Site icon আলাপী মন

গল্প- পুনর্মিলন

পুনর্মিলন
– জয়তী মিত্র

 

 

আজ রঞ্জন আর তানিয়ার ডিভোর্স হবে। সকাল সকাল দুজনেই হাজির আদালত কক্ষে। তানিয়ার সাথে তার মা আর ছেলেও আছে। ছয় বছরে সম্পর্কটা এতটাই তিক্ত হয়েছে যে কেউ কারোর মুখ পর্যন্ত দেখছে না। এতদিন ছেলের মুখ চেয়ে সব সহ্য করেছে তানিয়া, আর নয়।

অথচ ভালোবেসে দুজনে বিয়ে করেছিল। বিয়ের পর মোটামুটি ভালোই চলছিল দুজনের জীবন যাত্রা। তারপর শুরু হয় দুজনের মনোমালিন্য। তানিয়া চেয়েছিল ছোট্ট একটা বুটিক খুলবে, সেটা রঞ্জনের পছন্দ নয়। বুটিকে মন দিলে সংসার,সন্তানের দিকে ঠিক মত নজর দেওয়া যাবে না।
সেই নিয়েই শুরু দুজনের ঝগড়া। এমনিতেই তানিয়া খুব অগোছালো, জিনিসপত্র ঠিক ভাবে গুছিয়ে রাখে না। তাতে রঞ্জন কটূক্তি করে বলতো, একটা সংসার ঠিক মত গুছিয়ে রাখতে পারে না সে করবে ব্যবসা। মাথায় আগুন জ্বলে যেত তানিয়ার। শুরু হয়ে যেত ঝামেলা।
আগের সেই প্রেমিক রঞ্জন আর স্বামী রঞ্জনের মধ্যে অনেক তফাৎ। প্রেম করার সময় কত মিষ্টি কথা, আর এখন মিষ্টি কথাগুলোই ভীষণ কর্কশ লাগে শুনতে।
চাকরী সূত্রে রঞ্জনের সাথে প্রবাসে থাকত তানিয়া। সেখানে মাঝে মাঝেই গিয়ে থাকত তাদের বাবা-মায়েরা। শাশুড়ি মায়ের সাথে একদম বনিবনা ছিল না তানিয়ার। উনি আসার কথা শুনলেই তানিয়ার মেজাজ উঠত সপ্তমে। আসলে তানিয়ার শাশুড়ি মা-র খুব পরিষ্কার বাতিক আছে। উনি এসে তানিয়ার কাজের খুঁত ধরতেন। শুরু হতো দুজনের মনোমালিন্য। আবার তানিয়ার মা-ও মেয়ের সংসারে খুব নাক গলাত। তাই নিয়ে রঞ্জনের সাথে ঝামেলা লাগত তানিয়ার। তারপর আরো নানা রকম খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে দুজনের গন্ডগোল লাগত। তানিয়া বলতো, তোমাকে বিয়ে করে আমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আমার বান্ধবীরা কত স্বাধীন ভাবে রয়েছে, আজ এর বাড়ি পার্টি,‌ কাল ওর বাড়ি। কত আনন্দ করে ওরা। আর আমি কোথাও যাবো বললেই তোমার মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়।
ওদিক থেকে রঞ্জন বলে, গেলেই পারো কে বারণ করেছে?
সত্যি প্রেম করা এক জিনিস আর এক ছাদের নিচে সংসার করা খুব কঠিন বিষয়।
স্বামী-স্ত্রীর এইসব ঝগড়ার মাঝে পড়ে তাদের একমাত্র সন্তান অর্ণ-র খুব খারাপ অবস্থা। ওইটুকু ছেলে পাঁচ বছর বয়স। দুজনকে বলে, তোমরা কেন চিৎকার করছো, আমার ভয় লাগছে.. বলে কান্না শুরু করে দিত।
ছেলের মুখ চেয়ে দুজনেই চুপ করে যেত। ছেলে তাদের প্রাণ ছিল। একদিন ঝগড়া হতে হতে গায়ে হাত তুলেছিল রঞ্জন। আর আর এক মিনিটও দেরি করেনি তানিয়া। পরদিন ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি পৌঁছে গেছিল। শ্বশুর বাড়ির লোক তানিয়াকে দোষ দিয়েছিল, আর বাপের বাড়ির লোক জামাইকে দোষারোপ করেছিল। দুই বাড়ির মধ্যেই সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

যথা সময়ে বিচার হয়ে রায় বের হলো। বিচারক বললেন- ‘ছেলে তার মায়ের কাছে থাকবে, আঠেরো বছর বয়স হলে তারপর ছেলে ঠিক করবে সে কার কাছে থাকবে?’

রায় শুনে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল রঞ্জন। ছেলেকে ছেড়ে কিছুতেই সে থাকতে পারবে না। ওদিকে ছেলেও কান্না জুড়েছে বাবা-মা দুজনের কাছেই সে থাকবে। বিচারক তখন দুজনকেই বললেন, সম্পর্ক নষ্ট হতে এক মিনিটও লাগে না, কিন্তু সেটা টিকিয়ে রাখাটাই কঠিন। আমার মনে হয় আপনাদের সন্তানের জন্য সব ভুলে আবার একসাথে সংসার করা উচিত। বিচারকের কথা শুনে তানিয়ারও চোখে জল। সত্যি তো তাদের মধ্যে যত ঝগড়া থাক, তাদের ছেলের তো কোনো দোষ নেই। তাদের দুজনের তো ছেলের জীবন নষ্ট করার অধিকার নেই।। রঞ্জন তানিয়াকে বললো,‌ ছেলের জন্যই না হয় আবার একসাথে মিলে মিশে থাকব, আর কখনো ঝগড়া করব না।
তানিয়ার চোখেও জল, রঞ্জনের কাছে গিয়ে বললো, চলো বাড়ি যাই, নিজের ঘরে, তোমাকে ছাড়া আমি যে আর থাকতে পারছি না। ছেলের হাত ধরে তখন দুজনেই বাড়ির পথে রওনা হলো। বিচারকের মুখে হাসি, যাক একটা পরিবারকে তো বাঁচানো গেলো। একটা ভেঙে যাওয়া সংসার আবার জোড়া দিতে পেরে বিচারকও ভীষণ খুশি হলেন।

Exit mobile version