শিকার
– শম্পা সাহা
এমিলি পাশে শুয়ে শুনতে পায়, নিহাল ফিসফিস করে কাকে যেন বকছে, “এতো রাতে বলেছি না আমায় ফোন করবে না!”
ওপাশের কন্ঠস্বর শোনা যায় না, কিন্তু এ পাশে বক্তা বেশ বিরক্ত, ফোনটা কেটে খটাস করে বেডসাইড টেবিলে রেখে চোখ বোজে। বাঁ-পাটা অভ্যাস বশতঃ এমিলির গায়ে এসে পড়ে।
এমিলি কিছুক্ষণ পর, ধীরে ধীরে পা-টা গা থেকে নামিয়ে দেয়। ততক্ষণে নিহাল গভীর ঘুমে।ঘুমোলে বোধহয় মানুষের ওজন বেড়ে যায়। যেমন ড্যাডি ছোট্ট এমিলিকে মাম্মির পাশ থেকে বেবি কটে শোয়াতে শোয়াতে বলতো, “বাব্বা! এমিলি তো দেখছি বেশ ভারী হয়েছে! আমি ওকে আর কোলে নিতে পারছি না!” আদরে আবদারে আধো ঘুমে এমিলি আঁকড়ে ধরতো ওর বড় টেডিটাকে। যেটা ছিল ওর সব সময়ের সঙ্গী।
নিহাল পাঞ্জাবি পরিবারের উচ্ছল চঞ্চল এক যুবক। সবাইকে মাতিয়ে রাখাই ওর উদ্দেশ্যে যেন। পড়াশোনা তো আছেই তবে তার সঙ্গে সঙ্গে কাউকে ব্লাড দেওয়া, কে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া, নোট দেওয়া এসব তো আছেই। তা ছাড়া ও ভালো গান গায়, গিটার বাজিয়ে যখন চোখ বুঁজে রবীন্দ্র সঙ্গীত গায় তখন কে বলবে ও বাঙালি নয়! আসলে ওদের পাঁচ পুরুষই বাংলার বাসিন্দা তাই ও নামেই পাঞ্জাবি কিন্তু মনে প্রাণে বাঙালি।
এমিলি যে এমন একজন ছেলেকে পছন্দ করবে এ তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু নিহালকে ভালোলাগার মূল কারণ হল, ফার্স্ট ইয়ার বোটানি পরীক্ষা। হঠাৎ তলপেটে ব্যথা। কিন্তু পেপার শেষ করার এতো তারা, যে আর কোনো দিকে তাকানোর সময় নেই।
পরীক্ষা দিয়ে বেরোচ্ছে হঠাৎ নিহাল কানের কাছে এসে বললো, “তোর বোধহয় পিরিয়ড হয়েছে। একটু দেখ তো! ” চমকে তাড়াতাড়ি পেছনে দেখে, প্যান্ট প্রায় মাখামাখি। কি হবে? এমিলি বোকার মত নিহালের দিকে তাকায়। পরিস্থিতি বুঝে, নিহাল বলে, “দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়া, আমি আসছি”। বাইকটা ওর কাছে এনে বলে, “ওঠ”। সেদিন নিহাল ওকে বাড়ি পৌঁছে দেয়।
এরপর ওদের প্রেমটা শুরু থেকে বিয়ে পর্যন্ত যেতে আর সময় লাগলো না। যদিও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এমিলির পরিবারের তুলনায় নিহালের পরিবার থেকে বাধাটা এসেছিল অনেক বেশি! কিন্তু সেটা ওরা সহজেই পার করলো। কারণ কলেজ শেষ হতেই এমিলি আর নিহাল দুজনেই বেশ মোটা মাইনের জবে ঢুকে গেল।
ওদের বারোশো স্কোয়ার ফিটের সংসার গড়িয়া হাটের মোড়ে। সেখান থেকে দুজনেরই অফিস কাছে। কিন্তু প্রাইভেট ফার্ম মানেই আঠারো ঘন্টার অফিস। বাড়ি ফিরে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরেও ওরা প্রেমটা বাঁচিয়ে রেখেছিল।
উইক এন্ডে একটু আউটিং, ডিস্কো, লেট নাইট পার্টি এ সবই ওদের ব্যস্ততম জীবনের ক্লান্তি হয়তো কাটাতো কিন্তু মন! মন যেন ধীরে ধীরে দুদিকে হাঁটা দিল।
কোথায় সেই চঞ্চল, ছটফটে, আনন্দ মুখর নিহাল, অফিস, আর অফিস শেষে বোতল খুলে বসা। এতো ব্যস্ততায় ওরা কোনো ইস্যু নেবার কথাও ভাবতে পারে না। কে সময় দেবে? কে কেয়ার নেবে সন্তানের? তাছাড়া এই মুহূর্তে কেরিয়ারই সব। প্রোমোশন, প্রোমোশন, প্রোমোশন, তারপর বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি, শেয়ার মার্কেট, ইনভেস্টমেন্ট।
এই করতে করতে কবে যে বয়স পঁয়ত্রিশ পার হলো, কবে যে নিহাল আর এমিলি প্রেমিক যুগল থেকে এক ছাদের তলায় থাকা দুটো আলাদা মানুষ হয়ে গেলো, ওরা জানতেই পারলো না।
নিহাল আর এমিলির মধ্যে কোনো রহস্য খুঁজে পায় না, কোনো নতুন কিছু আর এমিলির নেই যা খুঁজবে নিহাল। আর এমিলিরও ধীরে ধীরে একাকীত্বটাই অভ্যাস হয়ে গেল।
অফিস থেকে ফিরে এমিলি আর পার্টিতে আনন্দ পায় না, ড্রিংকে উত্তেজনা পায় না, নিহাল আর ওর কাছে শরীরের জন্যও আসে না। গত তিন চার বছর ধরে ওরা দু’টো শরীর এক বিছানায় উপবাস পালন করে। তবে এমিলির আর ওসব ইচ্ছে করে না। কি হবে? কোনো কিছুতেই আর কি কিছু হবে? এটাই এখন মনে হয় এমিলির।
অনেক রাত পর্যন্ত নীল আলো জ্বেলে চ্যাটে ব্যস্ত থাকে নিহাল, কারো সঙ্গে যে ভীষণ ভাবে ব্যস্ত অথবা কারোর কারোর সঙ্গে, সেটা এমিলির কাছে স্পষ্ট। কিন্তু এমিলির তাতে কিছু যায় আসে না।
নিত্য নতুন অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে অফিসের দু’ এক জনের সঙ্গে দীঘা, পুরিও গেছে। কিন্তু প্রতি বারই ঘেন্না লেগেছে, বিশ্রী লেগেছে এই ভেবে যে মনের যেখানে পরিপূর্ণতা নেই, সাড়া নেই সেখানে শরীর কি তৃপ্তি দেয়?
ও নিজেকে নিজে অনেক প্রশ্ন করেছে কেন এই অপূর্ণতা? নিহাল তো বিভিন্ন ভাবে খুশি রাখতে চায় নিজেকে কিন্তু এমিলি? ডিলডো, ভাইব্রেটর সব সব কেমন যেন ফালতু। তাতে যেন শেষে আরো বেশি করে ডিপ্রেশন চেপে বসে। আরো বেশি একা, আরো বেশি নিঃসঙ্গ, আরো বেশি করে বন্ধুহীন!
এখন ঘর অন্ধকার করে বসে থাকতে ভালো লাগে আলোর তুলনায়। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে শোনে নিহালের প্রেমালাপ, আশ্লেষপূর্ণ আবেগের অস্ফুট উচ্চারণ। আগে আগে মন খারাপ করতো, গরম জল চোখ গড়িয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে বালিশ, কিন্তু এখন আর কিছু মনে হয় না। শুধু থাকার জন্য থাকা, ভালোলাগাহীন শুধুই অভ্যাস যেন। নতুন কাউকে এমিলির আর ভালোও লাগলো না, কারণ সে অনুভূতিটাই তো মরে গেছে। অফিস আর বাড়ির অন্ধকার ঘর এছাড়া ওর আর কোনো অবস্থান নেই! নিহালের ওপর রাগ নেই, দুঃখ নেই শুধু শূণ্যতা, এক বিরাট শূণ্যতা যেন।
এ তো লক্ষ কোটি ব্যস্ত মানুষের ভবিতব্য, যারা কেরিয়ার গড়তে, ভবিষ্যৎ খুঁজতে আসল জীবনকেই হাতছাড়া করে ফেলে! এর পরবর্তী শিকার আপনি নন তো?