Site icon আলাপী মন

গল্প- জীবনের জলছবি

জীবনের জলছবি
জয়তী মিত্র

 

 

শিমূল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার রঙে নিজেকে রাঙিয়ে, কোকিলের কুহু সুরে মুখরিত হয়ে বসন্ত এসেছে। বারান্দার পলাশ গাছটা লালে লাল হয়ে গেছে। পাশে আমের গাছটার মুকুলের একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতির এই শোভা দেখেতে দেখতে রঞ্জনার মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল।
অসীম চলে গেছে আজ বছর তিন হলো। রঞ্জনার জীবনের সব রঙ নিয়ে সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। রঞ্জনা আজ একা। একমাত্র ছেলে অর্ণব প্রবাসে চাকরী করে। মাঝে মাঝে আসে। রঞ্জনাও ছেলের কাছে গিয়ে থাকে। কিন্তু সেখানে তার মন টেকে না। আসলে নিজের ঘর, বাড়ি ছেড়ে বেশিদিন অন্য কোথাও থাকতে ভালো লাগে না। আবার বাড়ীতেও একা থাকা যায় না। তাই একজন চব্বিশ ঘণ্টার মহিলাকে রেখেছে রঞ্জনা। মালতীরও কোনো পিছু টান নেই। সে রঞ্জনার সাথে বেশ আনন্দেই আছে। মালতীর সাথে গল্প করতে করতে রঞ্জনার মন চলে যায় সেই কিশোরী বেলার দিনগুলোতে।
বসন্তের এক বিকালে স্কুল থেকে ফেরার পথে পরিচয় অসীমের সাথে। পাশাপাশি দুটো পাড়ায় থাকত তারা। একই পথ দিয়ে যাতায়াত করতে করতে পরিচয়, তারপর ভালোলাগা। সেটা যে কখন ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে নিজেরাও বোঝে নি। রঞ্জনা তখন একাদশ শ্রেণীতে পড়ে, আর অসীম সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। দীর্ঘ পাঁচ বছর চলে তাদের প্রেমপর্ব। দুজনেই খুব রঙ খেলতে ভালোবাসত। তাদের ভালোবাসার একমাত্র সাক্ষী ছিল যাতায়াতের পথের ধারের কৃষ্ণচূড়া গাছটা। বসন্ত এলে কৃষ্ণচূড়া গাছটা নিজেকে লাল রঙে রাঙিয়ে নিত। গাছের তলায় দোলের দিন দুজনে খুব রঙ খেলতো।
তারপর অসীম কলেজ জীবন শেষ করে চাকরী জীবনে প্রবেশ করে। দুজনেই ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান। তাছাড়া অসীম সুদর্শন, সরকারী চাকুরে, তাই রঞ্জনার বাবা-মা তাদের বিয়েতে বাধা দেন নি।
রঞ্জনা ও সুন্দরী, শিক্ষিতা, গান জানে তাকে পুত্রবধূ করতে অসীমের বাবা-মায়েরও কোনো আপত্তি ছিল না। দুই বাড়ির সম্মতিতেই তাদের শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হলো।
রঞ্জনা বউ হয়ে এলো সেনগুপ্ত পরিবারে।অসীমরা দুই ভাই। ছোট ভাই সুমিত বছর তিনের ছোট অসীমের থেকে। শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী, দেওরকে নিয়ে সাজানো সংসার রঞ্জনার। বেশ সুখেই দিন কাটতে লাগলো তাদের। শাশুড়ি মায়ের কাছে রান্না, ঘরের যাবতীয় কাজ শিখে নিল রঞ্জনা। তার সুমধুর ব্যবহারে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রঞ্জনা সবার প্রিয় হয়ে উঠলো। শ্বশুর বাড়িতে এসে তার গানের চর্চা শুরু হল। শ্বশুর মশাই তাকে গানের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। শাশুড়ি মা তাকে গানের স্কুলে নিয়ে যেত। রঞ্জনা একেক সময় ভাবত সে অনেক ভাগ্যবতী, তাই এমন শ্বশুর বাড়ি পেয়েছে।
তারপর বিয়ের তিন বছরের মাথায় এলো তাদের পুত্র সন্তান। বাড়ীতে খুশির বন্যা বয়ে গেল। ছেলের নাম রাখা হলো অর্ণব। ঠাকুমা আর দাদু ডাকতেন রিভু বলে। মায়ের আর বাবার কাছে বাবাই। কাকাও আদর করে সোনা বলে ডাকতো। বাড়ির সকলের নয়নের মনি ছিল অর্ণব।
ছোট বেলা থেকে অর্ণব ওরফে রিভু’ও খুব দোল খেলতে ভালোবাসত। দোলের দিন ঠাকুমা-দাদুর পায়ে আবীর দিয়ে বাবা-মা, কাকার সাথে রঙ খেলতো। বালতিতে রঙ গুলে পিচকারি দিয়ে সবাইকে রঙ দিত। অসীম আর রঞ্জনা চলে যেত বারান্দার পাশের সেই পলাশ গাছটার নিচে। দুজনে লাল আবীর দিয়ে নিজেদের রাঙিয়ে নিত, ঠিক লাল পলাশের মত।
তারপর দেওর চাকরী জীবনে প্রবেশ করলো। দেওরের বিয়ে হলো দেখাশুনা করে। ছোট জা’কে নিজের বোনের মতো ভালোবাসত রঞ্জনা। শাশুড়ি মাও দুই বৌমার হাতে সংসারের ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। এইবার ঠিক করলেন দুই বুড়ো-বুড়ি তীর্থে যাবেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। একদিন সকালে হাঁটতে বেরিয়ে এক গাড়ীর ধাক্কায় প্রাণ হারান অসীমের বাবা। পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। শাশুড়ি মা শোক সহ্য করতে না পেরে কিছুদিন বাদে তিনিও চলে গেলেন। দুই ছেলে আর বৌমাদের তখন দিশেহারা অবস্থা। ক্রমে আস্তে আস্তে সেই শোক তারা কাটিয়ে উঠলো। এদিকে অর্ণবও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে প্রবাসে চলে গেল। রঞ্জনার হাতে সংসারের যাবতীয় ভার এসে পড়লো।
দেওরের ছিল বদলির চাকরী। সে তার পরিবার নিয়ে তার চাকরী স্থলে চলে গেল। আরো একা হয়ে গেল রঞ্জনা। অসীম সেই সকালে অফিস যেত আর সন্ধ্যায় ফিরতো। এত বড় বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করতো। সময় কাটানোর জন্য আবার গানের রেওয়াজ শুরু করলো রঞ্জনা। অসীমের খুব বাগানের শখ ছিল। সেই বাগানের গাছগুলো নিয়ে অনেকটা সময় কাটাতো রঞ্জনা।
অসীমের রিটায়ার করার সময় এল। পড়াশুনা শেষ করে ছেলেও প্রবাসেই চাকরী পেলো।
একদিন অফিস থেকে খবর আসে অসীম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে তার মৃত্যু হয় হার্টঅ্যাটাকে।
এক লহমায় রঞ্জনার জীবনটা ছারখার হয়ে যায়। শোকে পাথর হয়ে যায় রঞ্জনা। ছেলে এসে কাজকর্ম সব করে মাকে নিয়ে নিজের কাছে নিয়ে যায়। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্টটা বুকে চেপে রাখে রঞ্জনা। কিন্তু স্বামী হারানোর কষ্ট কি সহজে ভোলা যায়? ত্রিশ বছরের সংসার তাদের। একটু একটু করে সাজিয়েছিল। নিজের হাতে বাগান করেছিল স্বামী-স্ত্রী মিলে। কত রঙ, বেরঙের ফুল ফুটতো শীতকালে। বর্ষায় বেল ফুলের গন্ধে সারা বাড়ি ম ম করত। অসীম খুব প্রকৃতি প্রেমিক ছিল। তার সাজানো বাগানে প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধের সাথে একাত্ম হয়ে যেত তার মন। গ্রীষ্ম,বর্ষা, শরৎ, বসন্ত ইত্যাদি নানা ঋতুতে নানা রকমের ফুল গাছ লাগতো অসীম। বাড়িতে একটা নার্সারির মত বানিয়েছিল।
বসন্ত এলে আমগাছের ডালে কোকিলের কুহু সুরে বাড়ি মেতে থাকতো।
অসীম চলে যাবার পর ছেলের কাছে কিছুদিন কাটিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল রঞ্জনা গাছগুলোর টানে। বাগানটাতে গেলেই সে অসীমের স্পর্শ অনুভব করতো। গাছগুলোর মধ্যেই যে অসীম বেঁচে রয়েছে। প্রতিদিন সকাল, সন্ধ্যা গাছগুলোর পরিচর্যা করতো রঞ্জনা। গাছেদের সাথে খুব ভালো সময় কাটত রঞ্জনার। তার সাথে সঙ্গী ছিল রঞ্জনার কাজের মাসি মালতী।

অসীম চলে যাবার পর দোলের দিনটা মালতীর সাথে বাগানের ফুল গাছগুলো নিয়ে সময় কাটাত রঞ্জনা। মনে হতো এই বাগানেই অসীম তার জন্য রঙ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে নানা রঙে সাজিয়ে দেবার জন্য।

এইবার দোলের দিন রাধাকৃষ্ণের পূজো দিয়ে অসীমের ফটোতে একটু লাল আবীর ছোঁয়ালো রঞ্জনা। তারপর বাগানের পলাশ গাছটার দিকে তাকিয়ে পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগল। ঠিক সেই সময় দুই হাত ভর্তি রঙ দিয়ে পেছন থেকে মালতী রঞ্জনার দুই গাল রাঙিয়ে দিল।
রঞ্জনা বললো, “একি করছো মালতী, আমি যে বিধবা। আমার যে রঙ খেলতে নেই গো। রঙ ধুতে ঘরে এসে রঞ্জনা অসীমের ছবির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অসীমের মুখটা আজ কি উজ্জ্বল লাগছে। মনে হল অসীম বলছে,”আমি তো মালতীর হাত দিয়ে তোমাকে আবীর দিলাম, কে বললো তুমি বিধবা? আমি তো তোমার সাথেই আছি সব সময়। দেখ তোমায় রঙ মাখতে দেখে পলাশ ফুল ও তার পাপড়ি মেলে ধরেছে।”

রঞ্জনা অসীমের ফটোটা নিয়ে ছুটে গিয়ে পলাশ গাছের নিচে রেখে টলাল আবীর দিয়ে ভরিয়ে দিল। আজ রঞ্জনার মনে হল সত্যিই আবার তাদের সেই হারানো বসন্ত ফিরে এসেছে। মনটা আনন্দে ভরে গেলো রঞ্জনার।

Exit mobile version