রম্য রচনা- একান্ত গোপনীয়

একান্ত গোপনীয়
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

 

ঢেঁকি নাকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে।
লাথি না খেলে ঢেঁকি কর্ম করে না। এটাই চিরাচরিত অপরিহার্য পদ্ধতি। অর্থাৎ স্বর্গে লাথালাথি করার নির্দয় বিধির প্রচলন আছে।
না ভাই আমি নেই। মানে আমি স্বর্গে যেতে চাই না। লাথি খাওয়া আমার ধাতে সইবে না। কেন না, আমি নিশ্চিত জানি, আমি ঢেঁকি।
মেজাজি সংসারের ম্যাও সামলাতে সামলাতে, এখন একটা পুরোদস্তুর জবরদস্ত জগদ্দল ঢেঁকি হয়ে গেছি। চাল কুটতে হলো বেলা।
বেলা হোক কিংবা বেলা শেষ হোক। আমি নেই। স্বর্গ মাথার ওপর ছিল, আছে, থাকুক।
তাহলে নরক?
নরকভোগ ? প্রশ্ন-ই নেই । ওখানকার ব্যাপারস্যাপার নাকি অতি ভয়ংকর। বেধরক আড়ংধোলাই থেকে গরম তেলের কড়াইয়ে ছ্যাঁ কলকল ভাজা, কিছুই নাকি বাদ নেই। পাগলও নিজের ভালো বোঝে, আর আমি তো হাড় সেয়ানা।
জেনেশুনে ননসেন্স হওয়ার প্রশ্ন-ই নেই।
ভেবেই পাচ্ছি না, মরতে এই মর্তে জন্মের প্রয়োজন কী ছিল?
খাওয়া, ঘুম, যেন-তেন প্রকারেণ উপার্জনের ফন্দিফিকির, আর বংশ বৃদ্ধি। এই তো আজীবনের কর্মসূচী। হ্যাঁ, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস বলতে, নির্বিচারে অন্যকে বিনামূল্যে বংশদণ্ড প্রদান।
আচ্ছা..স্বর্গ, নরক, মর্ত্য, সব জায়গাই যদি গোলমেলে গোত্রের হয়, তাহলে থাকি কোথায়, যাই কোথায়? বাঁচি কোথায়, মরি কোথায়?
এ-তো ভারি মুশকিলের ব্যাপার হলো দেখছি।
সেই কারণেই মনের কোণায় শাঁকচুন্নির নাকে সুরের আগুন প্রশ্ন, জন্মালুম কেন?
পাঁচুদা সবজান্তা সব্জিওয়ালা। বললো- দ্যাখ ভেলো, মেলা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করিসনি। কেউ নিজের ইচ্ছেয় জন্মায় না। সব্বাই অন্যের ইচ্ছের ফসল। সেই ফসল ভালবাসার হতে পারে। স্লিপ ক’রেও হতে পারে। যেভাবেই হোক, যে জন্মালো তাতে তার কোনও হাত নেই। শুধু ভোগ আর ভোগান্তি আছে। লড়াই আছে। জোর সে বোলো..
লড়াই লড়াই লড়াই চাই..
লড়াই ক’রে বাঁচতে চাই।
মোবাইল ফোনে রিংটোন বাজছে,
‘মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে..’
স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে নাম, মিলি,
ভেলোর আঠারো বছরের বসন্ত হৃদয়ে কোয়েল ডাকছে, ও আমার মিলি সোনা..
স্পিকারে একরাশ পলাশ প্রেমের রঙ ছড়িয়ে ভেলো বললো, হ্যালো,
ও প্রান্তের দখিনা বাতাস মেশানো মৃদু মিঠে স্বর,
কী করছো?
সিঁড়ির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে, ভেলোর ফিসফিস উত্তর- কিছু না, ছাদে আছি,
ওপ্রান্তে ব্যকুলতা ভরা মিঠে ধমকানি,
-এমা কেন? সন্ধ্যেবেলা কেউ ছাদে থাকে ফাগুনের শিশির, ঠান্ডা লেগে যাবে তো !
-লাগুক, কিচ্ছু হবে না। ঘরে বসে তোমার সঙ্গে কথা বলা যায় না। এই বেশ..কেউ নেই, নিরিবিলি। ভেলো আরও একবার ছাদের সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হলো। নাঃ, কেউ নেই। বাবা এখনো অফিস থেকে ফেরেনি। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। একমাত্র ছোট বোনটা। মহা ফাজিল। যে কোনও সময় পা টিপে টিপে ওপরে উঠে আসতে পারে। যদি দেখে ফেলে টুক করে মা’কে লাগিয়ে দেবে। ব্যাটা চুকলি-খোর নম্বর ওয়ান।
সত্যি, কী কপাল মাইরি। হায়রে স্বাধীনতা বলে কি কিছুই থাকতে নেই এই জীবনে ! কিছুই তো না। শুধু চুপিচুপি একান্তে নিজের প্রিয় মানুষের সঙ্গে একটু মনের কথা শেয়ার করা। গতানুগতিক কেতাবী ছকের বাইরে একটু অন্যরকম অনুভূতির ছোঁয়া। প্রাণ মন ভেজা আঁধারি সোঁদালি গন্ধ মেশানো স্বপ্ন সন্ধানী গল্প। সেখানেও কাঁটা ঝোপের জঙ্গল। দূর দূর এ-ই কী জীবন? সাধে কী আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না, অনেক জ্বালা রে ভাই।
সেদিন কোচিং কেটে বিকেলবেলা মিলি আর আমি একটু নিউমার্কেটের আসেপাশে আঙুল ধরাধরি করে অকারণ হাঁটছিলাম। ব্যাস, পড়ে গেলাম ফ্ল্যাটতুতো কাকিমার চোখে। কী সাংঘাতিক দৃষ্টি মাইরি। অত ভীড়ের মধ্যেও ঠিক চোখ গেছে। দৃষ্টি তো নয় শ্যেনদৃষ্টি । ঠিক আছে বাবা। দেখেছিস বেশ করেছিস। মায়ের কাছে গিয়ে সাতকাহন গপ্পো মারবার কী দরকার ছিল ? মায়ের কানে খোড়কে গুঁজে, আমার সর্বনাশ না করলে চলছিলো না ?
জানেন তো মিসেস মল্লিক, আজকে তো নিউমার্কেট গিয়েছিলাম। পরশু ননদের মেয়ের জন্মদিন, ওই কিছু উপহার টুপোহার নিলাম আর কি। ভেলোর সঙ্গে তো দেখা হলো, ও বলেনি কিছু? সঙ্গে তো একটা মেয়েও ছিল, ওরই বয়সী। কী যেন নাম? বলেছিল, ভুলে গেছি। বললো তো ওর বন্ধু। হাতে হাত রেখে দু’জন গটমট করে হেঁটে যাচ্ছিল। বেশ লাগছিলো কিন্তু ওদের।
কী ডেঞ্জারাস মহিলা রে বাবা। ভাবা যায় না। অথচ ওনার সঙ্গে একজন পুরুষ ছিল, যাকে কস্মিনকালেও এই ফ্ল্যাটের আনাচে-কানাচেতেও কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। তার সঙ্গে গতরে গতর লাগিয়ে হ্যা হ্যা করে হাঁটছিলে, কই, সেকথা তো উচ্চারণ করলে না, বেমালুম চেপে গেলে।
জিও কাকি জিও। যেদিন হাঁড়ি ফাঁসিয়ে দেবো না, সেদিন বুঝবে ঠ্যালা। সোজা কাকুর কাছে পর্দা ফাঁস করে দেবো। বদলা আমিও নিতে জানি , মনে রেখো।
কী ভাগ্যি কথাটা বাবার কান পর্যন্ত পৌঁছোয় নি। মাই সুইটহার্ট মাদার, ব্যাপারটা বিশেষ গুরুত্ব দেয় নি, এই যা রক্ষে। শুধু তাই নয়- মা ওই মেয়ে বিভীষণ আমার বোনকেও বারণ করে করে দিয়েছিল, বাবার কাছে যেন এসব ফালতু কথা বলা না হয়।
সেই থেকে মিলির সঙ্গে মেলামেশায় আরও গোপনীয়তা চালু করতে হলো। সন্ধ্যের ছাদ, সেই গোপনীয়তার মোক্ষম জায়গা ।
অবিশ্যি অচিরেই বোঝা গেল, আমি একটি গোদা আহাম্মক। মিলির সঙ্গে প্রেমালাপ সাঙ্গ করে ফুরফুরে মেজাজে নিচে নামতেই, মা শান্ত গলায় বললো- শোন ভেলো, ফাগুনের চোরা ঠান্ডা। সন্ধ্যেবেলা ছাদে গিয়ে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করার দরকার নেই। যা বলবার, শোনবার এই ঘরে বসেই করবি। দ্বিতীয়বার যেন বলতে না হয়।
আয়নায় নিজের মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। লাল নাকি কালি বর্ণ ধারণ করেছিলো। তখনও একবার মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। হে ফ্ল্যাটের মেঝে দুফাঁক হও। আমাকে সপাটে গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছড়ে ফেলো। থেঁতলানো তরমুজ হয়ে মাটিতে পড়ে থাকি।
ধরণীতে কিছুই টেঁকসই নয়। সবই মায়ার খেলা।
সময়ের সাথে সাথে মিলি মিলিয়ে গেল। রয়ে গেল স্মৃতি। কাউকে বলা যাবে না। রেখে দিতে হবে মন সিন্দুকের কম্বিনেশন চাবির গোপন অন্তরালে। নিঃশব্দে।

Loading

Leave A Comment