খেপী
– শম্পা সাহা
খেপীটা রাস্তায় রাস্তায় মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ায়। ও শুধু রাস্তা ঘাটে ঘুরেই বেড়ায় না, ইস্কুলেও যায়। যেদিন যেদিন চাল দেয়, সেদিন সেদিন।
গিয়ে ফার্স্ট বেঞ্চের ধারে বসে, ওটাই ওর বাঁধা জায়গা। যেদিন যেদিন যাবে, সেদিন সেদিন কেউ ওখানে বসার সুযোগ পায় না। ওরই যেন কেনা জায়গা।
রহিমা একদিন বসেছিল, খেপীটা ঘাড় গোঁজ করে বলে, “তুই সর”
“কেন, এ কি তোর কেনা জায়গা?” রহিমা তেড়িয়া জবাব দেয়।
ব্যস্, হুটোপুটি, মারামারি, রহিমার চুল ছিঁড়ে, তার স্কুল থেকে দেওয়া শার্টের পকেট ছিঁড়ে একাকার। বেচারা রহিমা কেঁদে আকুল। কিন্তু খেপীটা কে বোঝায় যে ও ভুল করেছে।
হেড দিদিমণির ঘরে ডাক পড়লো, ওর সেই এক কথা, কোনো যুক্তি নেই, কোনো বুদ্ধি নেই, কোনো ঠিক ভুল নেই, “ও কেন আমার জায়গায় বসেছে?” ওকে বোঝানো গেল না, যে ও ভুল। দিদিমণির আর কিই বা করার থাকে? তবু যতটা পারলেন বুঝিয়ে পাঠালেন খেপীকে। ও এসে আবার নিজের জায়গাতেই বসলো! রহিমা কেঁদে ফোলানো চোখ নিয়ে সরে বসলো পিছন বেঞ্চে।
ওর একটা পোশাকী নাম আছে বাসন্তী, বাসন্তী মন্ডল। কিন্তু সবাই ওকে খেপী বলেই ডাকে আর ও সাড়াও দেয়। বরং স্কুলে ওর নাম ডাকলে ও বুঝতেই পারে না, যে ওকে ডাকা হচ্ছে! বরং অন্য মেয়েরা ওকে খোঁচায়, “এই উপস্থিত বল!” ও যন্ত্রের মত উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “উপস্থিত”..
স্কুল থেকে যখন কাউন্সিলিং-এ আসা ডাক্তার ওকে গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অন্বেষা ক্লিনিকে যেতে বললো, কে শোনে কার কথা! ও তো কিছু বুঝলোই না। ওর বাড়ির লোককে ডেকে পাঠানো হল, তাও বোধহয় খেপীটা বলতে ভুলে গেছে। শেষে অন্য ছাত্রী দিয়ে খবর পাঠানো হল। ওর বাড়ির লোক এসে বললো, তাদের মাঠে খাটতেই দিন যায়, “হাসপাতালে যাবো কখন?”
“তাহলে আপনাদের মেয়ে কি এভাবেই থাকবে?” কি করবো দিদিমণি, সবই কপাল!” ব্যস কপালের দোহাই দিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে বঞ্চিত হল স্বাভাবিক জীবন থেকে।
পাশ ফেল না থাকার দৌলতে খেপী এখন ক্লাস সেভেন। তবে স্কুল না গিয়ে ও ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে আদাড়েবাদাড়ে। কখনো হয়তো নদীর ধারে একটা কাশের শিষ্ চিবোচ্ছে, অথবা নদীর একেবারে শেষ ধাপে বসে জলে পা ডুবিয়ে ঢিল ছুঁড়ছে, যে তরঙ্গ উঠছে তাতে ওর বেশ মজা।কেমন ঢেউগুলো সরে সরে ধাক্কা মারছে সিঁড়ির ধাপে,ওর পায়েও। খেপীটা হাততালি দিয়ে ওঠে, খুশি হয় খুব। মাথার চুলে জট, উকুন, মাঝে মাঝে উকুন নামে গাল বেয়ে। দুই আঙুলের ফাঁকে ধরে টুক্ করে টিপে মারে।
তবে যখন ছোট ছিল, তখন এক রকম। কিন্তু এখন বড় হয়েছে, মনে নয় শরীরে। যদিও ও অতশত বোঝে না। কিন্তু শকুন শিয়াল নেকড়েরা ঠিকই বোঝে। তারা তো জানে, যে এ খুব সহজ শিকার।
তাই আজকাল ওরা পাটের খেতে ডেকে নিয়ে যায় ওকে। ওই যারা পাট খেতে কাজ করতে আসে। খেলা করার অছিলায় বাচ্চা মেয়েটার কোমল শরীরে এদিক ওদিক হাত বোলায়। কখনো কখনো খেপীটার ব্যথা লাগে। ধুরন্ধর শকুন বোঝায়, “এটা খেলা, এতে একটু লাগে, কাউকে বলতে নেই।”
আস্তে আস্তে খেপীটারও ভালো লাগে খেলা। ও প্রায়ই চলে আসে খেলতে বর বৌ খেলা। শকুনেরা বলে এ রকম করেই নাকি খেলতে হয়। খেপীটার কষ্ট হয় খুব। শকুনেরা খুব চালাক, বোঝে তাড়াহুড়ো করলে শিকার ফস্কে যেতে পারে, এছাড়া অন্য বিপদও আছে।
কিন্তু একদিন ওর মা মেয়ের শরীরে পরিবর্তন দেখে একটু সন্দেহ করে। নানান প্রশ্ন করে বোঝে সত্যিটা কি? নিয়ে যায় গ্রামের ডাক্তারের কাছে। কি একটা ওষুধ দেয় ডাক্তার। খুব কষ্ট পায় খেপীটা। পেটে যে খুব যন্ত্রণা।
ধীরে ধীরে খেপীটা সুস্থ হলে ইস্কুলে যায় চাল আনতে, আলু আনতে, সাবানও। খেপীর মা বোঝে, ও তো মানুষও না। যদি ওকে দিয়ে সংসারের কিছু সুরাহা হয়।
তারপর থেকেই বিভিন্ন মেলায় খেপীটাকে ওর বাবা মা-ই নিয়ে যায়। গ্রামের চালাঘরগুলোতে খেপীটা খেলে সেই পুরোনো, আদিম খেলা নিত্য নতুন শকুনের সঙ্গে। ওর মা কড়কড়ে নোট গুণে বাকি ভাই বোনেদের জন্য কিনে দেয় মেলায় বিক্রি হওয়া পাঁপড় ভাজা, জিলিপি, রঙীন কাঁচের চুড়ি। খেপীটাও পায়, কিন্তু শেষে।
এখন অবশ্য খেপীটা আর স্কুলে যায় না, চাল আলু আনতে, আর মেলার মাঠেও যায় না। এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, আর খিদে পেলে হাত পাতে। শকুনেরা আজও ওৎ পাতে, তবে খেপীটা আজকাল কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেখলেই চিৎকার করে মারতে যায় থান ইট নিয়ে।
সেই যেবার একটা শকুন যখন অনেকগুলো কড়কড়ে নোট দিয়ে ওকে বেশি করে যন্ত্রণা দিয়েছিল, খেপীটা হাতের কাছে থাকা থান ইট তুলে বসিয়ে দিয়েছিল মাথায়। শকুনটা মরে নি, কিন্তু রক্ত বেড়িয়েছিল খুব। সেই থেকে খেপীটার মাও সাহস পায় না ওকে কড়কড়ে নোটের বিনিময়ে খেলতে বাধ্য করতে।