গল্প- শুভ নববর্ষ

শুভ নববর্ষ
– সুদীপা ধর

– মা ও মা এদিকে শোনো না
-কি বলছিস? এত ডাকছিস কেন?
– বলছি কোন লাল রঙের শাড়িটা পড়বো কাল? একটু সিলেক্ট করে দাও না।
– ওফ  কেন তুই পাচ্ছিস না।
– প্রতিবার তো আমিই করি, এই বারটা বলছি করে দাও না। তুমি তো জানো কাল পাড়ায় কত বড় অনুষ্ঠান হবে, সেখানে আমি গান গাইবো।
– সেতো প্রতি বছর হয়।  তোর এত সুন্দর গলার জন্য তোকে ছাড়া এই অনুষ্ঠান হয়ই না।
– আচ্ছা ঠিক আছে আর মেয়ের গুনোগান করতে হবে না, আচ্ছা মা এবারে কে এসে বললো আমাকে গান গাইতে হবে?
– প্রতিবার যে বলে, অয়ন, ওকে বললাম তোর সাথে দেখা করে যেতে, কিন্তু ও বললো ওর অনেক  কাজ, খালি বললো অদিতিকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসবেন।
– ও

অদিতি ভাবতে লাগলো অয়নকে আর আগের মতো পাড়ায় দেখতে পাওয়া যায় না, কিছু মাস যাবত আমাকে দেখলেই কেমন যেন লুকিয়ে যায়। অদিতির এক বছর আগের কথা হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল। ছোটবেলাকার বন্ধু হলেও অয়ন আমাকে বন্ধু হিসাবে দেখে, কিন্তু  আমি যেন অয়নকে আস্তে আস্তে ভালোবেসে ফেলেছিলাম, কোনদিন হয়তো বলতে পারিনি। একদিন হঠাৎ করে অয়নই একটা কথা আমাকে বললো,
– অদিতি তোকে আমার কিছু একটা কথা বলার আছে।
– বল না
-আমি ভালোবেসে ফেলেছি।

শোনা মাত্র অদিতির সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। মন থেকে ভেবেই বসলো অয়ন আমাকে ছাড়া আর কাকে ভালোবাসবে, ভালোবাসার মানুষটি কে সেটা না জিজ্ঞেস করেই অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে অদিতি সেখান থেকে ছুটে পালায়।

অয়ন ডাকে- ওরে শোন চলে গেলি কেন?
পরের দিন অয়নের ফোন,
– হ্যাঁ বল
– হ্যাঁ,রে তুই গতকাল অমন করে চলে গেলি কেন?  আমার একটা জরুরী কথা বলার ছিল।
-( লজ্জা পেয়ে )না মানে, কি জরুরী কথা
– শোন আজ একবার কফিশপে আসতে পারবি পাঁচটার সময়।
– আচ্ছা
কফিশপে অয়ন ডেকেছে। শোনা মাত্র অদিতির আর তর সইছে না। অয়নের প্রিয় রং লাল, আজকে লাল রঙের শাড়ি পড়ে খুব সাজবে সে।

যথাসময়ে কফিশপে পৌঁছিয়ে অদিতি দেখে অয়ন বসে আছে। অয়ন ডাকে,
-অদিতি এদিকে আয়।
অদিতি এসে সামনে দাঁড়াতে অয়ন অদিতিকে উপর থেকে নিচ অবধি পর্যবেক্ষণ করে বলে,
-ওরে বাবা তুই এতো সেজেছিস কেন আজকে? কোথাও যাবি?
-কেন আমাকে ভালো লাগছে না?
-ভালো লাগছে না মানে, তুই এত সুন্দরী, আমি চোখ ফেরাতে পারছি না, যাক গে ও আমার সুন্দরী এবার দয়া করে আসন গ্রহণ করুন।

অদ্ভুত এক আনন্দ হচ্ছে অদিতির। অদিতির ভাবনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে অয়ন বললো,
-এই শোন, তোর আজকে কি হয়েছে বলতো, কেমন লাজুক লাজুক লাগছে। যাই হোক আজকে আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। আজ একজন আসবে, আমি তোর সাথে তার আলাপ করাবো।
-কে আসবে?
-ঐ তো এসে গেছে।
অয়ন ডাকলো, শ্রেয়া এদিকে এসো।
অদিতি দেখলো জিন্স টপ পরা একটা স্মার্ট মেয়ে অয়নের ডাকে এদিকে এলো।
-হাই অয়ন
-হ্যালো, বসো শ্রেয়া। আলাপ করিয়ে দিই আমার ছোটবেলাকার বন্ধু অদিতি। তোকে এর কথাই বলছিলাম অদিতি। শ্রেয়া, মাই লাভ, আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।

বাকরুদ্ধ অদিতি আর একটা কথাও বলতে পারছে না। মনে হচ্ছিল সমস্ত সাজটা ঘষে ঘষে তুলে ফেলে। এক তীব্র অপমানের জ্বালা বুকে নিয়ে অদিতি বললো- তোমার সাথে আলাপ হয়ে বেশ ভালো লাগলো।  কিন্তু শ্রেয়া এই অয়ন খুবই দুষ্টু, সামলাতে পারবে তো। এই সব টুকটাক কথা বলে অদিতি বললো, আমাকে এবার উঠতে হবে, কাজ আছে।
-কাজ আছে মানে। আজকে তোর কিসের কাজ!

অবশেষে শ্রেয়া বললো- আচ্ছা অয়ন কাজ তো থাকতেই পারে, সব কথা কি তোমায় বলবে,  যেতে দাও ওকে।
-কিরে অদিতি বলিস নি তো তোর কাজ আছে।

একটু রেগে অদিতি বললো,সব কথা কি তোকে বলতে হবে? কাজ আছে তাই যাচ্ছি। তোরা গল্প কর।

তারপর নানা অছিলায় অদিতিই আর অয়নের সঙ্গে দেখা করে না। অয়ন রেগে যায়। কিন্তু অদিতি জানে ও অয়নকে দেখলেই দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই মায়াটা কাটাতে চায়। কিন্তু মায়া কাটানো অতই সহজ। অয়ন ঠিকই অদিতির সঙ্গে দেখা করে। কথা বলে,  কিন্তু অদিতির আর যেন ভালো লাগে না।

এইভাবে ছয় মাস কেটে গেল। একসময় অয়নই হঠাৎ করে দেখা সাক্ষাৎ কমিয়ে দেয়। অদিতি বুঝতে পারে না এর কারণ কি? ভাবতে লাগলো শ্রেয়ার সাথে কি কোনো ঝামেলা হল? দেখা করার চেষ্টা করলেও অয়নের টিকি পাওয়া যায় না।  যাইহোক অদিতিও ভাবে ভালোই হয়েছে। বছর শেষ হয়ে নতুন বছর উপস্থিত হল। হঠাৎ করে অদিতির ভাবনায় ছেদ পড়লো। মা এসে বলল, কিরে তুই কি ভাবছিস বলতো।  আধঘন্টা ধরে লক্ষ্য করছি লাল শাড়িটা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভেবেই যাচ্ছিস। কি ভাবছিস এত?

অদিতি বললো না যে এতক্ষণ ধরে সে আগের সব কথা ভাবছিল, অয়ন এইবার এসে বললো না গান গাইবার কথা, প্রতিবারই আসে, এসে বলে,
-গলাটা ঠিক রাখিস, ব্যাঙ ঢুকে যায় নি তো..
এবারে কি হলো কে জানে? যাই হোক কিছু একটা হয়েছে ওর।

সন্ধ্যাবেলা উপস্থিত, খুব সুন্দর করে সাজলো অদিতি।

যথাসময়ে জলসায় উপস্থিত হয়ে চার-পাঁচটা গান গাইলো, পুরো প্রোগ্রাম না দেখে অদিতি বেরিয়ে অয়নকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথায় ও। বর্ষবরণের দিনে অদিতির মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। প্রোগ্রাম আর  না দেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। চওড়া রাস্তা পার করে একটা বড় গলির মধ্যে অদিতির বাড়ি। সবাই যেহেতু জলসায় তাই গলিটা ফাঁকাই ছিল। হঠাৎ করে পেছন থেকে কে হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেল একটা বাড়ির নিচে। আচম্বিতে এমন ঘটনাটা ঘটে গেল যে অদিতি কি করবে বুঝতে না পেরে চেঁচাতে শুরু করলো।  অদিতি বললো চিৎকার করে- কে আপনি? ছাড়ুন বলছি আমাকে? এটা আমার পাড়া, এখানে লোক জড়ো হতে বেশি সময় লাগবে না। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল হঠাৎ করে চেনা কণ্ঠস্বর, চুপ কর, চুপ কর, চিল্লাস না।
-কে অয়ন? তো তুই এইভাবে?  এতদিন কি হয়েছিল তোর? আমার সঙ্গে দেখা করিস না? আজ জলসাতেও দেখলাম না? শ্রেয়া কোথায়? তোর সঙ্গে নেই?

হঠাৎ করেই অয়ন তার হাতটি দিয়ে অদিতির মুখটা ধরে বলে,
– চুপ কর, অনেক প্রশ্ন করছিস? এবার চুপ কর।
– এসব কি হচ্ছে অয়ন? রাস্তার মধ্যে মুখ চেপে ধরছিস।
– কি আবার করলাম, বেশি কথা বলছিস তাই মুখ চেপে ধরেছি। আর পারলাম না, বুঝেছিস? এতদিনে সব পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি।
-কি পরিষ্কার হয়েছে? কি বকছিস তুই? শ্রেয়ার সঙ্গে কিছু হয়েছে? আজ ও নেই কেন তোর সাথে?
-না রে, সত্যি বলতে কি  আমি তোকে বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবি নি কখনো। কিন্তু শ্রেয়ার আলাপ হওয়ার পর ওকে ভালো লেগেছিল, কিন্তু আমার গল্প ছিল ওর সাথে তোকে নিয়ে। শ্রেয়া বিরক্ত হয়ে শেষের দিকে বলেছিল -অদিতি তোমার, তুমি অদিতির। আমি মাঝখান থেকে ঢুকে পড়েছি। আমি ক’ মাস তোর সাথে দেখা করিনি তার একটা কারণ আছে। দেখছিলাম তোকে ছাড়া সত্যিই আমি থাকতে পারবো কি না, বুঝলাম- না, সত্যি পারছিনা রে।

এত কিছু শোনার পর অদিতির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
– যা, কি যা তা বলছিস। সব তোর পাগলামি।
– পাগলামি নয়, সত্যি। আমি এত বোকা যে আমি সেদিনও বুঝিনি তুই লাল শাড়িটা কেন পড়েছিলিস।আর আজকেও দেখ এই বর্ষবরণে তুই আমার প্রিয় রং লাল পরেছিস। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তোকে। কেন পরেছিস? আমার জন্যই তো? অদিতি আমাদের ছোটবেলাকার বন্ধুত্ব প্রাপ্তবয়স্কে প্রেমে পরিণত হয়েছে, আমরা বুঝতে পারি নি।

অদিতি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। বললো,
– ওরে আমি তোকে কবেই মন দিয়ে ফেলেছিলাম, তুই যখন শ্রেয়াকে নিয়ে এলি আমার ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। পারছিলাম না।
-চুপ কর, আমাকে ক্ষমা কর।

একগুচ্ছ গোলাপ প্যাকেট থেকে বার করে হাঁটু গেড়ে বসে অয়ন বললো,

” আজ এই বৈশাখে
নতুন বছরের শুভ ক্ষণে
পেলাম আমি তোমাকে আবার
নতুন করে নতুন ভাবে।
তুমিই আমার সখী, তুমিই আমার প্রিয়ে,
নতুন বছরে ঘর বাঁধবো
নতুন গানের সুরে।”
শুভ নববর্ষ অদিতি, আমাকে গ্রহণ কর।
শুভ নববর্ষ অয়ন, গ্রহণ করলাম।।

Loading

Leave A Comment