পরমান্ন
– অঞ্জনা গোড়িয়া
দীর্ঘ দশ বছর পর রানী পোয়াতি হয়েছে। অনেক ডাক্তার বদ্যি করে তবেই সম্ভব হয়েছে৷ ডাক্তার বলেছে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হবে। একটু এদিক ওদিক হলেই বেবীর কিছু ক্ষতি হতে পারে।
রানীকে রানীর মতো রেখেছে বাড়িতে। এর আগে দু -দুবার বেবি নষ্ট হয়ে গেছে। এত বড় বাড়িটা প্রাণহীন হয়ে আছে। তাই সবাই খুব চিন্তিত। খুব সাবধানে যত্ন করে রেখেছে রানীকে। তখনকার দিনে পোয়াতিরা ঠিক মত পুষ্টিকর খাবার পেত না। তাই সাধ উৎসব নামে বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভালো কিছু খাওয়ানোর ব্যবস্থা ছিল পোয়াতিকে।
সেই রেওয়াজটাই চলে আসছে আজো।
নতুন পোশাক পরে পায়ে আলতা মাথায় টকটকে সিঁদুর লেপে সজ্জিত রানী। লজ্জায় রাঙা হয়ে আছে। ঠিক কনে সেজে যেমন লজ্জাবতী হয়ে বসেছিল বিয়ের আসরে। আজও গর্ভে সন্তান নিয়ে পরিপাটি সাজে রাঙা হয়ে বসে আছে রানী। অনেক কিছু ভালো মন্দ আহার করতে হবে। ফল মিষ্টি সাজিয়ে রাখা হয়েছে রানীর সামনে। প্রথম খাবারটা রানীকেই খেতে হবে। আর আছে পরমান্ন। এটা রানীর জন্যই তৈরী করা।
আজ যে রানীর সাধ- উৎসব। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন কেউ বাদ নেই। সবাই নিমন্ত্রিত। কিন্তু বাদ পড়লো শুধু বুড়ি দাইমা। রানীকে মেয়ের মতোই ভালোবাসে। নিজের বলতে তার কেউ নেই।
নয় মাসের সাধ ভক্ষণ মানে বাঙালি প্রথা অনুযায়ী নয় রকম মিষ্টি, ফলাদি সঙ্গে দই চিড়ে মুড়কি, লুচি ঘুগনি থেকে আরম্ভ করে যাবতীয় ভালো ভালো আহারাদির আয়োজন হয়েছে। জলখাবার খাওয়া শেষ হলে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা। ভাতের সঙ্গে ন’ রকম সব্জি তরকারি পায়েস সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আগ খাবার মানে প্রথম খাবারটা পোয়াতিকেই খেতে হয়। একটু একটু করে তাই সব তুলে রাখা হয়েছে। তবু রানীর মনটা চঞ্চল হয়ে উঠছে।রানী বারবার দাইমাকে আসতে বলেছিল। কিছু দূরেই বুড়িমার বাড়ি। তবু এখনো কেন এল না?আসছে না দেখে রানী বারবার বাইরের দিকে চেয়ে আছে।
শুভ কাজে বসার আগে একবার প্রণাম করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু দাইমার দেখা নেই। মন খারাপ করে বাড়ির সকল গুরুজনদের প্রণাম করে সবে মাত্র খেতে বসবে। বুড়িমা এসে হাজির। হাতে একটা ছোট কৌটো।
রানীর কাছে এসে বললো, তোর জন্য কিছুই করতে পারি নি। একটু পায়েস এনেছি। খাবি মা? খুব ভালো লাগবে। বুড়িমা যখন তখন আসতো।
আর রানীর জন্য আচার কুল তেঁতুল যা যা খেতে ভালোবাসে সব নিয়ে হাজির হতো। বাড়ির অন্যরা অবশ্য এই বাড়াবাড়িটা পছন্দ করত না। অনেক বার বুড়িমাকে সাবধান করেছে, এই অবস্থায় যা খুশি খেতে দিও না৷ তবু মায়ের মন তো। রানীর খেতে ইচ্ছে করলেই লুকিয়ে খবর দিত। আর ঠিক এনে হাজির করতো।
একবার সত্যিই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। বাড়িতে সেদিন বিরিয়ানি সঙ্গে চিলি চিকেন ফ্রায়েডরাইস সবই হয়েছিল। রানীর খুব পছন্দের খাবার। মনের মতো করে খেয়েছে। তার ওপর বুড়িমার তৈরি তালের পিঠেপুলি, লোভ সামলাতে পারে নি। ব্যস আর যায় কোথায়? রাত থেকে পেট ব্যথা আর বমি। বাড়িতে ডাক্তার আনা হল। স্যালাইন দিয়ে কোন ক্রমে সে যাত্রায় রক্ষা পেল। তারপর থেকে বুড়ির এ-বাড়িতে আসায় বারণ। অথচ এই দাইমাই রানীর স্বামীকে জন্ম দিয়েছে নিজের চেষ্টায়। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার মতো সময় ছিল না। গ্রামের বেশির ভাগ সন্তান এই দাইমার হাতে জন্মেছে।
দাইমার আদর ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না। যখনই কারোর বাচ্চা হবে খবর পেলেই যেচে উপদেশ দিতো, কি করা উচিৎ? কেমন করে থাকতে হবে? সব কিছু সুন্দর করে বুঝিয়ে দিত।
রানীকে আরো বেশি করে নজর দিত।
পায়েসের কোটটা কাছে আনতেই রানীর স্বামী চিৎকার করে ওঠে। খবরদার এসব নোংরা খাবার দেবে না একদম। রানীর কিছু হলে, কে দেখবে বলো?
বুড়িমার চোখ দু’টো ছলছল করে উঠে। কিছু না খেয়েই বেরিয়ে যেতে প্রস্তুত। রানীর মনটাও খারাপ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে বুড়িমার দেওয়া পায়েসটাই মুখে দিল পরম তৃপ্তিতে। প্রণাম করতে গেলে, বুকে টেনে নেয় বুড়িমা। মায়ের আশির্বাদী পরমান্ন খারাপ হতেই পারে না।
সেই রাতে প্রচন্ড ঝড় জল আরম্ভ হল। রানীর এখনো অনেক দিন বাকিই ছিল। তবু কি কারণে আবার পেট যন্ত্রণায় ছটপট করতে থাকে। বুড়িমার নাম করে যা খুশি গালাগালি করলো রানীর স্বামী। নিশ্চয় ওই পায়েস খেয়েই এমন হয়েছে। ডাক্তার ডাকা হলো। এত দূর থেকে এই ঝড়বৃষ্টির রাতে আসতে চাইলো না।
গাড়ি ভাড়া করে কলকাতায় আনার ব্যবস্থা করলো। রাস্তার মাঝেই বড় গাছ ভেঙে পড়েছে। যাওয়ারও উপায় নেই।
রানী বারবার বললো, একবার বুড়িমাকে খবর দাও। ঠিক বুঝতে পারবে, কিছু একটা ব্যবস্থা করবে।
বুড়িমার মনটাও কেমন ছটফট করছিল। ছেঁড়া একটা ছাতা মাথায় দ্রুত এগিয়ে আসে। রানীর বাড়িতে। রানীকে দেখেই বুঝতে পারে এটা প্রসব বেদনা। তাড়াতাড়ি গরম জল করতে বললো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ঠাকুরের নাম কর মা। সব ভালোই ভালোই হয়ে যাবে।
ঘরের বাইরে সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় আছে। প্রায় আধ ঘন্টা পর কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেল। ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে।
সকাল হল। রাস্তা পরিস্কার হল। সকালে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল হসপিটালে। সঙ্গে দাইমাও এলো। ডাক্তার বেবি ও রানীকে দেখে খুব সন্তুষ্ট। সত্যিই বেবির সময় হয়ে এসেছিল। একটু দেরী হলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেত। দাইমাকে প্রণাম করলেন ডাক্তার বাবু।
ডাক্তারবাবু বাকী চিকিৎসা শুরু করে দিলেন।
রানী কিন্তু খুব খুশি। বুড়িমার দেওয়া পরমান্নই বেবিকে বাঁচিয়ে দিল। সবাই নিজেদের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত হল।