ভালোবাসো তো?
-শম্পা সাহা
“সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান কোরো না তো !ওই এক কথা শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছেে! অন্য কোনো কথা থাকলে বলো!’
রাহুলের ধরা হাতখানা যেন নিজে থেকেই শিথিল হয়ে আসে! যে আবেগে সোমা রাহুলকে ডেকেছিল সে আবেগটাতো গেলোই সঙ্গে দিয়ে গেল একরাশ বাড়তি মনখারাপ!
সোমার এই এক দোষ। পড়াশোনায় ভালো, দেখতে শুনতে ভালো, ওকে রাহুল নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। সবই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু সোমা যেন বাস্তবের বদলে কল্পনার জগতেই থাকে বেশি।
বছর পাঁচেক হলেও এখনো রাহুল বাচ্চা নিতে রাজি নয়। “এই তো সবে কেরিয়ারের শুরু এখনই ওসব ঝামেলা আমার দরকার নেই বাবা, আগে একটু সেটল হই!”
এই বক্তব্যে সোমার মত বা অমত কোনোটাই নেই। আসলে ও বরাবরই এরকম গা ছাড়া! সংসার যে করে তাতেও যেন নিজেকে জড়ায় না কোনোভাবেই। ও কোনোদিকে তাকিয়ে থাকলেও আসলে যেন দেখে না কিছুই। ওর চোখ দুটো যেন নাগালের সব কিছু পার করে অন্য কোনো কিছু খুঁজে বেড়ায়!কিন্তু কি? সেটা হয়তো ও নিজেও জানে না!
রাহুলের নিজের ব্যস্ততা কাটিয়ে যেটুকু সময় পায় তাতে সোমাকে খুশি রাখবার চেষ্টা করে। বেড়াতে নিয়ে যায় উইক এন্ডে বা শনিবার সন্ধ্যায় কোনো রেস্তোরাঁয়! সোমা যায় কিন্তু যেন ও ওখানে থেকেও নেই। আসলে ভীষণ এক শূণ্যতা, যেটা ওকে ধীরে ধীরে গ্ৰাস করছে! তা ও ভালোই বোঝে!
বিয়ের পর পর চাকরিটা ও ছাড়তে চায় নি। কিন্তু শাশুড়ির মা বয়স হয়েছে একা সংসার সামলাতে পারবেন না এবং “কটা টাকাই বা মাইনে পাও?” এ অজুহাতে সেটা ছেড়ে একেবারেই বাড়িতে বসে।
বাবা মা এক ধাক্বায় দুজনেই যখন এক দিনের তফাতে মারা গেলেন, মাত্র দুদিনের জ্বরে তখন এ চাকরিটাই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আর পাশে ছিল বড় মামা মামী। তাই ওনাদের আনা সম্বন্ধ ও ফেলতে পারে নি, রাজি হয়েছিল বিয়েতে!
ওকে নিয়ে রাহুলের এমনি কোনো সমস্যা নেই কারণ যে স্ত্রীর চাহিদা নেই সে তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মত। কিন্তু ওর এতোটা নির্লিপ্ততাও ভালো লাগে না। ভালো কোনো গিফট দিলে, ভালো কোনো জায়গায় বেড়াতে নিয়ে গেলেও ওর অভিব্যক্তি একই রকম থাকে। ও খুশি হয়েছে,, না ওর খারাপ লাগছে তা মোটেই বোঝা যায় না!
প্রথম প্রথম রাহুল ভাবতো সোমার বোধহয় ওকে পছন্দ নয় বা অন্য কাউকে ও ভালোবাসে। কিন্তু না- গত পাঁচ বছরে যে মেয়ে একা কোথাও যেতে চায় না, তার আবার প্রেম ট্রেম কি? বরং সে দিক থেকে রাহুল অনেক বেশি অ্যাক্টিভ। ওর এখনো বেশ কয়েকজন বান্ধবী রয়েছে। যারা প্রত্যেকে জানে ও বিবাহিত! সব জেনেও ওরা ডেটিং এ যায়, দেখা করে! সে অবশ্য সোমাকে না জানিয়ে। যদিও জানলেই যে সোমা আপত্তি করবে বা রাহুল তাতে খুব একটা বিচলিত হবে এমন নয়! কিন্তু তবু, সব খোলামেলা হলে মজা কোথায়? তা ছাড়া একটু আধটু মাইন্ড ফ্রেশ রাখারও তো দরকার।
“সোমার তো কোনো অভাব রাখিনি”, রাহুল নিজেকে ক্লিন চীট দেয়।
শুধু সোমা মাঝে মাঝে ওই বিরক্তিকর প্রশ্নটা করে? “তুমি আমায় ভালোবাসো?” গত পাঁচ বছরে প্রায় প্রতিদিন একবার হলেও সোমা এই প্রশ্নটা করে!
“কেন বাসবো না?” বা,” না, অন্য কাউকে ভালোবাসি”, এইসব বলে রাহুল বেশ মজার ছলেই উত্তর দিতো।
কিন্তু আজকাল আর ভালো লাগে না। একঘেয়ে প্রশ্ন কেন করে ও? পাগল নাকি? মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, মেয়েটার মাথার গন্ডগোল নেই তো ?কিন্তু এই এক প্রশ্ন বাদে সোমা পারফেক্ট বৌ। একেবারে শো পিস। কোনো ট্যা ফোঁ নেই, সুন্দর, প্রেসেন্টেবল! কিন্তু কেন যে ও এই এক প্রশ্ন বার বার করে?
যখন অদ্ভূত চাহনিতে ওর দিকে তাকিয়ে মেয়েটা প্রশ্নটা করে,মনে হয় যেন বুকের ভেতরটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে রাহুলের। ওর ভীষণ রাগ হয় আজকাল! রেগে যায়, চিৎকার করে, “এক প্রশ্ন বার বার করো কেন?”,
“তুমি যে নিজে থেকে কোনোদিন বলো না!” ওই একঘেয়ে সুরে বলে ওই এক্সরের মত দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটা। রাগে মাথার ভেতরটা দপদপ করে রাহুলের, ছিটকে চলে যায় সামনে থেকে।
কিন্তু না, কোনো রাগ নেই, ঝাল নেই, অভিমান নেই! কদিন বাদেই মেয়েটা ওই একই প্রশ্ন করে আবারও! কেন? কেন? কেন? “এই প্রশ্ন করার জন্য কি ডিভোর্স চাওয়া যায়?” ভাবে রাহুল!
গভীর রাত! ঘরে একটা হাল্কা নীল আলো ,বোঝা যায় মোবাইল স্ক্রিনের আলো! এক নারীমুর্তি চেয়ে আছে মোবাইলের স্ত্রিনে। নির্লিপ্ত চোখে দেখছে নানা ভালোবাসার স্বীকৃতি, ভালোবাসার প্রকাশ নানা ভাবে, নানা শব্দে, নানা ঠিকানায়! পাশে এক পুরুষ গভীর ঘুমে আছন্ন!