এইসব?
-মালতী দিদির, আমার পাশাপাশি ঘর। মালতী দিদি কাল বাড়ি যেয়ে বইল্যো- দাদাবাবু আপনেকে কাল সক্কালে কয়েছেন আপনে পজেটিভ। আমাদের নোকাল ন্যাতারা বল্যেছে কেউ কুনো পজেটিভ ঘরে কাজ করবে নি। তাই আপনের ঘরে একন কেউ কাজ করবে নি।
আকাশ থেকে পড়লো রুমা। কিছুই বুঝতে পারলো না প্রথমে। ঘরে চলে এলো। বসে বসে মালতীর চলে যাওয়া, সমীরের সাথে ওর তর্কের কথা আর নিচে মেয়েটির বলা কথাগুলো মনে করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর মনে পড়লো-‘বি পজিটিভ রুমা, বি পজিটিভ..’ জলের মতো সব পরিস্কার হয়ে গেল রুমার কাছে। কাল থেকে আজ পর্যন্ত সব ভোগান্তির মূলে যে- সে নিশ্চিন্তে খাওয়া, অফিস, ঘুম সব চালিয়ে গেল। আর রুমা!
নাহ্, আর এই লোকটার বেআক্কেলে কাজ- কথা কিছুই সহ্য করা যাচ্ছে না। একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।
সমীর অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষা শুধু। মনে মনে নিজেকে শুধু বলতে লাগলো, ‘বি পজিটিভ রুমা, বি পজিটিভ..’
দরজার বেল বাজিয়ে যাচ্ছে সমীর, রুমা চুপ করে ভেতরে বসে। অন্তত বার দশেক বেল দেবার পর ধীরে সুস্থে দরজা খুললো। সমীর ভেতরে ঢুকে অধৈর্য্য হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কি ব্যাপার? এতোক্ষণ বেল বাজাচ্ছি! কি করছিলে?’
-‘কিছু না তো, দেরী তো হতেই পারে.. কখনো.. কখনো.. বি পজিটিভ.. বি পজিটিভ..’ আস্তে আস্তে, যেন চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বললো রুমা।
সমীর একটু বিরক্ত হলেও সোজা বাথরুমে চলে গেল। স্যানিটাইজ এখন প্রথম কাজ। ফ্রেশ হয়ে বসলো, রোজের মতো টিভি চালিয়ে চায়ের অপেক্ষায়। রুমা চা আনলো। কিন্তু সমীরের হাতে দেবার আগেই চা সমীরের গায়ে পড়লো।
-‘উফফফ কি যে করো! দেখে দেবে তো?’
-‘যাও ধুয়ে নাও, ঠিক হয়ে যাবে.. বি পজিটিভ’
সমীর কথা না বাড়িয়ে আবার বাথরুমে গেল। জ্বলে যাচ্ছে গরম চায়ের জ্বালায়। রুমার খুব স্বাভাবিক ভাবে বসে টিভি দেখতে থাকলো। সমীর বেরিয়ে এসে আড়চোখে রুমাকে দেখে বললো,
-‘জ্বলে যাচ্ছে..উফফ’
-‘গরম পড়লে তো জ্বলবেই। বি পজিটিভ..বি পজিটিভ।’ মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে সমীর চেঁচিয়ে বললো,
-‘কি তখন থেকে বি পজিটিভ.. বি পজিটিভ করছো বলো তো!’ রুমা আর কোনো কথা বলে নি। শুধু আওয়াজ ভেসে এলো জিনিসপত্র পড়ে যাওয়ার.. না কি ফেলে দেওয়ার!
কি হয়েছিল, কি করেছিল সে সব অন্তরের কথা, অন্দরের কথা। তবে সমীর গাড়ি বুকিং ক্যানসেল করে মা’কে ফোন করেছিল, ‘পরিস্থিতি এখন কোথাও আসা-যাওয়ার মতো নয়,বুঝলে মা। ঝুমুরকে বলো সব ঠিকঠাক হলে তখন ভাবা যাবে। বুঝতে তো হবে পরিস্থিতিটা..বেআক্কেলে হলে চলবে কেন..’
আর হ্যাঁ, সমীর রাতেও একবার বেরিয়েছিল.. পরদিন সকালে মালতী, আর দুপুরে ঠিকে মাসি কাজে এসেছিলো ওদের বাড়ি।
পজিটিভ.. সব পজিটিভ… বি পজিটিভ।
বাহ সংসার নামক ব্যস্ততার পিচে কলম ভাবনার ঘুর্ণীবল দারুন খেলালেন দিদি।
অনুপ্রাণিত ভাই