গোপালের ভোগ
– জয়তী মিত্র
আজ মাঘী পূর্ণিমা। খুব ভোরে উঠে স্নান সেরে সুমনা দেবী গোপালের ভোগ রান্নায় ব্যস্ত। খিচুড়ি, পাঁচ রকমের ভাজা, লাবড়া, চাটনি, পায়েস সব রান্না করে আজ তিনি তার আরাধ্য দেবতা গোপালের চরণে নিবেদন করবেন। তারই প্রস্তুতি চলছে সকাল থেকে। এত কাজ সব একা হাতে সামলান তিনি। ঠাকুরের কাজ একাই করতে পছন্দ করেন তিনি। আর তাছাড়া এই সময়ে তার একমাত্র ছেলে শুভ অফিসে যায়। নাতি স্কুলে যায়। বৌমা তাদের নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। শাশুড়ি মা’কে সাহায্য করার মতো সময় তার হাতে থাকে না। সুমনা দেবীর তাতে কোন আক্ষেপ নেই।
সারাদিনের বেশির ভাগ সময় তার ঠাকুর ঘরেই কাটে। তিনবেলা গোপালকে খাবার দেওয়া, তারপর বড়ো আসন জুড়ে তার অনেক ঠাকুর। তাদের নিত্য পূজো দিতেই দিনের অনেকটা সময় তার কেটে যায়। সংসারের দিকে তিনি নাক গলান না। ওটা বৌমার দায়িত্ব। আর তাতে বৌমা খুব খুশি। তার ওপরে খবরদারি করার কেউ নেই। তাই শাশুড়ি মায়ের সাথে তার সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই।
কিন্তু সুমনা দেবী মানুষটা খুব কৃপণ টাইপের। হাত দিয়ে তার সহজে কিছু গলে না। তার বৌমা আবার খুব দরাজ মনের। বাড়ীতে কাজের লোক থেকে ভিখিরি পর্যন্ত কেউ তার কাছে কিছু চেয়ে খালি হাতে ফেরত যায় না। কাজের মাসি তো বৌদিমনি অন্ত প্রাণ।
এই তো সেদিন কাজের মাসীর মেয়ের জন্মদিন গেল। বৌদি রুমি একটা বড়ো কেক আর চকলেট কিনে মাসীর মেয়ের জন্য পাঠালো। মাসী তো আনন্দে কেঁদে ফেললো তারপর রুমিকে অনেক আশীর্বাদ করলো।
গোপালের ভোগ দিয়ে সুমিতা দেবী এক কাপ চা নিয়ে সবে বসেছে। বৌমা রুমি একটু কাজে বেড়িয়ে ছিল। ঠিক তখন দুটো বাচ্চা ছেলে গেটের সামনে এসে খাবার চাইলো। সুমনা দেবী ধমক দিয়ে ছেলে দুটোকে তাড়িয়ে দিয়ে বললো, “যা, কাজ করে খা গে, এখানে কোনো খাবার নেই। টাকা কি গাছে ফলে নাকি, বিদায় হ। একটু শান্তিতে চা খাব তার উপায় নেই। যত সব ভিখিরির দল। ছেলে দু’টো শুকনো মুখে চলে গেল।
তারপর ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখেন আসনে তার গোপাল নেই, সুমনা দেবী তো কাঁদতে লাগলেন, তার গোপাল কোথায় গেল? গোপাল তো কিছুই খেল না।
সুমনা দেবীর কান্না শুনে কাজের মাসী মলিনা বললো, “তোমার গোপাল তো তোমার কাছে খাবার চাইতে এসেছিল, তুমি তো তাড়িয়ে দিলে, তাই গোপাল তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভগবান বিরাজ করে। ওই বাচ্চাদের মধ্যেই গোপাল ছিল, তুমি তাদের নাগাল পাওনি মাসিমা। গরীবের সেবা করলেই ভগবানের সেবা হয়। তোমার গোপাল আজ তোমাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়ে গেল। এবার থেকে পারলে গরীব মানুষের জন্য কিছু করো, তাতেই তোমার গোপাল খুশি হবে।”
মলিনার কথা কতদূর কানে গেল কে জানে? সুমনা দেবী গোপালকে আসনে না দেখে তখনো কেঁদেই চলেছে। গোপাল কি তাহলে ভোগ গ্রহণ করলো না? এই প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে লাগলো সুমনা দেবীর মনে।