Site icon আলাপী মন

গল্প- অঙ্কুরে বিনাশ

অঙ্কুরে বিনাশ
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

প্রতিদিন সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ভেঙে যায় প্রতিমা দেবীর। ঊষার কিরণে যখন পূর্বের আকাশ লাল তখনই বাসি কাপড় ছেড়ে ধূপ ধুনো সহযোগে দিনটা শুরু করেন প্রতিমা দেবী।

একমাত্র ছেলে দিল্লিতে থাকে তার পরিবার নিয়ে। বছরে একবার আসে পূজার সময়। তাও শ্বশুরবাড়িতে থাকে বেশি দিন। পুত্রবধূ একমাত্র মেয়ে। সুতরাং তার বাপের বাড়িতে জোর বেশী। যদিও এইসব নিয়ে আজকাল আর কোনো আক্ষেপ করেন না প্রতিমা দেবী।

সকাল আটটার মধ্যে রাঁধুনি রেবা এসে যায়। বেলা নটার মধ্যে ঠিকে ঝি কালুর মা। ওদের সবাইকে নিয়ে বেশ শরগোলে কাটে সকালটা।
রাঁধুনি রেবা রোজ যত না রান্না করে তার বেশি এপাড়া ওপাড়ার খবর শোনায় বেশি।

আজ সকালে রেবা ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই শুরু করে, কাকীমা কাল রাতে পাল পাড়ায় কি কান্ড হয়েছিল কিছু শুনেছো?

– না, আমি কি করে জানবো এপাড়া ওপাড়ার খবর। ওসবের ঠেকা তো তোর।

– রায় মাস্টারকে চেনো তো? ছিঃ ছিঃ এই বুড়ো বয়সে কি কান্ড।

প্রতিমা দেবী বলে, রায় মাস্টার মানে মধুসূদন রায়? ওনাকে তো চিনি। আমার ছেলেকে তো ইংলিশ পড়াতে আসতেন। তা উনি আবার কি করলেন?

– ও কাকীমা, এই সব কথা মুখে আনতেও লজ্জা।কাল রাতে তো পাল পাড়ায় কাউন্সিলর, পুলিশ সবাই এসেছিল। পাড়ার ছেলেগুলো মাস্টারকে মেরেছেও খুব। পুলিশ এসেই তো উদ্ধার করলো।

– দেখ রেবা, গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে আসল ঘটনাটা বলবি কি তুই? আমার এমনিতেই উচ্চ রক্তচাপ। তুই আর সেটাকে বাড়িয়ে দিস না।

প্রতিমা দেবী ও রেবার কথোপকথনের মাঝে এসে পড়েন গৃহকর্তা সুনীল বাবু। উনি রোজ মর্ণিং ওয়াকে যান বাজারের থলি হাতে নিয়ে। শরীরের খেয়াল রাখার সাথে সাথে সুনীল বাবু জিহ্বার খেয়ালও রাখতে ভালোবাসেন। কাঁচা কলা, মোচা, থোড় এইসব আয়রন জাতীয় খাবার তার খুব প্রিয়। যদিও রেবা মনে মনে খুব অসন্তুষ্ট হয়। কতবার হাবে ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, বাজারে একটা মোটা করে মাসি আছে। যার কাছে মোচা, থোড়, ইচোর, কচুশাক, কচুলতি সব কাটা পাওয়া যায় কাকু। দামও বেশি নেয় না।সেখান থেকেই তো আনতে পারো কাকু।

তবে আজ মর্ণিং ওয়াক থেকে ফিরলেন সুনীল বাবু একটু গম্ভীর মুখে। বাজারের ব্যাগে আজ কাঁচা লঙ্কা ছাড়া কিছুই নেই। হাত পা ধুয়ে বললেন, গিন্নি একটু লিকার চা নিয়ে এসো তো ড্রয়িং রুমে।

প্রতিমা দেবী ড্রয়িং রুমে আসতেই সুনীল বাবু বলেন, আজ হাঁটতে গিয়ে একটা খবর শুনলাম। আমার তো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। রবীন বাবু বললো, খবরটা কিন্তু পুরোপুরি মিথ্যা নয়। এর আগেও ওনাকে নিয়ে এইরকম কথা শোনা গেছে।

প্রতিমা দেবী বলেন, তুমি কি রায় মাস্টারমশাই এর কথা বলছো?

সুনীল বাবু ভ্রু কুঁচকে বলেন, তুমি জানলে কি করে গো এত সকালে?

– না গো আমি এখনও পুরো বিষয়টা সম্পর্কে জেনে উঠতে পারি নি। আমি শুধু মাত্র আন্দাজ করে নামটুকু বললাম। আসলে রেবা এসে থেকে রায় মাস্টারের নামে নিন্দা করে চলেছে।

-গিন্নি বুড়ো বয়সে সত্যি বোধহয় রায় মাস্টারের মতিভ্রম ঘটেছে। নাতনির বয়সী মেয়ের সঙ্গে কেউ এইরকম আচরণ করে।

– কার সঙ্গে উনি কি করেছেন গো? আমি যতদূর জানি উনি খুব অভিজ্ঞ শিক্ষক।

– সেইখানেই তো অবাক লাগছে। একজন শিক্ষক হয়ে ছাত্রীর সঙ্গে এইরকম অশোভন আচরণ করলেন কিভাবে?

– দূর বাপু তুমি খুলে বল না কার সঙ্গে কি করেছেন উনি ?
একটু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সুনীল বাবু বলেন, হরিপদ বাবুর নাতনি রাই ওনার কাছে ইংরেজি পড়তে যায় সন্ধ্যা বেলায়। ব্যাচেই পড়ে। কিন্তু গতকাল ওরা মাত্র দুজন ছিল। একজন একটু তাড়াতাড়ি চলেও যায়। সেই সুযোগে রায় মাস্টারমশাই হরিপদ বাবুর নাতনির বক্ষদেশে হাত দেয়। সেই মেয়ে টিউশন থেকে ফিরে এসে তার মাকে রায় মাস্টারের কার্য কলাপ বলে।

হরিপদ বাবুর বৌমা সঙ্গে সঙ্গে হরিপদ বাবুর ছেলেকে সব কথা বলে। হরিপদ বাবুর ছেলে পাড়ার বেশ কয়েক জন ছেলেকে নিয়ে গিয়ে হাজির হয় রায় মাস্টারের বাড়ি।

প্রথমে বাগবিতণ্ডা তারপর তারা মাস্টার মশাইয়ের গায়ে পর্যন্ত হাত তোলে। শেষ পর্যন্ত কাউন্সিলর পুলিশ নিয়ে এসে মাস্টার মশাইকে জনতার রোষানলের হাত থেকে রক্ষা করে।

-হ্যাঁ গো তোমার কি মনে হয় মাস্টার মশাই এই নোংরামীটা করতে পারেন?

-জানি না গিন্নি। মানুষের মন না মতি। এই বৃদ্ধ বয়সে এসে এইরকম বিকৃত রুচি কিভাবে জন্মালো ওনার।
– তবে কি জানো ওনার চরিত্র সম্বন্ধে কথা আমিও এর আগে শুনেছি। উনি নাকি বোঝাতে বোঝাতে ছাত্রীদের পিঠে,থাই-এ হাত বুলান। তবে এই নিয়ে এতকাল কোনো ছাত্রী মুখ খোলে নি।তাই হয়তো ওনার এইধরনের অশোভন কাজ করার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল।

– হ্যাঁ গো হরিপদ বাবুর নাতনি রাই-এর সাহস আছে বলতে হবে।
সুনীল বাবু বলেন, লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েরা অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা মুখ বুজে সহ্য করে নেয়। এই দূর্বলতাকেই অনেক পুরুষ ব্যবহার করে নিজেদের কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য।

প্রতিমা দেবী বলেন, দেখলে তো এখনকার মেয়েদর সাহস। ঠুকনো মান সম্মানের ভয়ে অন্যায়কে মুখ বুজে সহ্য করে নি। মেয়েদের শরীর মানেই কি ভোগ্য বস্তু! এই ধারণার পরিবর্তন আসবেই একদিন ধীরে ধীরে। এই কথাগুলো বলতে বলতে প্রতিমা দেবীর চোখে মুখে ফুটে উঠলো প্রতিবাদের ভাষা।

Exit mobile version