ভিলেন
-সুনির্মল বসু
এই মরশুমে মারাত্মক খাটা খাটুনি গিয়েছে ওর, নটসূর্য যাত্রা পার্টিতে নামকরা খলনায়ক গোবিন্দ সামন্তর। কংস বধ পালায় ও কংস সেজেছিল, সাবিত্রী সত্যবান পালায় ওর ভূমিকা ছিল যমের। মেদিনীপুর, নদীয়া, হুগলি,দুই চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে রাতের পর রাত অভিনয় করেছে ও। কাগজে ওর অভিনয়ের প্রশংসা বেরিয়েছে।
আজ ছুটির দিন। সকাল থেকেই ওর মেজাজটা ফুরফুরে। ছুটি পেলেই গান শোনা, ওর নিজস্ব বিলাস। হোম থিয়েটারে সকালে গান চালিয়ে ছিল গোবিন্দ। সকাল দশটায় আবার বন্ধুদের সঙ্গে জনতা রেস্টুরেন্টে আড্ডা দেবার কথা। বাবা নেই। বোন শিউলির বিয়ে দিয়েছে ও। মাকে বললো, ফিরতে দেরী হবে।
সেজেগুজে চিরুনি দিয়ে বড় বড় চুলগুলোকে আচড়ে নিয়ে পথে নেমে এলো, কিশোর কুমারের গান গাইছিল ও তখন, “কৈ লৌটা দে মেরে বিতে হুয়ে দিন।”
পাড়ার মোড়ে বিমান, শ্যামল, সিদ্ধার্থ সিগারেট টানছিল।
শ্যামল বললো, গোবিন্দদা, গুরু, তুমি তো একেবারে ফাটিয়ে দিচ্ছ, কী অভিনয়,
বিমান বললো, প্রফুল্ল নাটকে তোমার রমেশের রোলটা দারুন হিট করেছে।
সিদ্ধার্থ বললো, শালা, যাত্রার গুলশন গ্রোভার না প্রেম চোপড়া।
হাত কাটা সুজন বললো, গবাদা, তোমার চোয়াড় মার্কা চেহারা দারুন কাজে লেগেছে, বলো।
গোবিন্দ হাসে, উত্তর দেয় না। মুখে বলে, চলি রে, কাজ আছে।
মেন রাস্তায় উঠতেই ওর মৌসুমীর কথা মনে পড়ে যায়। ওরা একই সঙ্গে অভিনয় করে। মৌসুমী ওদের দলে নায়িকা। দারুণ সুন্দরী। যাত্রাদলে ওর যথেষ্ট নাম। গোবিন্দ ওকে ভালোবাসে। মৌসুমী বড় ঘরের মেয়ে। ওর বাবা মারা যেতে ও প্রথমে গ্রুপ থিয়েটারে, পরে অফিস পাড়ায় পেশাদারী নাটকে অভিনয় করে পয়সার জন্য। পরে নটসূর্য যাত্রা পার্টিতে যোগ দেয়। প্রথম প্রথম পরিচালক শশাঙ্ক অধিকারীর কাছে অনেক বকাবকি খেয়েছে মৌসুমী। এখন অভিনয়ের উন্নতির জন্য বড় বড় দল থেকে ওর ডাক আসছে।
মৌসুমী জানিয়ে দিয়েছে, অভাবের দিনে যারা ভাত দিয়েছে, তাদের সঙ্গে বেইমানি করতে পারবো না।
এই দলের রোমান্টিক নায়ক রোমিও চৌধুরীর সঙ্গে দারুণ প্রেমের অভিনয় করে। রোমিও একদিন বলেছে, ‘আমার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর আগে, নইলে আমি তোকে বিয়ে করতাম মৌসুমী।’
বলে হো হো করে হেসেছে। বলেছে, ‘আরে ধুস্, তোর সঙ্গে ইয়ার্কি করলাম আর কি…’
জনতা রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই বন্ধুরা হৈ হৈ করে উঠলো।
দীপ্তেন বললো, বল কেমন আছিস, তোর তো খুব পপুলারিটি আজকাল,
গোবিন্দ হাসলো।
দীপ্তেন ওদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। এখন ব্যাংকের অফিসার। অমলেশ কলেজের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক। হেসে বললো, এবার একটা বিয়ে কর বুঝলি..
-ভাবছি তো,
-কেউ আছে না’কি!
-সময় হলে বলবো..
আড্ডা মেরে চা মিষ্টি খেয়ে বাড়িমুখো হল গোবিন্দ। বিকেলে ডানলপ থেকে মৌসুমী নন্দনে আসবে ওর সঙ্গে দেখা করতে।
বিকেলে জীবনানন্দ সভাঘর এর পাশে ঝিলের ধারে মৌসুমী দাঁড়িয়েছিল। এখান থেকে গির্জার চূড়া পরিষ্কার দেখা যায়।
-কতক্ষন এসেছো?
-মিনিট দশেক..
-চলো, চা খেতে হবে।
-এই জায়গাটা এলে বড্ড ভালো লাগে,
-তাই বুঝি,
-হু,
-অভিনয় করতে করতে মনে হয় এবার জীবনটা সুন্দর করে সাজাতে হবে। তোমার কি মত,
-জীবনে একটা স্থিতি আমারও চাই,
-বিয়ের কথা ভাবতে পারি কি এবার,
-একসঙ্গে চলতে পারব তো,
-পারব পারব,
-তুমি কি আমায় ভালোবাসো,
-হ্যাঁ তো,
এরপর মৌসুমিকে বাসে তুলে দিয়ে গোবিন্দ ঘরে ফেরে। কিশোর কুমারের গান বাজিয়ে দেয়, “কুছ্ তো লোগ কহেঙ্গে, লোগো কা কাম হ্যাঁয় কহেনা।”
ফোন বেজে ওঠে।
-হ্যালো,
-আমি বিজন মুখার্জি বলছি..
-স্যার, ভালো আছেন তো?
-আছি। তোর তো এখন অনেক নাম ডাক,
-আপনাদের আশীর্বাদ স্যার,
-তুই অংক পারতিস না, তবে আমার বাংলার ক্লাসে রবি ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে মাত করে দিতিস।
-স্যার, এবার যাত্রা উৎসবে আসবেন, আমার অভিনয় দেখতে,
-যাব,
-ভালো থাকবেন স্যার,
-তুই ভালো থাকিস।
গোবিন্দ ভাবছিল, জীবনের পথ সবার এক হয় না। বিজন স্যার ওকে বলতেন, চর্চা ছাড়বি না।
পরীক্ষার ফল ভালো হতো না ওর, অথচ ওর শিল্পী মন কি যেন একটা খুঁজতো। সেভাবেই আজ এতদূর।
কত পথ পেরিয়ে আসতে হল।
ফোন বাজল।
-হ্যালো,
-কি করছো? ওপ্রান্তে মৌসুমী।
-কিছু না, গান শুনবো ভাবছি..
-জানি, মুকেশের গান,
-আমি সবার গান শুনি। কিন্তু মুকেশের প্রতি আমার দুর্বলতা আছে। গোবিন্দ গাইলো, “কয়ি যব তুমহারা হৃদয় তোড় দে,”
-কে হৃদয় ভাঙলো!
-কেউ না,
-তবে,
-এমনি গাইলাম,
-আমার উপর আস্থা নেই?
-কখন বললাম?
-তা বলছি না,
-কাল কখন ফোন করবো?
-কাল নয়, পরশু,
-কেন?
-কাল একটু কাজ আছে।
-আচ্ছা। পরশু সকালে তাহলে..
-হুঁ,
অক্ষয় তৃতীয়ার আগে যাত্রায় দলবদল শুরু হয়েছে। নটসূর্যতে থেকে গেল গোবিন্দ। মৌসুমির অনেক দিন দেখা নেই। দলের ছেলে সুজিত বললো, ও শুনেছে, মৌসুমী মনে হয় এবার যাত্রা সাথীতে যাবে। ওরা অনেক বেশি টাকা অফার করেছে।
কদিন মৌসুমীর ফোন নেই। ওকে ফোন করে পাওয়া যাচ্ছে না। গোবিন্দর মন ভালো নেই। আজ দুপুরে আবার চিৎপুরে যেতে হবে।
দুপুরে যাত্রাপাড়ায় যেতেই, সামনে একটা হলুদ ট্যাক্সি থেকে মৌসুমী নামলো। সঙ্গে যাত্রা সাথীর হিরো টোটন কুমার। ওরা হাত ধরাধরি করে ওদিকে চলে গেলো।
রাতে গোবিন্দ ফোন করলো মৌসুমিকে।
-কি ব্যাপার, তুমি আসছো না? ফোন রিসিভ করছো না!
-বিজি আছি,
-কেন!
-আমি নটসূর্য ছাড়লাম,
-কেন বলো তো?
-ভালো অফার পেয়েছি। টোটনদা অফারটা দিল। ছোট দলে পড়ে থাকলে, ক্যারিয়ার চাঙ্গা হবে না।
কদিন আগে দলের ছেলে সুজিত ওকে বলেছিল, টোটন কুমারের সঙ্গে মৌসুমীর গোপন প্রেমের কথা।
গোবিন্দ তখন সে কথা বিশ্বাস করেনি।
-কিন্তু আমাদের সম্পর্কের কি হবে!
-ওসব নিয়ে এখন ভাবছি না।
-আর আমাদের ভালোবাসা!
-সিঁড়ি চাই, বুঝলে সিড়ি চাই, অতীতকে ভুলে যাও,
-কি বলছো তুমি!
-এভাবে আমাকে যখন তখন ফোন করে ডিস্টার্ব করবে না।
গোবিন্দ কিছু বলার আগেই, মৌসুমী ফোন কেটে দিল।
সারারাত ঘুম এলো না গোবিন্দর। সকাল হতেই একটা সিগারেট ধরিয়ে ও জনতার রেস্টুরেন্টে গেল।
সিদ্ধার্থ বললো, তোর অভিনয়ের প্রশংসা আজ কাগজে বেরিয়েছে।
বিমান বলল, আমরা একসঙ্গে জীবন শুরু করেছিলাম, আজ তুই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাম করেছিস,
গোবিন্দ ম্লান হাসে।
মৌসুমী বলে নায়িকাটির সঙ্গে তোর ভালোবাসার কথা কাগজের গসিপ কলমে বেরিয়েছে, কবে বিয়ে করছিস, সিদ্ধার্থ বলে।
গোবিন্দ চুপ করে থাকে। একটু পরে বলে, ভিলেন কখনো হিরো হতে পারে না।
ওর বন্ধুরা সবাই একে অন্যের মুখের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকায়।
গোবিন্দ বলে, একবার ভিলেনের রোল করলে, আর হিরো হওয়া যায় না।
-কি বলছিস তুই?
-হ্যাঁরে, কান্নায় ভেঙে পড়ে গোবিন্দ।
পথে কোথাও ওর প্রিয় শিল্পী মুকেশের গান বাজছিল, “দুনিয়া বানানে ওয়ালে, কে তেরে মনমে সামাঈ,কাহে কো দুনিয়া বানাঈ।”