বাদলদিনের হারানো স্মৃতি
-সঞ্জিত মণ্ডল
আমাদের সবার প্রিয় কবিগুরুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ও স্মরণ করে, এক পুরানো স্মৃতির খাতার পাতা খুলি। গড়িয়াহাটের যে তল্লাটে নমস্য গায়িকা সুচিত্রা মিত্রের বাসস্থান, আমার অফিস তারই কাছাকাছি। বড় জমজমাট জায়গা। নানা কর্মসূচির মহড়া চলতে থাকে সেখানে প্রতি নিয়ত, তার বেশীর ভাগই হয় রাজনৈতিক নয় সাংস্কৃতিক।
মনে পড়ে, সে দিনটা ছিল, ঝরো ঝরো মুখরিত বাদলের দিন। বৃষ্টির জন্য হোক অথবা মাসের শেষ বলে হোক, অফিসে গ্রাহক সংখ্যা খুবই কম। কাঁচের জানালার বাইরে বৃষ্টিস্নাত দিন দেখতে দেখতে মন মোর মেঘের সঙ্গী। কারো বা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে, কারো বা খোলা আকাশের নীচে ভিজতে ভিজতে বৃষ্টি দেখায় এক অনির্বচনীয় স্বর্গীয় সুখানুভূতি হয়। বৃষ্টি দেখতে ভালোবাসেনা, এমন বাঙালী আছে কিনা জানিনা। থাকলেও তাদের সংখ্যা হয়তো নিতান্তই কম।
আমিও বাঙালি, তন্ময় হয়ে বৃষ্টি দেখছি। ঝাপসা বেলার আবছায়াতে দেখছি আমি চেয়ে, থমথমে মেঘ ভিড় করেছে সারা আকাশ ছেয়ে। কেয়াতলার সুউচ্চ অট্টালিকা যেমন আর রবীন্দ্র সরোবরের গাছগাছালিও তেমন, সবই মনে হচ্ছে, ধোঁয়া, ধোঁয়া, ধোঁয়া। সইতে পারিনা, কথা কইতে পারিনা, ব্যথা ভুলতে পারিনা বৃষ্টিতে।
এই অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরার বেলায় মন আমার প্রজাপতি হয়ে শুধুই তোমাকে চায়। মনে মনে বলি তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকেই চাই, তোমাকেই চেয়েছি প্রিয়তমা। এখানেই, এই অফিসেই, যদি চলে আসো, গুটি গুটি পায়ে, পারলে ভেজাবো তোমায় আপন মনে। মনে হয় আজিকার এমন বাদল দিনে, তোমার হৃদয়খানি পারবো আমি নিতে জিনে।
এমনই স্বপ্নময়তার মাঝে শ্রীমতী সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত গান ভেসে আসে-
“আমি শ্রাবণ আকাশে ওই দিয়েছি পাতি
মম জল-ছলো-ছলো আঁখি মেঘে মেঘে।
বিরহদিগন্ত পারায়ে সারা রাতি অনিমেষে আছে জেগে।।
যে গিয়েছে দেখার বাহিরে আছি তারি উদ্দেশে চাহি রে,
স্বপ্নে উড়িছে তারি কেশরাশি পুরবপবনবেগে।।
শ্যামল তমালবনে
যে পথে সে চলে গিয়েছিল বিদায়গোধূলি-খনে
বেদনা জড়ায়ে আছে তারি ঘাসে, কাঁপে নিঃশ্বাসে–
সেই বারে বারে ফিরে ফিরে চাওয়া ছায়ায় রয়েছে লেগে।।”
আমি স্তব্ধ। “যেন কোন শৈলশিখর পারে, এক ঝাঁক বুনোহাঁস পথ হারালো!!
একা একা বসে আছি জানালা পাশে,
সে কি আসে আমি যারে বেসেছি ভালো।।”
চমকের এখানেই শেষ নয়, বিশেষ করে আজকের দিনে তা তো হবার নয়। আমার ভাঙা হৃদয়ের দখিন দুয়ারে হলো সোনালির উদয়। আমার মনের গহীনে সে এক তোলপাড় করে ঢেউ তুলে দিয়ে ডুব দিয়ে গেছে বিস্মৃতিচারণায়। সে কথা লিখেছি আমি মনোজোছনায়, চৈত্রপবনে, আমারই লেখা নীল দিগন্তে নামে লেখা বইখানায়।
সোনালি তার নাম।
সেদিনও ছিল ঝিরঝিরে হালকা বৃষ্টি মুখরিত দিন। ক্লাস টেন-এ পড়ি তখন, কোচিং-এর পড়া সেরে ফিরছি যখন। দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে, কদম গাছের নীচে। বলি তাকে ডেকে, কি হল গো মেয়ে, কেন তুমি অমন করে আছো চেয়ে নীপবীথির পানে। বলো নাগো কিসের মায়ায়? আমার কাব্য করা কথায়, মাথা নীচু করে বলেছিল সে, দুটো কদম ফুল পেড়ে দেবে আমায়? দ্বিরুক্তি করিনিকো আমি, ভিজে গাছে চড়ে, তিনটে ফুল পেড়ে তার হাতে দিয়েছিলাম তুলে।
মাথা নীচু করেই বলেছিল সে, বড় তিনটে যে দিলে? বলেছিলাম ডেকে, দুটো চেয়েছিলে, দুটোই না হয় নিলে, তৃতীয়টা ফিরে তুমি দেবে আমাকেই। ওতে লেগে থাকবে তোমার হাতের পরশ। বাড়ি ফিরে তোমার দেওয়া ফুলের পরশ মাখবো সারা গায়ে। লাল হয়ে উঠছিলো তার কপোল, মৃদু হেসে বলেছিলো, আমায় পরশ পেলে কি এমন সুখ পাও! সত্যি চাও তো বলো, নিজেকেই পুরো দিয়ে দেবো তোমায়। বলেছিলাম হেসে, আজকে শুধু পরশটুকুই দাও। কি আশ্চর্য চারিদিকে চেয়ে দেখে আমার বুকে মাথাটি তার রেখে সলাজ চোখে মুখের পানে চেয়ে বলেছিল, একটা চুম্বন দাও, তুমি একটা চুম্বন দাও।
আর কিছু নয়, সেই প্রথম সেই শেষ। শুনেছি অনেক পরে, ওরা চলে গেছে মামার বাড়ির দেশে। আজ তবু মনে হয়, যে ছিল স্বপন চারিণী, তারে ভুলিতে পারিনি। যেন কোন স্বপ্ন মায়ায় আজও ব্যথাভরা বুকে ভাবি, বড় হয়ে গিয়ে সোনালিরা সব কোথায় যে হারিয়ে যায়, প্রাণপণ খুঁজে আজও পাইনি আমি তোমায়।
মনে মনে আমি কবিগুরুকেই আনি, গুনগুন করে গাই,
“কোন পুরাতন প্রাণের টানে
ছুটেছে মন মাটির পানে।।
চোখ ডুবে যায় নবীন ঘাসে, ভাবনা ভাসে পুব-বাতাসে-
মল্লারগান প্লাবন জাগায় মনের মধ্যে শ্রাবণ- গানে।।
লাগল সে দোল বনের মাঝে
অঙ্গে সে মোর দেয় দোলা যে।
যে বাণী ওই ধানের ক্ষেতে আকুল হলো অঙ্কুরেতে
আজ এই মেঘের শ্যামল মায়ায়
সেই বাণী মোর সুরে আনে।।”
থাক, সেদিনের কথাখানি। কবিগুরুর গানের রেশ টানি। কাকে নাকি বলেছিলেন তিনি, যখন তোমার গলায় আমার গান শুনি, মনে হয় গানখানি তোমাকেই দেখে লিখেছি যেন আমি। আর, আমরা তো জানি, তাঁর কত শত গান যেন অমর লেখনী। তবু তারও মাঝে মনে হয়, বরষার গানগুলি রূপে রসে গন্ধে বারিতে অন্তত আমার কাছে শ্রেষ্ঠ সুনিশ্চয়। যে গান শুনলে পরে জুড়ায় দেহ মন, জুড়ায় পরাণ, ভালোবাসি বড় ভালো লাগে বিশ্ব বন্দিত রবিকবির গান। আজও বৃষ্টি পড়লেই মনে হয়,
“চিত্ত আমার হারালো আজ মেঘের মাঝখানে–
কোথায় ছুটে চলেছে সে কোথায় কে জানে।।
বিজুলি তার বীণার তারে আঘাত করে বারে বারে,
বুকের মাঝে বজ্র বাজে কী মহাতানে।।
পুঞ্জ পুঞ্জ ভারে ভারে নিবিড় নীল অন্ধকারে
জড়ালো রে অঙ্গ আমার, ছড়ালো প্রাণে।
পাগল হাওয়া নৃত্যে মাতি হল আমার সাথের সাথি-
অট্ট হাসে ধায় কোথা সে, বারণ না মানে।।”
বাদল দিনের হারানো স্মৃতিকথা আপাতত এখানেই ইতি টানলাম।
আমার আন্তরিক ধন্যবাদ আর অন্তহীন শুভেচ্ছা জানাই প্রিয় বন্ধুদের, যারা অতি যত্নে লালন করছেন আলাপী মন এর মর্মবাণী। আলাপী মন, রীণা চ্যাটার্জি ও অমল দাস দের জানাই আন্তরিক শুভ কামনা।