Site icon আলাপী মন

গল্প- ঠিক আছে

ঠিক আছে
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

দীপালি জলযোগের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল মিতালী। দীপালি জলযোগের সুস্বাদু সিঙ্গাড়গুলো দেখে মনটা কেমন আনচান করতে শুরু করলো আজ।
দুই বছর আগে প্রায়ই সন্ধ্যা বেলায় দীপালি জলযোগ থেকে আসতো গরম গরম সিঙ্গাড়া। ছোট চায়ের কাপে চা খেয়ে ঠিক পোষায় না মিতালীর। তাই বড় কফি মগে ভর্তি ভর্তি চা নিয়ে সিঙ্গাড়া দিয়ে মুড়ি মেখে কি জমিয়ে আড্ডা মারতো বুলা কাকিমার সঙ্গে।

বুলা কাকিমার সঙ্গে মিতালীর বয়সের তফাত যথেষ্ট। তবুও সেই প্রথম দর্শনের দিন থেকেই বেশ ভাব হয়েছিল দুজনের।

মিতালী তার পতি পরমেশ্বর আলোককে নিয়ে ফ্ল্যাট দেখতে এসেছিল এয়ারপোর্ট চত্বরে ।আলোক তো মুখটা’কে বাংলার পাঁচের মতো করেই এসেছিল সেদিন। আসলে আলোকের ফ্ল্যাট বাড়ি মোটেই পছন্দ নয়। পায়রার খোপের মতো অবস্থা।এদিক ওদিক চড়ে বেরিয়ে সময় হলে নির্দিষ্ট খোপে ঢুকে পড়া ।আর অন্য কারোর সঙ্গে মুখ দেখাদেখি নেই।
তার ওপর কার্পেট এড়িয়াটুকুই নিজের। নিজের ফ্ল্যাটের সামনে নিজের জুতো জোড়া রাখতে গেলেও ওপরের সুবিধা অসুবিধার কথা ভাবতে হবে। এক কথায় এক কাঁড়ি পয়সা খরচ করে আজীবন ঝুটঝামেলা মাথায় নেওয়া।

যদিও আলোকের এই সব মনগড়া অপ্রাসঙ্গিক যুক্তিকে মোটেই আমল দিতে রাজি নয় মিতালী। কলকাতার বাজারে একফালি শক্ত পোক্ত কংক্রিটের ছাদ তো পাওয়া যাবে। সমাজ সংসারে টিকে থাকতে গেলে মানিয়ে চলতে তো হবেই। সে তুমি নিজের বাড়ি বানিয়ে থাকো কিংবা ফ্ল্যাট বাড়ি কিনে থাকো।
তবে মিতালীর ফ্ল্যাট বুকিং করতে এসেই বুলা কাকিমার সঙ্গে আলাপ হয়ে বড় ভালো লেগেছিল।
বুলা কাকিমার স্বামী সুনীল কাকু সবে মাত্র রিটায়ারমেন্ট নিয়েছে PWD এর অফিস থেকে। স্থুলকায় চেহারার মানুষটাকেও বেশ লেগেছিল মিতালীর। প্রতিটি কথার শেষে উনি কেন ‘ঠিক আছে’ শব্দটার ব্যবহার করেন তা বুঝতে মিতালীর সময় লেগেছিল বেশ।

বুলা কাকিমা প্রথম আলাপেই মিতালীকে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের সন্তান কয় টি গো?
মিতালী বলেছিল, আমার একটি মেয়ে কাকিমা। এই ক্লাস ফোরে পড়ে।
বুলা কাকিমা একগাল হাসি দিয়ে বলে, এখনও সময় আছে আরেকটা ইস্যু নিয়ে নাও। আমাদের কোলে পিঠে বড় হয়ে যাবে। আমার ছেলের তো বিয়ে দেওয়ার বয়স হয়ে গেল। এখনও সেই রকম কোনো পার্মানেন্ট কাজ জোটাতে পারে নি বলে বিয়েটা দিচ্ছি না।
পাশেই ছিলেন বুলা কাকিমার স্বামী সুনীল কাকু উনি বললেন, যা চাকরি বাকরির অবস্থা ছেলের বিয়ে থাওয়া আর দিতে হবে না। এই কথাটা শেষ করেই উনি ওনার স্বভাব সিদ্ধ বাক্য ‘ঠি…ক আছে’,’ঠিক আছে’ উচ্চারণ করলেন।
মিতালী অবাক হয়ে সুনীল কাকুর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। আজীবন ছেলে আইবুড়ো থেকে যাবে। আর উনি বলছেন ঠিক আছে। আশ্চর্য! কিছুতেই মিতালীর মাথায় ঢুকলো না কেন সুনীল কাকু ঠিক আছে কথাটা বললেন।

ফ্ল্যাট বুক করার দেড় বছরের মধ্যে প্রমোটার রেডি ফ্ল্যাট হ্যান্ডওভার করলেন। কাকতালীয় ভাবে মিতালী ও বুলা কাকিমা তাদের গৃহপ্রবেশের দিন একদিনেই স্থির করেছিল।
পাশাপাশি ফ্ল্যাট হওয়ার সুবাদে এটা ওটার প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে আসা যাওয়ার মাত্রাও ছিল বেশি।
মিতালীর মেয়ে তুলতুলি ফাঁক পেলেই বুলা কাকিমার ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হতো। দুই তিন মাসের মধ্যে এই দুই পরিবারের মধ্যে এমন ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল যে গোটা এ্যাপার্টমেন্টের সকলের কাছে ঈর্ষার বিষয় ছিল।
তবে একটা চিরসত্য বোধহয় মিতালী ভুলে গিয়েছিল, যেখানেই অতি সেখানেই ক্ষতি। আসলে মিতালী একদম নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির মেয়ে হলেও লোকজন তার বড্ড প্রিয়। মিলেমিশে থাকার যে সুপ্ত বাসনা তার মধ্যে ছিল সেটা বুলা কাকিমাদের পেয়ে বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হয়।
বেশ কাটছিল দিনগুলো। বুলা কাকিমা কচুশাক, কচুলতি, লইটে মাছ, শুঁটকি মাছ এইসব বানিয়ে একেবারে গরম গরম নিয়ে ছুটে আসতো আলোকের জন্য।
মিতালীরা এদেশীয়। আলু পোস্ত, মাছের ঝোল খেতে ও রান্না করতেই ভালোবাসে।বুলা কাকিমার হাতের বাঙাল রান্না খেয়ে আলোক যে ভাবে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতো তা দেখে বাধ্য হয়ে মিতালীকে লইটে মাছ, কচুশাক, কচুলতি সবই শিখতে হয়েছিল।
সেবার তো মিতালী বাপের বাড়ি গিয়ে ওর ভাই, বাবা সকলকে লইটে মাছ রান্না করে খাইয়ে বিশাল সুনাম কুড়িয়ে ছিল। মিতালী কিন্তু মুখে ও মনে মনে সবসময় বুলা কাকিমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতো তাকে এই সব রান্না শিখিয়ে দেওয়ার জন্য।

কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই সামান্য ‘ঠিক আছে’ বাক্যকে কেন্দ্র করে বুলা কাকিমদের সঙ্গে মনকষাকষি শুরু হলো মিতালীর। আসলে বিষয়টা ছিল অতি সামান্য।

তুলতুলি খেলতে খেলতে পা পিছলে পড়ে যায় সিঁড়ি থেকে। মাথা ফেটে রক্ত গঙ্গা বইতে শুরু করে। সিকিউরিটির হাঁকডাকে ছুটে আসে সুনীল কাকুও। মিতালী কিছু বরফের টুকরোকে একটা কাপড়ে বেঁধে তুলতুলিরর কপালে রাখার চেষ্টা করছে।
যন্ত্রণায় কাতর তুলতুলি বারবার হাত দিয়ে বরফের পুঁটলিটা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। মিতালী তুলতুলিকে বকতে গেলে বুলা কাকিমা বলে, ছোট ছেলে এইরকম তো করবেই। তুমি জোর করে বরফের সেঁকটা দাও। তোমার কাকুকে আমি রিকশা ডেকে আনতে বলছি।
সুনীল কাকু কিছুক্ষণের মধ্যেই রিকশা ডেকে নিয়ে আসে। মিতালীর সাথে বুলা কাকিমাও ডাক্তারের কাছে যায়। তুলতুলির কপালে তিনখানা স্টিচ পড়ে। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছে তুলতুলি।
ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে এসে বুলা কাকিমার মুখে সুনীল কাকু সব শুনে বলে, মেয়ে যে খুব দূরন্ত। সারাদিন ছুটে বেরানো চাই। এখন দেখো কি রকম বিপত্তি ঘটলো। ঠি…কি আছে, ঠিক আছে। এই’ ঠিক আছে’ শব্দটা শুনে মিতালী খুব কষ্ট পায়। ওর মেয়ে পড়ে গিয়ে কপাল ফাটিয়ে ফেললো, স্টিচ পড়লো। এইসব কথা জানা সত্ত্বেও উনি কিভাবে ঠিক আছে বললেন! আসলে ‘ঠিক আছে’ শব্দটা সুনীল কাকুর মুদ্রাদোষ এটা জানা সত্ত্বেও সেই মুহুর্তে মিতালীর মাথায় অন্য চিন্তা ভাবনা ঢুকলো। মিতালীর মনে হল, সুনীল কাকু ওনার মেয়ের কষ্ট দেখে মনে মনে আনন্দই পেয়েছেন।
আর এই ভুল ভাবনার ওপর ভর করে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। একটু একটু করে কথাবার্তা, আসাযাওয়া, দেওয়া-নেওয়া কমতে থাকে।
দেখতে দেখতে দু’টো বছর হয়ে গেল মিতালীদের সাথে কথা বন্ধ বুলা কাকিমাদের। কখনো সখনো সামনা সামনি হয়ে গেলে মিতালীই চোখ নামিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তুলতুলির শিশু মনও বুঝে গেছে যে ওদের বাড়ি যেতে নেই। যদিও আলোক প্রয়োজন পড়লে কথা বলে।
এই দুই বছরে মিতালীর মনের অভিমানের পাথরখানি অনেক খানি ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে। সুনীল কাকুর ‘ঠিক আছে’ শব্দটা কেবলমাত্র কথার কথা। এই ঠিক আছে শব্দটাকে সর্বক্ষেত্রে মেনে নেওয়া উচিত এটা মিতালী বুঝতে পেরেছে।
তাই আজ পয়লা বৈশাখের দিন দীপালি জলযোগের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মিতালীর মনে হলো অনেক দিন তো হলো বুলা কাকিমদের সঙ্গে মান অভিমানের পালা। এই নতুন বছরে মান অভিমানের পালা বন্ধ করে আবার দুই প্রতিবেশী এক হয়ে গেলে মন্দ হয় না।
সুনীল কাকু দীপালি জলযোগের সিঙাড়া খেতে বড় ভালোবাসেন ।তাই কিন্তু কিন্তু করে মনের দ্বিধাকে দূরে সরিয়ে দশ পিস সিঙাড়া ও দশ পিস রসগোল্লা কিনে তুলতুলির হাত ধরে আবাসনে ফিরে এল। লিফ্টের দরজাটা খুলতে খুলতে ভেবে চলেছে, কি বলবে সে বুলা কাকিমার ঘরে গিয়ে।
যথারীতি লিফ্ট এসে দাঁড়ালো থার্ড ফ্লোরে। লিফ্ট থেকে নেমে তুলতুলির হাতে রসগোল্লার প্যাকেটখানা দিয়ে বুলা কাকিমার ডোর বেলটা টিপলো মিতালী। বুকটা তার ধরাস ধরাস করছে। মনে হলো হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে প্রচন্ড মাত্রায়। যদি বুলা কাকিমারা সেভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার না করে। তাহলে সেধে অপমানিত হতে হবে।
এইরকম সাত পাঁচ ভাবনা যখন মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তখনই দরজা খুলে সামনে দাঁড়ায় বুলা কাকিমা।
একগাল হাসি দিয়ে বলে, এসো এসো। ভিতরে এসো। তোমাদের কথাই হচ্ছিলো। ভাবছিলাম তোমাদেরকে ডেকে পাঠাবো।তার মধ্যেই তোমরা এসে হাজির।
মিতালীর কি রকম স্বপ্নের মতো লাগছে। আস্তে আস্তে বলে, আপনি কাকিমা আমার কথা ভাবছিলেন। আশ্চর্য!
ভিতরে ড্রয়িং রুম থেকে সুনীল কাকু বলে, এসো এসো মিতালী। দীপালি জলযোগের সিঙাড়া ঠান্ডা হয়ে গেল, ঠিক আছে।
মনের সব জড়তা কাটিয়ে মিতালী ড্রয়িং রুমে ঢুকে অবাক। একি কাকে দেখছে! সুনীল কাকুর পাশে বসে আলোক টমেটো সস দিয়ে দিব্য গরম গরম সিঙ্গাড়া খেয়ে চলেছে।
মিতালীকে দেখে আলোক মুচকি হেসে বলে, কি গো তোমার হাতেও কি সিঙাড়ার প্যাকেট?
বুলা কাকিমা বলে, এতো সিঙাড়া একসাথে খাওয়া ঠিক হবে না কিন্তু।

সুনীল কাকু বলে, দাও তো আজ মন খুলে সিঙাড়া খেতে, ঠিক আছে। দরকার পরলে ওষুধ খেয়ে নেওয়া যাবে, ঠিক আছে। কতদিন বাদে আমরা আবার একসাথে বসে সিঙাড়া খাচ্ছি বলো তো, ঠিক আছে। হোই না আজ একটু লাগাম ছাড়া, ঠিক আছে..

আজ সবাই সুনীল কাকুর মুদ্রাদোষ ঠিক আছে কে আপন করে নিয়ে প্লুতস্বরে বলে ওঠে, একদম ঠিক আছে…………

Exit mobile version