গল্প- গেঁড়ি গুগলি

গেঁড়ি গুগলি
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

খবরদার বলছি এক পা আর এগিয়ে আসবি না। এইখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি যতক্ষণ না আমি এক বালতি জল আনছি।

-ও ঠাকুমা প্লিজ আজকের মতো মাপ করো দাও না। সত্যি বলছি আর এ ভুল হবে না।
কাঁদো কাঁদো গলায় এই অনুরোধ বাক্যগুলো অযথা খরচা করে চলেছে আট বছরের মিঠি।

মিঠির অনুনয় বিনয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বেতো পা নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কলতলার দিকে হনহন করে চলল মিঠির ঠাকুমা গীতা দেবী।

মিঠির মা ইন্টু রান্না ঘরের জানালা দিয়ে এতক্ষণ ধরে ঠাকুমা আর নাতনির কান্ড কারখানা চুপচাপ দেখছিল। মেয়েকে শাশুড়ি বকছে দেখে ইন্টুর কষ্ট হলেও মুখ বন্ধ করে থাকে। শাশুড়ি কিংবা মেয়ে দুইজনের চরিত্রই তো তার জানা।

মিঠির মুখে সারাদিন খই ফুটছে। একটা কথা বললে দশটা উত্তর দিয়ে দেয় ইন্টুকে। ইন্টু মিঠিকে শাসন করতে গেলেই ঢাল হয়ে মিঠিকে সবসময় রক্ষা করে তার ঠাকুমা গীতা দেবী।

মেজাজ দেখিয়ে উঁচু গলায় গীতা দেবী উল্টে ইন্টুকেই তর্জনী তুলে শাসায়, দেখ বৌমা মুখার্জি বাড়ির মেয়েকে শাসন করতে এসো না। এত বছর তো বিয়ে হয়ে এসেছো এই মুখার্জি বাড়ির ছেলে মেয়ে কারোর মুখে জোরে আওয়াজ শুনেছো। খোকার সঙ্গে ঝগড়া হলে তোমার কথাই বাপু আমার কানে আসে। আজ পর্যন্ত খোকাকে একটা উঁচু গলায় কথা বলতে দেখি নি, বৌ-এর সঙ্গে কিংবা বড়দের সঙ্গে।

সুতরাং তুমি মা জননী নিশ্চিন্তে থাকো আমার মিঠাই দিদিভাই মোটেই মুখরা হবে না। এখন ছোট তাই একটু আধটু বদমাইশি করে। এই আর কি।

সেই ঠাকুমা আজ নিজ হস্তে তার পেয়ারের নাতনিকে দুপুরের কাঠফাটা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আজ আর নাতনির সোনার অঙ্গ তামা হয়ে যাবে বলে ঠাকুমা মাথা ব্যথা করছে না। ইন্টুর মাথাতে কিছুই ঠুকছে না ব্যাপারটা হলো কি?

রান্না ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল ইন্টু।

মা’কে দেখে মিঠাই এবার কেঁদে ফেলেছে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছো না ঠাকুমা আমার সাথে কি ব্যবহার করছে?
– দেখতে পাচ্ছি বলেই তো রান্না ঘরের মেলা কাজ ফেলে ছুটে এলাম। তোর ঠাকুমা যখন তোকে বকছে তখন অন্যায়ের পরিমাণ নিঃশ্চয় বিশাল।

ইন্টুর কথাগুলো শেষ হতে না হতেই গীতা দেবী একটা লোহার বালতি করে প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ করে জল নিয়ে এসে হাজির।

ইন্টুকে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, দেখো দেখো বৌমা। এই বজ্জাতটাকে ছুঁয়ে ফেলো না যেন। আগে ভালো করে স্নান করাই তারপর অন্য কথা। তুমি যাও বাছা তোমার নিজের কাজে যাও। একটার মধ্যে ছেলেরা সব খেতে বসে পড়বে।

ইন্টুও ব্রিটিশ আমলের দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে পৌনে বারোটা বাজছে। তার শ্বশুর মশাই সবসময় ঘড়ির কাঁটা সাথে চলে।
সত্তর বছর বয়সেও রোজ সকালে তাদের মিষ্টির দোকানের শাটারখানি তিনিই তোলেন। জলের ছিটে, ঝাড়ু সব কিছু নিজের হাতে করেন।মিঠাই-এর বাবা জলখাবার খেয়ে নটার মধ্যে দোকানে পৌঁছালে তবেই ইন্টুর শ্বশুর মশাই বাড়িতে ফিরে আসেন।মুড়ি, আলুভাজা সহযোগে জলখাবারটা সেরে জমিতে কাজ দেখতে বের হন।
মিঠাই-এর স্কুল না থাকলে মিঠাইও দাদুর সঙ্গী হয়। দাদুর ছাতার তলায় টুকটুক করে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ায় জমির আল ধরে।

কখনো কখনো ক্ষেত মজুরদের হাত ধরে তাদের বাড়িতে গিয়েও হাজির হয়। মুখার্জিদের বাড়িতে, জমিতে, খামারে তিন পুরুষ ধরে কাজ করছে জীবন দলুইরা। জীবন দলুই-এর বৌ, মেয়ে সময়ে অসময়ে ছুটে ছুটে আসে মুখার্জি বাড়িতে।
মিঠির ঠাকুমাও সেই ছোট্ট থেকে মিঠিকে কোলে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বের হলে একবার গিয়ে দাঁড়াবেই জীবন দলুই-এর ঘরের সামনে।
ছোট্ট মিঠিকে কোলে নেওয়ার জন্য জীবন দলুই-এর মেয়ে অনিমা হাত বাড়িয়ে থাকতো স্নেহের দৃষ্টিতে। মিঠিও ছোটো থেকেই অনিমাকে খুব পছন্দ করে। পেয়ারা, বাতাবি লেবু, খেজুর, আম কখনও বা কলকে ফুল, গন্ধরাজ ফুল কিংবা মাধবীলতা গাছ থেকে পড়ে দেওয়ার আবদারে অনিমাকে অস্থির করে তুলতো। আর অনিমাও নিজের সব কাজ ফেলে ছোট্ট মিঠির বায়না মেটাতো।

যেই না মিঠির ঠাকুমা বালতিটা তুলে হরহর করে জল ঢালা শুরু করেছে তেমনি মিঠি কান্না জুড়ে দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে ঠাকুমাকে বলে, আমি কি এমন অন্যায় করেছি যে তুমি আমার স্কুল ড্রেসটাও ভিজিয়ে দিলে? আমি তো স্কুল থেকে ফেরার পথে রোজই জীবন জেঠুদের বাড়িতে যাই। কৈ তুমি তো এইরকম করে আমাকে স্নান করাও না।

মিঠির ঠাকুমা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, অন্য দিন তো এমন করে পাত পেড়ে খেয়ে আসো না। ছিঃ ছিঃ! এইসব অখাদ্য কুখাদ্য কি করে তুই বামুন ঘরের মেয়ে হয়ে খেয়ে আসলি? আবার খাওয়ার কি ধূম। অনিমার সাথে একথালাতেই চেটে পুটে খাচ্ছে গেড়ি গুগলির ঝাল।

এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো ইন্টুর কাছে। মিঠি স্কুল থেকে ফেরার পথে জীবন দলুই-এর ঘরে পান্তা ভাত, কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা সহযোগে গেড়ি গুগলির ঝাল খেয়ে এসেছে।

ইন্টুর শাশুড়ি মাতা বোধহয় পাড়াতে কারোর বাড়ি গিয়েছিল। ফেরার পথে জীবন দলুই-এর বেরা’বিহীন মাটির খড়ের ছাউনি দেওয়া বাড়ির দিকে তাকাতেই লক্ষ্য পড়ে উঠানে খোলা রয়েছে মিঠির স্কুলের জুতো। মিঠির ঠাকুমা গীতা দেবী পা টিপে টিপে অনিমাদের উঠানে গিয়ে দাঁড়ায়।

অনিমার মা লক্ষ্য করলেও অনিমা আর মিঠি আপন মনে পান্তা ভাত গুগলীর ঝাল দিয়ে খেয়েই চলেছে। গীতা দেবী তো রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, মিঠি তাড়াতাড়ি খাবার ফেলে উঠে আয়। স্কুল থেকে সোজা ঘর যেতে কষ্ট হয়।আজ তুই বাড়ি চল। তারপর তোর একদিন কি আমার একদিন। এই বলে মিঠির হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে এসে মাঝ উঠানে প্রখর রোদের মধ্যে মিঠিকে দাঁড় করিয়ে রাখে।

ইন্টু সাধারণত কখনো তার শাশুড়ি মায়ের বিরোধীতা প্রকাশ্যে করে না।আজ কিন্তু এই সমস্ত ঘটনা জানার পর চুপচাপ গা বাঁচিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল না।

ইন্টু তাড়াতাড়ি একটা গামছা নিয়ে এসে মিঠির গা মুছতে শুরু করে। মাথায় চুল রাখার বড্ড শখ মিঠির। রোজ বিকালে অনিমা লাল ফিতে দিয়ে কলা বিনুনি করে দেয় মিঠিকে। সকালে এই বিনুনি বেঁধেই মিঠি স্কুলে চলে যায়। তাড়াতাড়ি বিনুনিটা খুলে শুকনো গামছা দিয়ে ভালো করে জড়িয়ে দিল চুলটা। মিঠি ইন্টুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলেছে। ইন্টুরও চোখের কোণে অশ্রু ধারা জমাট বাঁধছে।

গীতা দেবী হুংকার দিয়ে বলে, দেখ বৌমা মেয়েকে নিয়ে আদিখ্যেতা না করে ওকে শেখাও যার তার ঘরে খেতে নেই। আমরা ব্রাম্ভ্রণ। সমাজের শ্রেষ্ঠ। আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা বাউরি, বাগদি, হাড়ি, মুচি, ডোম এদের ছায়া পর্যন্ত মারায় না। আর ওদের ঘরে গিয়ে একথালাতে পান্তা ভাত খাচ্ছে তোমার মেয়ে। আমার তো ভাবলেই গা গুলিয়ে উঠছে।

ইন্টু এবার আর চুপ থাকতে না পেরে শাশুড়ির চোখে চোখ রেখে বলে, মা আপনি আপনার নাতনিকে প্রচন্ড ভালোবাসেন জানি এটা। কিন্তু তাই বলে ওকে সব সময় ভুল পথে পরিচালিত করবেন এটা মা হয়ে কিভাবে সহ্য করি।
মিঠির নিষ্পাপ মনে আপনি জাতপাত, অস্পৃশ্যতার বীজ বপন করে চলেছেন। মা আমরা আজ যথেষ্ট সভ্য। উন্নত প্রযুক্তির হাওয়া ঘরে বাইরে সর্বত্র। কিন্তু আমাদের মনের জানালাতে আজও আমরা প্রকৃত মানবিকতার হাওয়াকে ঢুকতে দিতে চাই না। করজোড়ে ইন্টু বলে, মা দয়া করে আপনার মনের ভ্রান্ত ধারণাগুলো বর্জন করুন। না হলে কিন্তু আপনি নিজের অজান্তেই মিঠির ফুলের মতো মনটাকে প্রস্ফুটিত না করে সংকুচিত করে ফেলবেন।

Loading

Leave A Comment